পুঁথিকার মুন্সী মালে মোহাম্মদের গায়েবি কারবার

ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধের জনপ্রিয় পুঁথিকার মুন্সী মালে মোহাম্মদকে নিয়ে রয়েছে নানা কিংবদন্তি। এক শীতলক্ষ্যা তীরেই আছে তাঁর তিন তিনটি মাজার

মুন্সী মালে মোহাম্মদের পলাশপুর গ্রামের মাজারে কিশোরীকে নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে চন্দ্রবান
মুন্সী মালে মোহাম্মদের পলাশপুর গ্রামের মাজারে কিশোরীকে নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে চন্দ্রবান

‘পুঁথি নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন! ব্যাপার কী? কোনো গবেষণা করছেন?’
বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগারে দাঁড়িয়ে কথাটি বলেছিলাম আখতারুজ্জামান ভূঁইয়াকে। এটি তাঁর কেতাবি নাম হলেও ডাকনাম মতি। বীর মুক্তিযোদ্ধা এই মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয় আকস্মিকভাবে, অনেকটা আমারই আগ্রহে। আমার স্বভাবটি এমন, কাউকে পুরোনো কিছু নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখলেই তাঁর প্রতি আমার আগ্রহ জাগে। তো, পরিচয়ের পর থেকে আখতারুজ্জামান ভূঁইয়া আমার কাছে হয়ে উঠলেন ‘মতি ভাই’। মতি ভাই সেদিন আমার কর্মক্ষেত্র বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগারে পুরোনো একটি ছাপাপুঁথি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। একসময় তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম ওই প্রশ্নটি।
‘না, কোনো গবেষণা না, সময় কাটাচ্ছি, বয়স হয়েছে, বেকার সময়। ভাবছি, বেকার সময়টা কীভাবে ব্যবহার করা যাই। তাই এই পুঁথি বেছে নিলাম। অবশ্য, এটা বেছে নেওয়ার অন্য কারণ আছে—এই যে পুঁথিটা দেখছেন সয়ফলমুলক বদিউজ্জামাল, এর রচয়িতা মুন্সী মালে মোহাম্মদ আমার আত্মীয়। আমার স্ত্রী ওনার বংশের লোক। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। তাই ভাবলাম, অবসরজীবনটা মুন্সী মালে মোহাম্মদের পরিচয়টা উদ্ধার করি।’
এবার তাঁকে আমি নিয়ে গেলাম বাংলা একাডেমি বিক্রয়কেন্দ্রে। সেখান থেকে বাংলা একাডেমি গবেষণা পত্রিকার একটি সংখ্যা কিনে উপহার দিলাম, যেখানে আলাওল, দোনা গাজী, মুন্সী মালে মোহাম্মদ ও অন্যান্য উপস্থাপনায় সয়ফলমুলক বদিউজ্জামাল আখ্যানের নানা রূপান্তর নিয়ে আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধটি পড়তে পড়তেই উৎফুল্ল মতি ভাই, ‘জানেন, মুন্সী মালে মোহাম্মদ বহুত কামেল লোক ছিলেন, আপনার সঙ্গে সাক্ষাতে তাঁরও কোনো ইশারা হয়তো আছে।’
ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধের জনপ্রিয় পুঁথিকার মুন্সী মালে মোহাম্মদকে নিয়ে আমার পড়াশোনা অনেক দিনের। সহজ বাংলায় পুঁথি রচনার ফলে মালে মোহাম্মদের কাব্য ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। ঢাকা এবং কলকাতা থেকেও প্রকাশিত হয় তাঁর পুঁথি। আলাওল ও দোনা গাজীর প্রায় দুই শ বছর পর নতুনভাবে জনমানুষের বোধগম্য করে সয়ফলমুলক বদিউজ্জামাল লেখেন তিনি।
