পুশকিনকে নিয়ে এক টুকরো

আধুনিক রুশ সাহিত্যের জনক পুশকিনের ২২৩তম জয়ন্তী আজ

আলেকজান্ডার সের্গেয়েভিচ পুশকিন

আজ ৬ জুন। রাশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি এবং আধুনিক রুশ সাহিত্যের জনক আলেকসান্দার সের্গেয়েভিচ পুশকিনের ২২৩তম জন্মজয়ন্তী। পুশকিন ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার। তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি কাজ হলো: কবিতা—‘দ্য ব্রোঞ্জ হর্সম্যান, নাটক—‘দ্য স্টোন গেস্ট’, কাব্যিক নাটক—‘মোৎসার্ট অ্যান্ড সেলেইরি’, ছোটগল্প—‘দ্য শট’, ‘দ্য টেলস অব দ্য লেট ইভান পেত্রোভিচ বেলকিন’ প্রভৃতি। তাঁর প্রায় সব রচনাই ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ ছাড়া ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, জার্মান, পোলিশসহ আরও অনেক ভাষায় রুশ এই কবির লেখা অনূদিত হয়েছে।

এবার পুশকিনের জীবনের দিকে একটু ফিরে তাকানো যাক। ১৭৯৯ সালের ৬ জুন রাশিয়ার মস্কোতে একটি অভিজাত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ছিল সের্গেই লভোভিচ পুশকিন আর মায়ের নাম নাদেজদা (নাদিয়া) ওসিপোভনা গ্যানিবাল। পণ্ডিতদের গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত যে পুশকিনের প্রপিতামহ আব্রাম পেত্রোভিচ গ্যানিবাল বর্তমান ক্যামেরুনের চাদ হ্রদের সীমান্তবর্তী এলাকায় জন্মেছিলেন। সামরিক প্রকৌশলী হিসেবে ফ্রান্সে শিক্ষা লাভের পর গ্যানিবাল রেভালের গভর্নর হন এবং পরবর্তীকালে রাশিয়ার সমুদ্র দুর্গ ও খাল নির্মাণের দায়িত্ব নিয়ে জেনারেল ইন চিফ (তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পদপর্যাদা) পদ লাভ করেন।

মস্কোয় জন্ম নেওয়া পুশকিন ধাত্রী ও ফরাসি শিক্ষকদের কাছ থেকে ফরাসি ভাষা শেখেন। ১০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ফরাসি ভাষায় কথা বলতেন। তবে গৃহভৃত্য এবং আয়া আরিনা রাদিওনোভনার মাধ্যমে তিনি রুশ ভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
১৫ বছর বয়সে পুশকিনের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। সেন্ট পিটার্সবুর্গের কাছে সারস্কোয়ে সেলো শহরের মর্যাদাপূর্ণ ইম্পোরিয়াল লাইসিয়াম থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৮২০ সালে তাঁর প্রথম দীর্ঘ কবিতা ‘রুসলান ও লুভমিলা’ প্রকাশ করেন পুশকিন। ইতিমধ্যে তাঁর প্রতিভা রুশ সাহিত্যজগতে পরিচিতি লাভ করে।

পুশকিন উদারনৈতিক ব্যক্তিত্ববাদ এবং ফরাসি চিন্তাবিদ দিদেরো ও ভলতেয়ারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। ধীরে ধীরে সমাজসংস্কারক এবং সাহিত্যিক সংস্কারবাদীদের মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। এর মধ্যে তিনি নিজের লেখা বিতর্কিত কবিতা ‘ওডে টু লিবার্টি’ আবৃত্তি করেন, যা রাশিয়ার জার প্রথম আলেকসান্দারকে ক্ষুব্ধ করে। ফলে ১৮২০ সালে তৎকালীন রাজধানী সেন্ট পিটার্সবুর্গ ত্যাগ করতে বাধ্য হন পুশকিন।

অতঃপর ককেসাস, ক্রিমিয়া, কামিয়ানকা ও মলদোভার কিশিনাউতে নির্বাসিত জীবনযাপন করেন এই কবি। এ সময় তিনি গ্রিক বিপ্লবে অনুপ্রাণিত হন এবং ফিলকি ইটেরিয়া নামে একটি গোপন সংগঠনে যোগ দেন।

১৮২৩ সালে কিশিনাউয়ে অবস্থানকালে ‘ককেসাসে বন্দী’ ও ‘বখচিসারাইয়ের ফোয়ারা’ নামে দুটি রোমান্টিক কবিতা লিখে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। ১৮২৩ সালে পুশকিন ওডেসা চলে যান। এ সময় তিনি আবারও সরকারের সঙ্গে সংঘাতে জড়ান। ফলে তাঁকে তাঁর মায়ের গ্রামীণ এস্টেট মিখাইলভস্কায়ে ১৮২৪ থেকে ১৮২৬ সাল পর্যন্ত নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়।

