নিশ্বাস নিতে পারছি না

অজস্র পুলিশ পরিবেষ্টিত অবস্থায় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে নেওয়ার সময়। ১৮ মে, ঢাকা
ছবি: সাজিদ হোসেন

১৮ মে মঙ্গলবার ফেসবুকে একটা ছবি দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পুলিশি প্রহরায়। ভাবছেন এতে অবাক হওয়ার কী হলো? পুলিশি প্রহরা এমন কী অস্বাভাবিক ব্যাপার? না, অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু ছবিটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরাই অস্বাভাবিকতাটুকু ধরতে পেরেছেন। কারণ, পুলিশের সংখ্যা ছিল শতাধিক। রোজিনা ইসলাম কেবল লেখেন, তাঁর অস্ত্র কেবল কলম আর কি-বোর্ড। অথচ ছবিটি দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি গ্রেনেড-মেশিনগান-মিসাইল-অ্যাটমবোমা বহন করেন! যেন একজন সাংবাদিককে নয়, ভয়ংকর সন্ত্রাসীকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আদালতে! কলমকে এত ভয় রাষ্ট্রের?

কী লেখেন রোজিনা ইসলাম? সাংবাদিকেরা আর কীই–বা লেখেন, সংবাদ বা সংবাদভাষ্যই তো! কিংবা বড়জোর কোনো কোনো খবরের বিশ্লেষণ। কিন্তু এই সাংবাদিক লেখেন তার চেয়ে বেশি কিছু। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখতে ভালোবাসেন তিনি, লিখেছেনও প্রচুর, সাম্প্রতিক কালে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে লিখেছিলেন সাড়া জাগানো কিছু প্রতিবেদন। এই রিপোর্টগুলোর জন্যই তিনি ক্ষমতাসীনদের বিরাগভাজন হয়েছেন। সেই বিরাগের এমনই রূপ যে মন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী তাঁকে পাঁচ ঘণ্টা সচিবালয়ে আটকে রেখে অবিশ্বাস্যভাবে হেনস্তা করলেন। তারপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো থানায়, তাঁর নামে মামলা দেওয়া হলো ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ নামের (১৯২৩ সালের) ঔপনিবেশিক আইনে। ১০০ বছরের পুরোনো একটা আইনে মামলা দিতে হলো কেন? যেন হেনস্তাটা দীর্ঘস্থায়ী হয়, এই তো? এত ভয় আপনাদের? কলমকে এত ভয় পান?

বিশ্বজুড়েই গণমাধ্যম তথা সাংবাদিক-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের প্রধান একটি কাজ হলো সরকারের সমালোচনা করা; তাদের ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেওয়া; জনগণ যে কথাগুলো বলতে পারছে না, সেই কথাগুলো বলা। অথচ আমাদের দেশে ঘটছে তার উল্টো।

কথাটা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে, লজ্জাও হচ্ছে। কারণ, আমিও কলমশ্রমিক। তবু না বলে পারা যাচ্ছে না যে অক্ষর-শব্দ-বাক্যের শক্তি যে কতখানি, তা যদি আমাদের লেখক-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিকেরা তথা কলমশ্রমিকদের সবাই সম্যক অনুভব করতেন, তাহলে আর এ শ্রেণির কেউ কেউ খানিক সুযোগ-সুবিধা আর দুটো পয়সার লোভে নির্লজ্জ চাটুকারিতায় মত্ত হতেন না। আজ যখন অজস্র অন্যায়-অবিচার-অনাচার দেখেও নীরব হয়ে থাকেন লেখক–সাংবাদিক–বুদ্ধিজীবীদের অনেকে, তখন মনে হয় যেন তাঁদের মৃত্যু ঘটে গেছে। অবশ্য এসব লেখক-বুদ্ধিজীবী–সাংবাদিকের ভিড়ে আঙুলে গোনা কয়েকজন আছেন, যাঁরা কখনো আপস করেন না, হার মানেন না, মেরুদণ্ড সোজা রেখে মাথা উঁচু করে চলেন। আর এঁরাই হয়ে ওঠেন ক্ষমতাবানদের চক্ষুশূল। সুযোগ পেলেই হেনস্তা করা হয় তাঁদের নানাভাবে। রোজিনা ইসলাম সেই আপস না করা সাংবাদিকদের একজন।

বিশ্বজুড়েই গণমাধ্যম তথা সাংবাদিক-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের প্রধান একটি কাজ হলো সরকারের সমালোচনা করা; তাদের ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেওয়া; জনগণ যে কথাগুলো বলতে পারছে না, সেই কথাগুলো বলা। অথচ আমাদের দেশে ঘটছে তার উল্টো। কেন ঘটছে? কারণ, কলমের শক্তি, লেখার শক্তি, বলার শক্তি সম্বন্ধে এ দেশের বর্তমান বিদ্বত্সমাজের অধিকাংশের এখন ধারণা নেই বলে আমার মনে হয়। অথচ এই বিদ্বত্সমাজই একদা পাকিস্তানি শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল, মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছিল।

হে কলমজীবী, আপনি আপনার কলমকে কী কাজে ব্যবহার করবেন, সে সিদ্ধান্ত আপনারই। ইচ্ছা করলেই আপনি পারেন রাষ্ট্রের সব অন্যায়-অবিচার-দুর্নীতির ভিত নাড়িয়ে দিতে অথবা কলমটি এগিয়ে দিতে পারেন প্রভুর পায়ের নিচে। জি, সিদ্ধান্ত আপনারই।

লেখার শুরুতে একটি ছবির কথা বলেছিলাম। শেষেও আরেকটি ছবির কথা বলি। ফেসবুকে অজস্র মানুষ এই ছবি ও ভিডিও শেয়ার করেছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সচিবালয়ের এক সরকারি কর্মকর্তা রোজিনা ইসলামের গলা চেপে ধরেছেন! এটি দেখে আমার মনে পড়েছিল মার্কিন মুলুকের জর্জ ফ্লয়েডের কথা, ২০২০ সালের ২৫ মে যাঁর গলায় হাঁটু চেপে হত্যা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ পুলিশ। ফ্লয়েড জীবনের শেষ মুহূর্তে কেবল বলছিলেন, ‘আই কান্ট ব্রিদ, আই কান্ট ব্রিদ’। ফ্লয়েড একা নন, ২০১৪ সালের পর পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়ে অন্তত ৭০ আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ মৃত্যুর আগে উচ্চারণ করেছিলেন এই একই বাক্য, ‘আই কান্ট ব্রিদ’। কারণ, এটি এখন হয়ে উঠেছে ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার’ আন্দোলনের স্লোগান। রোজিনা ইসলামকে গলা চেপে ধরার ভিডিও–ছবি দেখেও আমার মনে হয়েছিল, আই কান্ট ব্রিদ, অর্থাৎ আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না। হ্যাঁ, এই ভীষণ অসহিষ্ণু, অগণতান্ত্রিক, দুর্নীতিপরায়ণ, অনাচার-অবিচারে ছেয়ে যাওয়া সমাজ ও রাষ্ট্রে আমি আর নিশ্বাস নিতে পারছি না, নিশ্বাস নিতে পারছি না। তাহলে এটা কি আমাদেরও সবার স্লোগান হয়ে উঠবে?