আখতারুজ্জামান ভূঁইয়া ওরফে মতি ভাইয়ের সঙ্গে আলাপের সূত্রে সাকার মুস্তাফাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মালে মোহাম্মদের খোঁজে। ২০১৫-এর ১ মার্চ। আমাদের গন্তব্য শীতলক্ষ্যা নদীর পার্শ্ববর্তী পলাশপুর গ্রামে, এখানে আছে মুন্সী মালে মোহাম্মদের একটি মাজার।
মালে মোহাম্মদকে সম্মান জানাতে শিরনি ও মিলাদের আয়োজন করা হয়েছিল সেদিন। আশপাশের নানা গ্রামের বিভিন্ন বয়সী নরনারী উপস্থিত। মাজারের উত্তর দিকে একটু দূরে মাঠের মধ্যে বসে আছেন ভাবাক্রান্ত্র কয়েকজন প্রবীণ। তাঁদের সমীপে যখন গেলাম, তাঁরা তখন মোবাইল ফোনে বাজানো একটি মারফতি গানের ধ্যানে মগ্ন:
‘ওরে, হইবি কারা জিন্দা মরা জলদি
চইলা আয়
আমার আশিক বাবার প্রেমাগুনে
ওই মরা পুড়ায়।
মরার আগে মরে যারা তাদের বলে জিন্দা মরা
মরায় ধরে মরার গলা বুকে বুকে মিলায়।’

মুন্সি মালে মোহাম্মদ রচিত পুঁথি সয়ফলমুলক বদিউজ্জামাল
মুন্সি মালে মোহাম্মদ রচিত পুঁথি সয়ফলমুলক বদিউজ্জামাল

মোবাইল ফোনের পাশাপাশি গানটিতে কণ্ঠ দিচ্ছিলেন আসরের অনেকেই। তাঁদের মধ্যে একজনের হাতে একটি কালো রঙের ছাতা, গানের সুরে আবেগাক্রান্ত্র হয়ে একপর্যায়ে ছাতা তুলে লোকটি মালে মোহাম্মদের মাজারের দিকে তাকালেন। ছাতার নিচের দিকটি মাটিতে পোতার ভঙ্গি করলেন। পরম ভক্তির তালে তালে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘ওহ মালে মুন্সী! এহানে মাল আছে।’
ছাতাধারী ব্যক্তির কাছে তাঁর নাম-পরিচয় জানতে চাইলে বললেন, তাঁর নাম তাহের আলী খান, বাড়ি বরিশাল। তিনি গাড়ি চালান এবং বাবুর্চির কাজ করেন।
‘মালে মুন্সী, এহানে মাল আছে’—কথাটি কেন বললেন? তাঁকে জিজ্ঞাসা করি। তাঁর উত্তর, ‘এটা মহ্বতের কারণে বলেছি। আমার পরথম এই আগমন, এহানে এসে আমার মহ্বত জেগেছে।’
এরপর তাহের আলীর পাশের লোকটির পরিচয়ও জানা হলো—শমন মিয়া মেম্বার। বললেন, ‘ওই গোলাম বাজারে আমার বাড়ি।’
‘আপনাকে বেশ আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ মনে হচ্ছে।’
‘আমি ব্যাবাক টাকাপয়সা এইতেই লুটাইলাম। আমার এইতেই আনন্দ। বুঝছেন, আমার বাড়ি-গাড়ি দরকার না, এই আনন্দ আমার কাছে খুব ভালো লাগে।’
‘গুরু ধরছেন আপনি?’
‘হ, আমার বাজান আটরশি। আটরশির জিকিরও আমার মোবাইলে আছে।’
ওই আসরের বয়স্ক লোককে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার নাম?’
এক গাল হেসে তিনি বলেন, ‘নাদু পাগলা। বাড়ি করের গাঁও।’
এঁরা ছাড়াও সেই আসরে আছেন কবির হোসেন ও আবদুর রহমান—দুজনই স্থানীয়। তাঁদের কাছে জানতে চাই মুন্সী মালে মোহাম্মদের মাজারের ইতিহাস।
আবদুর রহমান বলেন, ‘আমার হিসাব হয় দেড়-দুই শ’ বছর আগের এই মাজার। এটা নদীর ভেতরে ছিল।’
আবদুর রহমানের কথা থামিয়ে দিয়ে কথা বলে ওঠেন শমন মিয়া, ‘রহমান, এইডা তুমি কেমতে কও। আমি যহন আমার বাড়ি কিনি, কতাখেন মনে রাইখো, দেখছি চারদিকে চারডা খুঁটি গাইড়া একটা বেড়া দেওয়া ছিল। ওই যে ভান্ডারি (সম্ভবত ভান্ডারি ছিল মুন্সী মালে মোহাম্মদের মাজারের খাদেম) আছিল না, ভান্ডারি আগে মোমবাতি জ্বালাইত।’
প্রশ্ন করি, ‘এটা তো নিচু জায়গা, কিন্তু মাজারটা দেখছি অনেক উঁচু। এটা কীভাবে হলো?’