প্রবল ব্যক্তিত্ব আর অসাধারণ রোমান্টিকতা দিয়ে অনেক নারীর মন জয় করে পুশকিন কাউকে সরাসরি ভালোবেসেছেন, কাউকে করেছেন শ্রদ্ধা। আবার কেউ কেউ ছিল কেবলই তাঁর কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা। পুশকিনের মন জয় করা নারীদের তালিকায় রয়েছে দুটো ভাগ। প্রথম ভাগে আছে ১৬টি নাম, দ্বিতীয় ভাগে ১৮টি। প্রথম ভাগে যে নামগুলো আছে তাঁদের প্রত্যেককেই তিনি ভালোবেসেছেন। সেই তালিকার কয়েকজনের নাম হলো ইয়েকাতেরিনা আন্দ্রেয়েভনা কারামজিনা, আভদোতিয়া ইভানোভনা গোলিৎসিনা, আমালিয়া রিজনিচ, এলিজাবেতা একাক্সাভেরিয়েভনা, আনা আলেক্সেয়েভনা আন্দ্রো, আনা পেত্রোভনা কার্ন। আনা কার্নকে লেখা ‘টু’ কবিতাটি রুশ ভাষায় লেখা সবচেয়ে বিখ্যাত প্রেমের কবিতা। এখানে বলা দরকার, আলোচিত এই নারীদের প্রায় সবাই ছিলেন রূপবতী এবং অভিজাত পরিবারের বিবাহিতা নারী।

১৮২৫ সালে মিখাইলভস্কা এস্টেটে নির্বাসনের সময়ে পুশকিন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত নাটক ‘বোরিস গোদুনোভ’ লেখেন, পাঁচ বছর পরে এটি প্রকাশিত হয়। তাঁর কাব্যিক উপন্যাস ‘ইউজিন ওনেজিন’, ১৮২৫ সাল থেকে ১৮৩২ সালের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে লেখা হয়।

১৮২৮ সালে পুশকিন ১৬ বছরের নাতালিয়া গনচারোভারের সঙ্গে পরিচিত হন। সেই সময়ে নাতালিয়া গনচারোভার ছিলেন মস্কোর সর্বাধিক আলোচিত সুন্দরীদের একজন।

তিনি ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের কন্যা। এ সময় ঘটে আরেকটি ঘটনা—সেনাবাহিনীতে যোগ দেন পুশকিন। সেখান থেকে দুই বছর পর ফিরে বিয়ের প্রস্তাব দেন নাতালিয়াকে। ১৮৩০ সালে তাঁদের বাগদান হয় এবং ১৮৩১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিয়ে হয়। পুশকিন ও নাতালিয়ার ঘরে জন্ম নেয় চার সন্তান-মারিয়া, আলেকসান্দার, গ্রিগোরি ও নাতালিয়া। উল্লেখ্য, আলেকসান্দার ও নাতালিয়ার বংশধর এখনো বেঁচে আছেন। পুশকিনকন্যা নাতালিয়ার নাতনি নাদেজদার বিয়ে হয় বর্ধিত ব্রিটিশ রাজপরিবারে। চমকপ্রদ তথ্য হলো, কবির বংশধরেরা এখন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, বেলজিয়াম, চেক প্রজাতন্ত্র ও লুক্সেমবার্গে বসবাস করেন।

জুয়া খেলে প্রায়ই হারতেন পুশকিন। ঋণী হয়ে পড়তেন। ঋণ শোধ করার জন্য প্রকাশকদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে লিখে ফেলতেন কবিতা, গল্প বা উপন্যাস। এভাবেই তিনি ঋণের টাকা পরিশোধ করতেন।

১৯৩৬ সালে তিনি খুব বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ সময়ে তাঁর স্ত্রী ফরাসি সেনাবাহিনীর অফিসার জর্জেস দান্তেসের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়েন বলে গুজব রটে। এ বাস্তবতায় দান্তেসকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান করেন পুশকিন। কথিত আছে, এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে জার সরকারের সংশ্লিষ্টতা ছিল। ১৯৩৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পুশকিনের সঙ্গে দান্তেসের দ্বন্দ্বযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। দান্তেস প্রথম গুলি চালিয়ে পুশকিনকে গুরুতর আহত করেন। এর দুই দিন পর ১০ ফেব্রুয়ারি বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে সেন্ট পিটার্সবুর্গের নিজ বাড়িতে মারা যান রাশিয়ার এই কণ্ঠস্বর।

সেই বাড়িটি বর্তমানে পুশকিন জাদুঘর। অকালে মারা গেলেও পুশকিন আজও আধুনিক রুশ সাহিত্যের জনক বলে স্বীকৃত। ভাষার ওপর আশ্চর্য দক্ষতা, প্রাঞ্জলতা ও গভীরতা ছিল তাঁর সাহিত্যের মূল বৈশিষ্ট্য।