নিমতলীর ছোট্ট শিল্প জাদুঘর

হামিদুজ্জামান খান আর আইভি জামানের সঙ্গে আমার পরিচয় ও হৃদ্যতা প্রায় ৪০ বছর ধরে, তাঁদের কাজের আমি গুণগ্রাহী, কাজের প্রতি তাঁদের অবিচল নিষ্ঠা ও একাগ্রতা আমাকে যেমন, তরুণ শিল্পীদেরও তেমন অনুপ্রাণিত করে। হামিদুজ্জামান ধাতু দিয়ে ভাস্কর্য করেন, আইভি জামানও ভাস্কর, কাজ করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। কিন্তু তাঁরা দুজন ক্যানভাসে-কাগজেও ছবি আঁকেন। হামিদুজ্জামান খান সাদাকালোয় যে কিছু অসাধারণ কাজ করেছেন, তার একটি তিনি আমাকে উপহার দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিন্নপত্র-এ অন্ধকারকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, পরতে পরতে তার গভীরতার রূপটা উদ্​ঘাটন করে দেখিয়েছেন, ঠিক সে রকম হামিদুজ্জামানের কাজটিও অন্ধকারের গভীরতা এবং নানাবিধ দ্যোতনা-অন্বেষী।

হামিদুজ্জামানকেও অনেক শিল্পী তাঁদের কাজ উপহার দিয়েছেন—কামরুল হাসান থেকে গৌতম চক্রবর্তী পর্যন্ত। অনেক কাজ তিনি সংগ্রহও করেছেন। আইভির সংগ্রহেও বেশ কিছু চিত্রকর্ম আছে। সেগুলো দিয়ে তাঁরা নিমতলীতে এশিয়াটিক সোসাইটির পেছনের ভবনের তিনতলায় একটি ছোট্ট জাদুঘর গড়ে তুলেছেন। এশিয়াটিক সোসাইটির কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ একটি চমৎকার উদ্যোগে সহায়তা দেওয়ার জন্য।