আবদুর রহমান বলেন, ‘এটার দুই সাইডে নদী ছিল। নদীর মাঝখানে এটা ছিল। এটা নদীতে ভাঙেনি। তবে, ওনার (মুন্সী মালে মোহাম্মদ) আত্মীয়স্বজন যারা ছিল, তারা এটাকে শনাক্ত কইরা মাজারটা বানাইছে। এই মাজারের দালানটা দুই-তিন বছর হলো করা হয়েছে। এখন যারা আছে, তারা ভাবছে, এহানে আমার বাড়িটা যেহেতু এর উছিলায় পায়ছি, যাহোক আমি এটার খেদমত করব। এই হিসাবে চলছে। আর এরাও আমাদের দেশের লোকই। আজ যে মিলাদ হচ্ছে, এরপর রাতের বেলা আমরা সবাই মিলে গানবাজনা কিছু করব।’
এর মধ্যে পরিচয় হলো হাফিজ উদ্দিন নামে এক বৃদ্ধের সঙ্গে। তাঁর নিবাস বাউরগাটি গ্রামে। তিনি বললেন, ‘স্বর্ণের যেমন ভেজাল হয় না, এই মাজারের তেমন ভেজাল নেই। একেবারে খাঁটি।’
একপর্যায়ে এক বৃদ্ধাকে দেখা গেল এক কিশোরীকে সঙ্গে নিয়ে মালে মোহাম্মদের মাজারে ভক্তি দিচ্ছেন। দেখলাম, মাজার ছুঁয়ে বৃদ্ধাটি মালে মোহাম্মদের উদ্দেশে বলছেন, তাঁর নাতনি যেন ভালো একটা জামাই পায়। ভক্তি দেওয়া শেষে নিজের নাম জানালেন তিনি, ‘আমার নাম চন্দ্রবান। মুন্সী মালে মোহাম্মদ আমার বড়বাবা—আমার দাদার বাবা ছিলেন তিনি। আমার বাবার নাম মুছা মুন্সী, দাদার নাম আব্বাস মুন্সী, আর আব্বাস মুন্সীর বাবা হলেন মুন্সী মালে মোহাম্মদ। আমার চাচার নাম রহিম মুন্সী, আরেক চাচা আবদুল লতিফ। আমি প্রথম দেখছি বাঘাপুর, সেখানে আমার বাপ-চাচারা থাকত।’
চন্দ্রবানের কথার পিঠে রসুলপুরের গোলাম হোসেন নামে একজন বলেন, ‘এই এলাকায় মুন্সী মালে মোহাম্মদের তিনটি গায়েবি মাজার আছে—একটি কলাকান্দি গ্রামে, অন্য দুটির মধ্যে একটি বাঘাপুরে, আর একটি এই পলাশপুর গ্রামে।’
পুঁথিকার মুন্সী মালে মোহাম্মদের পলাশপুরের মাজার এবং মানুষজনের নানান কথা আমাদের টেনে নিয়ে যায় বাঘাপুরের দিকে। ফলে গেল বছরের ১১ আগস্ট সন্ধ্যায় আমাদের যাত্রা বাঘাপুর—মালে মোহাম্মদের দ্বিতীয় মাজারের সন্ধানে।
তবে এখানকার মাজারসংলগ্ন লোকজন আমাদের তেমন কোনো সহযোগিতা করলেন না, তার বদলে তাঁদের চোখে সন্দেহ। তো, সেই বিরূপ অভিজ্ঞতার মধ্যেও এগিয়ে এলেন এক মাছ ব্যবসায়ী—মোহাম্মদ সজীব হোসেন। তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন মাজারসংলগ্ন বসতভিটার এক নারীর সঙ্গে। কিন্তু তিনিও পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলেন আমাদের, ‘দেখেন ভাই, আমরা এই জায়গা কিনে নিছি, কিছুদিন ধইরা এখানে বসবাস করি। আমরা এই মাজারের কিছু জানি না।’
তাঁকে প্রশ্ন করি, ‘আপনারা তাহলে নতুন আসছেন এখানে। কত দিন ধরে এখানে আছেন?’
