প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায় লেখা ছাপা হওয়া কি মর্যাদার ব্যাপার!

সেটা বোধ করি ১৯৯৮ সাল। আজ থেকে ২৩ বছর আগের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ি। ব্যর্থ ব্যর্থ সব কবিতা-গল্প লিখে ভরে ফেলছি ক্লাসের খাতা। সাহিত্যের নিবিড় পাঠক। কাগজের আবর্জনা ছাতা-মাথা যা যেখানে পাই গোগ্রাসে পড়ি। নিজেদের লেখা প্রকাশ করার জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার তর সয় না। বন্ধুরা মিলেই বের করছি দু–তিন ফর্মার পত্রিকা। আমি যে শিল্পসাহিত্যের একজন খাদেম—এই পরিচয়েই তখন মোটামুটি সন্তুষ্ট ছিলাম। তবে আত্মপ্রকাশের লোভ একেবারে ছিল না, তা নয়।

নিয়মিত পড়তাম তখনকার পত্রপত্রিকাগুলো। দৈনিক পত্রিকার স্মৃতি যতটুকু মনে পড়ে, হলের কমনরুমে ছিল একাধিক পত্রিকা। সাহিত্য পাতা পড়তাম বিচিত্র সব পত্রিকার। কিন্তু দেখতাম, টানাটানিটা লাগত মূলত তখনকার দৈনিক ভোরের কাগজ নিয়ে। চাঁদে পাওয়া যুবক তখন আমি। তাই অন্য কিছুতে নয়, আমার নজর থাকত মূলত সাহিত্য পাতার দিকে। এখানে যাঁদের লেখা ছাপা হতো, তাঁদের নাম দেখতাম আর গোপন ঈর্ষা বোধ করতাম। ভাবতাম, বাপ রে বাপ! এখানে যদি লেখা ছাপা হয় তো আমার লেখক স্বীকৃতি ঠেকায় কে!

কাঁহাতক সহ্য করা যায়! একবার রবীন্দ্রনাথবিষয়ক এক প্রবন্ধ নিয়ে বুকে ফুঁ-ফাঁ দিয়ে গেলাম ভোরের কাগজ–এর সেই সময়কার সাহিত্য সম্পাদকের কাছে। তিনি আমাকে সামনে রেখেই লেখার কিছু কিছু জায়গা নিয়ে নেতিবাচক প্রশ্ন তুললেন। তরুণ রক্ত টগবগিয়ে উঠল। লেখাটা টেনে নিয়ে বললাম, ‘ছাপতে হবে না, থ্যাংক ইউ।’ তত দিনে ওই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মতিউর রহমান নতুন পত্রিকা করেছেন—প্রথম আলো

দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যের রাজধানীও স্থানান্তরিত হলো বাংলামোটর থেকে কারওয়ান বাজারে। লোকমুখে শুনলাম, প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায় যার তার লেখা ছাপা হয় না।

সাল–তারিখ মনে নেই। ২০০০ বা ২০০১ হতে পারে। এর মধ্যে এক শুক্রবারে দেখি হুমায়ুন আজাদের বিরাট সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায়। আজাদ মানেই যথারীতি নানা বিতর্কিত কথার এক জমাট মজমা। দেখলাম সেখানে আজাদ রবীন্দ্রনাথের নারীবিষয়ক একটা থিসিস দিয়েছেন। বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ নারীর মুক্তি চাননি। নারীর জন্য ‘ঘর’ আর পুরুষের জন্য ‘বাহির’—এই তত্ত্বে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। এ জন্য তিনি একটি উপন্যাসও লিখেছেন, ঘরে বাইরে। মাথা গরম হয়ে গেল। বিরাট এক প্রতিক্রিয়া লিখে পাঠালাম প্রথম আলোতে। তখন বাতাসে শুনতাম—এখনো যেমন শুনি—প্রথম আলো অপরিচিত ও অপ্রতিষ্ঠিত কোনো লেখকের লেখা ছাপে না। তবু পাঠালাম। পাঠালাম আজাদকে একহাত নিয়ে কড়া ভাষায় লিখে। পরের শুক্রবারে দেখি আমার শিক্ষক হুমায়ুন আজাদের বড় এক ছবিসহ প্রায় চার কলামে ছাপা হয়েছে আমার লেখাটি। বিভাগে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হলো। বিভাগের একাধিক ছাত্র আজাদকে ব্যাকুল করে তুলল আমার পরিচয় তুলে ধরে। শুনেছি আজাদ তাদের বলেছেন, ‘ও মূর্খ, পড়াশোনা জানে না।’ আজাদের কথাকে তখন পাত্তা দিইনি। অনেক পরে বুঝেছি, তিনি ভুল কিছু বলেননি। সেযাত্রায়, প্রথম আলোতে লেখা ছাপা হয়েছে—এই তৃপ্তি আর গরিমা নিয়ে বেশ কিছুকাল বিভাগে আর সাহিত্যিক বন্ধু মহলে ভাবসাব নিয়ে বেড়ালাম। কারণ, তখন সাধারণ্যে এমন একটা ধারণা ছিল, প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায় লেখা ছাপা হয়েছে মানে তুমি লেখক বটে!