তিনতলার একটি সুপরিসর কামরার দেয়ালে, মেঝেতে এবং একটি ক্ষুদ্রায়তন কক্ষের ও করিডরের দেয়ালে স্থান নিয়েছে চিত্রকর্মগুলো। ঘণ্টাখানেক ঘুরে দেখার পর মনে হলো, বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের প্রথম ৫০ বছরের একটা বিশ্বস্ত ও প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিফলন ঘটেছে এই সামান্য সংগ্রহে—শতাধিক হবে না শিল্পকর্মের সংখ্যা, কিন্তু কত বিচিত্র কাজ তাতে অন্তর্ভুক্ত—তেলরং, জলরং, কালি ও কলম, কাঠকয়লা, কাঠখোদাই, ছাপচিত্র, ধাতু ও কাঠের ভাস্কর্য। উপহারের এবং দীর্ঘদিনের সীমাবদ্ধ সংগ্রহের শিল্পকর্ম দিয়ে বিষয়নির্ভর অথবা ইতিহাসের কোনো রেখাভিত্তিক প্রদর্শন সম্ভব নয়, সে চেষ্টাও হামিদুজ্জামান করেননি। কিন্তু তিনি যা করেছেন, শিল্পগুরুদের সঙ্গে একালের কিছু শিল্পীর কাজ পাশাপাশি রেখেছেন। তাতে আমাদের শিল্পচর্চার ধারাবাহিকতা এবং এর একাল-সেকাল নিয়ে সুন্দর একটা ধারণা হয় দর্শনার্থীদের। তা ছাড়া হামিদুজ্জামানের সংগ্রহের ছবিগুলোতে শিল্পীদের নিজস্ব শৈলী ও বিষয়বস্তুগত পছন্দের প্রকাশটা স্পষ্ট। যেমন কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী অথবা আমিনুল ইসলামের কাজগুলোতে কোনো স্বাক্ষর না থাকলেও বলে দেওয়া যায় এগুলো এই শিল্পগুরুদের। মুর্তজা বশীরের বলিষ্ঠ রেখাচিত্র, মুস্তাফা মনোয়ারের অননুকরণীয় জলরং, আবদুর রাজ্জাকের আকর্ষণীয় শহরচিত্র, সমরজিৎ রায়ের রেখা ও রঙের মূর্ত-বিমূর্ত যুগলবন্দী, চন্দ্রশেখরের সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাধর্মী ছবি, কালিদাস কর্মকারের রেখাধর্মী কাজ, মাহমুদুল হকের ছন্দময় বিমূর্ততা অথবা আবু তাহেরের ঘনবদ্ধ বিমূর্ততার তেলরং। আরও ছবির মধ্যে আছে আবদুস শাকুরের পরিচিত মহুয়া-মলুয়া উপকথার ছবির জগতের পাশাপাশি ভিন্ন শৈলীতে করা, আধা বিমূর্ত, ফর্মপ্রধান আরেকটি চিত্র; নাসরীন জাহানের প্রাচ্যধর্মী ছবি, সময়ের আগে চলে যাওয়া নিভৃতচারী ও জীবনমুখী শিল্পী শওকাতুজ্জামানের পাখি ও প্রকৃতি নিয়ে দুটি ছবি, ফরিদা জামানের জাল ও জেলের জীবন নিয়ে বলিষ্ঠ একটি কাজ, রেজাউল করিমের বাঙ্​ময় প্রতিকৃতি, রোকেয়া সুলতানার প্রিয় বিষয় ম্যাডোনার সুন্দর উপস্থাপনার পাশাপাশি একটি ছাপচিত্র, ইউনুসের ফর্ম নিয়ে করা নিরীক্ষার এক চমত্কার স্বাক্ষর অথবা রঞ্জিত দাসের সাদাকালোয় করা দুটি স্টাডি; শেখ আফজালের প্রাণিত প্রতিকৃতি, জামাল আহমেদের ব্যাকুল নদী-নিসর্গের রূপায়ণ, অলকেশ ঘোষের সপ্রাণ জলরঙে আঁকা শহরচিত্র, আবুল বারক আলভীর সবুজপ্রধান এক প্রাণিত ক্যানভাস অথবা নিসার হোসেনের রেখা, ফর্ম ও রং নিয়ে করা নিরীক্ষাধর্মী একটি ছবি। শিল্পতত্ত্ববিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলামের দুটি স্কেচও আছে জাদুঘরে, হয়তো এটি প্রমাণ করার জন্য যে যে লেখে সে আঁকেও!

বুলবন ওসমান অবশ্য নিয়মমতোই লিখে ও এঁকে গেছেন, এই সংগ্রহে তিনিও আছেন। দীপা হকের আত্মপ্রতিকৃতি দেখে মনে পড়বে প্রাণঘাতী এক রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করেও কীভাবে তিনি নিজেকে শিল্পে সমর্পিত রেখেছিলেন। প্রয়াত শিল্পী মহসীনের একটি কাজ দেখে তাঁর অভাবটা বোধ হবে। হামিদুজ্জামানের ভাস্কর্য অবশ্যই আছে, আছে মইনুল ইসলাম ও নাসিমা হক মিতুর কাঠের ভাস্কর্য এবং মুকুল বাড়ৈর ভাস্কর্যধর্মী কাজ। ছবি আরও আছে, কিন্তু অতিমারির সময় বদ্ধ কোনো ঘরে সময় খরচ করতে হয় হিসাব করে, তাই সব দেখা হয়নি। সেই সুযোগ শিগগিরই আসছে, সে রকম এখন ভাবাই যায়।

বাংলাদেশের শিল্পকলার সংগ্রহ আছে জাতীয় জাদুঘরে, কিন্তু অন্য কোথাও, অন্তরঙ্গ পরিসরে কয়েক প্রজন্মের শিল্পীদের কাজ পাশাপাশি দেখার উপায় নেই। হামিদুজ্জামান ও এশিয়াটিক সোসাইটি এর একটা উপায় করে দিল। তাদের এই উদ্যোগ আরও পূর্ণতা পাক। আমি নিশ্চিত, অনেক দর্শক প্রতিদিন সেখানে যাবেন। কারণ, শিল্পকলায় আমাদের অতীত-বর্তমানের সমৃদ্ধির একটা ধারণা তাতে সহজেই তাঁদের পাওয়া হয়ে যাবে।