‘তা বিশ বছর ধইরা আছি। আপনি লালাঘাটি যান, এই বাড়ির মাহাজন আছে। হেই মালিক বলতে পারবে।’
এরপর আমাদের বাঘাপুরের মুন্সী মালে মোহাম্মদের মাজারের মূল খাদেম বিবি জয়নবের বাড়ির দুয়ার অবধি পৌঁছে দিলেন সজীব।
দেখা গেল বিবি জয়নবের ঘরের দরজা খোলা, তিনি টেলিভিশন দেখছেন। বুকে সাহস নিয়ে ঘরে ঢুকে তাঁকে সালাম দিলাম। তবে প্রথম থেকেই আমাকে সন্দেহ করেন বিবি জয়নব। তাঁর সন্দেহ গভীর না হতেই কথা শুরু করলাম আমি। কিন্তু তিনি নিষেধাজ্ঞা দিলেন—কোনো ছবি তোলা যাবে না। অগত্যা মোবাইল রেকর্ডার অন করে তাঁর কথা রেকর্ড করি, ‘আমার নাম বিবি জয়নব। বয়স পঞ্চাশের ওপরে। আমি বারো বছর ধরে মালে মোহাম্মদ মুন্সীর মাজারে যাই। প্রতি বৃহস্পতিবারে যাই, বাত্তি জ্বালাই দিয়ে আসি।’
তাঁর কথার মধ্যে প্রশ্ন করতেই তিনি জানালেন, ‘আমি কানে কম হুনি।’ কিন্তু একটু জোরে যে কথা বলব তার উপায়ও নেই। বিবি জয়নবের স্বামী এসব মাজার-পির-আউলিয়া পছন্দ করেন না। তাই শর্তানুসারে আমি জয়নবের স্বামী আসার আগ পর্যন্তই কেবল কথা বলতে পারব তাঁর সঙ্গে। জানা গেল, মালে মোহাম্মদের বাঘাপুর গ্রামের মাজারে প্রতিবছর চৈত্র মাসের আগে ফাল্গুনের বারো-তেরো তারিখে খিচুড়ি দিয়ে শিরনি করানো হয়।
বিবি জয়নব বলেন, ‘মালে মোহাম্মদ মুন্সী আছিল। তাঁরা পাঁচ ভাই। ওই যে হেইডা হইছে মান্নান মুন্সী, ওই যে রসুলপুর আছে। পলাশপুরের হেইডা হইছে মালে মোহাম্মদ মুন্সী। আরেকজন আছে রশিদ মুন্সী, হান্নান মুন্সী, মামুন আল মুন্সী। হেরা পাঁচ ভাই, দুই জায়গায় দুই ভাইকে ধরা হইছে (মাজার করা হয়েছে)। আরেকখানা আছে, সেখানে মাজার ওঠে নাই, না উঠলেও হেয়ানে সিনার তা (শনাক্তকরণ চিহ্ন), গাঙে ভেঙে গিছল, আবার জেগে উঠছে।’
এবার তাঁর কাছে শোনা গেল মালে মোহাম্মদ মুন্সীর গায়েবি কারবার সম্পর্কে, ‘তিনি অনেক বড় কবি আছিল। তাঁর নিজের কবর সে নিজেই বানাইছে। সে যে মৃত্যুবরণ করছে, আমরা জানি না, দেখি না, মানুষের কাছে শুনছি, তাঁর গোসলের জন্য মানুষ যখন পানি গরম করতে গেছে, কাফনের কাপড়চোপড় আনছে, কিন্তু সে নিজের গোর নিজেই করছে, সে যে ছাপড়ার নিচেতে শুয়ে আছিল সেখানে নিজের কবরস্থানে দাইব্যা গেছে নিজেই। মানে তাঁরে কেউ কাফন-টাফন দিয়ে মাটি মঞ্জিল করেনি। সে তাঁর নিজের গুণেই দাইব্যা গেছিল, আল্লাহর হুকুম। এসব আমার দাদারা, দাদার বাপেরা কয়ত। মানুষের মুখে শুনছি।’
জয়নবকে জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনার পরিবারের আর কারা যায় ওই মাজারে?’