এরপর লিখেছি ঢের। কিন্তু বাজারে প্রথম আলোর সাহিত্য পাতার ‘আভিজাত্য’ আর ‘গোষ্ঠীপ্রিয়তা’র যে ‘গসিপ’ চালু ছিল, তা আমলে নিয়েই আর লেখা পাঠানো হয়নি। আবার শুরু হলো ২০১৩ সাল থেকে প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায় লেখা। এরপর থেকে বেশ নিয়মিতই লিখেছি। এসব লেখার সময় একটা কথা খুব মনে হয়েছে, আমি কি আমার কথাগুলো লিখতে পারছি! নাকি আমি সম্পাদকের চাহিদাই শুধু মেটাই। এর উত্তর সম্পাদকের পক্ষে খুব একটা যায়নি। নিজের পক্ষেই বেশি থেকেছে। আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের বিষয় ‘কালচারাল পলিটিকস’। প্রথম আলোতে লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধে এখন পর্যন্ত এই আগ্রহের প্রকাশ ঘটানো যায়—এটাকে কম কিছু বলে উড়িয়ে দিই কোন যুক্তিতে!

পাঠক হিসেবে দেখেছি নিকট অতীতেও, সাহিত্য ও ভাষাবিষয়ক গুরুতর গুরুতর সব প্রশ্ন তুলেছে এই সাহিত্য পাতা। বাংলা ভাষার সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক থেকে শুরু করে সাহিত্যের উত্তর–ঔপনিবেশিক পাঠ পর্যন্ত হাজির করেছে। বাংলাদেশের সাহিত্যের ভূগোলকে নানা মাত্রায় আলো ফেলে দেখতে চেয়েছে। যদিও এ কথা বলা দরকার, এই সাময়িকী গত বছরখানেক সিরিয়াস সাহিত্যের স্থানকে কিছুটা হলেও সংকুচিত করেছে। এটা কি পাঠক চাহিদার প্রতিফলন! ঠিক বলা মুশকিল।

দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতার সাহিত্যের কোনো সম্পর্ক নেই—এমন শ্লাঘামূলক কথাবার্তা সাহিত্যিক মহলে বেশ চালু আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান বাংলাদেশে সাহিত্যের সঙ্গে, সাহিত্যের বিকাশের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন জায়গা আদৌ আছে কি! বাংলাদেশে বর্তমানে এমন কোনো শিল্পসাহিত্য-চিন্তাবিষয়ক পত্রিকা আছে কি, যেখানে লেখা ছাপানোটাকে কোনো লেখক মর্যাদাপূর্ণ মনে করেন! এমন কোনো দৈনিকের সাহিত্য পাতা আছে কি! হারিকেন ধরিয়েও বোধ করি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই আকালে লেখা প্রকাশের আনন্দ, মর্যাদা ও আভিজাত্য কিছুটা হলেও বোধ করি একমাত্র প্রথম আলোর সাহিত্য পাতাই ধরে রাখতে পেরেছে। এ কথা প্রথম আলোর নিন্দুকও স্বীকার করবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই দাপটের যুগে এটাই বোধ করি প্রথম আলোর বড় সার্থকতা।