‘আমার ছেলেমেয়েরা যায়। কিন্তু ওগের আব্বায় রাজি হয় না, বারো বছর যে চলছে। আমি মনে করেন বিষ্যুদবারে যাইয়া বাত্তি জ্বালাইয়া দিয়া আসি।’
‘বাঘাপুর গ্রামের এই মাজার কীভাবে তৈরি হলো?’ বিবি জয়নবের কাছে জানতে চাই।
‘এটা আমি স্বপ্নে দেখছি। স্বপ্নে আইসা মালে মোহাম্মদ মুন্সী আমারে কইল কী—“মা, একটা কতা কইলে রাখতে পারবা?” তখন আমি কইলাম—বাবা, কী কথা আমি রাখনের উপযুক্ত? আমি তো কোনো কিছু বুঝি না, জানি না। তখন কইছে কী—“আমার তো নাম ছিল মালে মোহাম্মদ মুন্সী, এখন তো আমি মালে মোহাম্মদ আউলিয়া, আমার নাম প্রতিষ্ঠা করতে পারবা?” তখন বাবা আমি কী করমু! আমি তো পয়সাকড়িহীন। গরিব, অসহায়, মুরুক্কু, কিছু জানি না। তখন আমার ছোট একটা ছেলেরে কয়ছি, বাবা, এ রকম এ রকম তো আল্লাহর হুকুম, তো আমি কী করতাম? ছেলে কয়, মা, আমি ব্যবস্থা করছি। আমার ছোট ছেলাটায় একটা সাইনবোর্ড টানাইয়া দিছে মালে মোহাম্মদ আউলিয়ার।’
প্রশ্ন করি, ‘এর আগে কোনো চিহ্ন ছিল না?’
‘জ্বে না, আমি জীবনে কোনো দিন আজার-মাজার, মেলা-মাটি এসব ভালো মনে করিনি। কোনো দিন মাজারের সামনে তো দূরে থাক পেছন দিয়াও যাইনি। কিন্তু আমারে দিয়েই স্বপ্নযোগে এই মাজার বানাইছে।’
বাঘাপুর ও পলাশপুর গ্রামের মানুষের কাছে পুঁথিকার মুন্সী মালে মোহাম্মদ হয়ে উঠেছেন একজন অলীক মানুষ, সাধক-সিদ্ধ আউলিয়া। এর নিশ্চয় ভৌগোলিক ও আর্থসামাজিক একটি প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস আছে। কারণ, শীতলক্ষ্যার নদীর ভাঙনে এই অঞ্চল বিলীন হয়েছে বহুবার, এলাকার মানুষের মুখেই শোনা গেল এই তথ্য।
মুন্সী মালে মোহাম্মদ রচিত সয়ফলমুলক বদিউজ্জামাল, আখেরী জামানার হাল, খয়বরের জঙ্গনামা, তম্বিয়তন্নেছা বা আওরতের নছিহত, নছিহতেন্নেছা, ছেরাতল মোমেনীন ইত্যাদি পুঁথির মুদ্রিত সংস্করণের পাশাপাশি হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির সন্ধান রয়েছে বাংলা একাডেমি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে। সেসব পুঁথির সঙ্গে মালে মোহাম্মদকে নিয়ে জনসাংস্কৃতিক রূপ-রূপান্তরের নৃতাত্ত্বিক গবেষণা হতে পারে আরও। তার পটভূমিই হয়তো এই লেখাটি।