প্রসন্নচিত্ততার উত্স

আতাউর রহমান (১৯৪২—২৮ আগস্ট ২০২১)

বাঙালি হাসতে জানে না, তারা রামগরুড়ের ছানা, মুখটাকে সারাক্ষণ তারা বাংলার পাঁচের মতো করে রাখে—এ রকম অনেক অপবাদ আমাদের সইতে হয়। হয়তো এ জন্য যে, বাঙালির জীবন, ইতিহাসজুড়েই, সংগ্রামের, কষ্টের, তিতিক্ষার; হাসি-আনন্দের ফুরসত তাতে সামান্যই। কিন্তু বাঙালি হাসতে জানে না যাঁরা বলেন, তাঁরা হয়তো হাসির একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেন। হাসি তো অনেক রকমের হয়। ‘কেউ হাসে ভুঁড়ি দুলিয়ে, কেউ হাঁটু ঝাঁকিয়ে, কেউ গায়ে কারও আঙুলের সুড়সুড়ি লাগিয়ে, আবার কেউ হাসে মাথা দিয়ে।’ এই শেষ হাসিটা আসে একটা পরিচ্ছন্ন, বুদ্ধিলেপা রসবোধ থেকে। আতাউর রহমান এটিকেই তাঁর রম্যলেখার নিশানা করেছিলেন । ঊর্ধ্ববন্ধনীতে দেওয়া হাসির রকমফের নিয়ে লেখা কথাগুলো তাঁরই। তিনি বলতেন, বাঙালি শুধু হাসতে নয়, হাসাতেও জানে; কিন্তু এই হাসাহাসি থেকে যায় প্রতিদিনের জীবনযাপনে, লেখালেখি পর্যন্ত পৌঁছায় না। যাঁরা সেই কাজটি করেছেন, নিপুণতা এবং শক্তিমত্তা দিয়ে, সৈয়দ মুজতবা আলী অথবা শিবরাম চক্রবর্তী, তাঁরা বাঙালির রসবোধের সবচেয়ে চর্চিত দিকগুলোর সন্ধান দিয়েছেন।

জসীম উদ্​দীনের বাঙ্গালীর হাসির গল্প দুই খণ্ডে ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হলে আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে বাঙালি আবিষ্কার করল, তারা হাসতে জানে। সত্যটা পুরোনো—সংগ্রহের গল্পগুলো যার প্রমাণ, কিন্তু আবিষ্কারটা নতুন।

গল্পগুলো পড়ার পর রসবোধের বিষয়টা নিয়ে নতুন একটা কৌতূহল জাগল। এর আগের বছর সৈয়দ মুজতবা আলীর সামনে বসে কয়েক দিন সকাল-সন্ধ্যা তাঁর কথা শোনার সুযোগ হয়েছে। তিনি ওই মাথা দিয়ে হাসা, অর্থাৎ ‘উইট’ ও রসবোধ বা ‘হিউমার’ নিয়েও বলেছেন। তাই আমার এ রকম একটা ধারণা জন্মাতে শুরু করল যে রস দিয়ে ভিজিয়ে সবচেয়ে কঠিন কথাও কারও মনে গেঁথে দেওয়া যায়। কেন, বাঙালিই তো ‘মিছরির ছুরি’ আবিষ্কার করেছে!

১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করে সিলেট এমসি কলেজে ভর্তি হলাম এবং ইংরেজির স্যার হিসেবে পেলাম আতাউর রহমানকে। প্রথম দিন থেকেই তিনি আমার স্যার, তাঁর সঙ্গে এই কয়েক মাস আগে যখন শেষ কথা হয়, সেদিনও তিনি আমার স্যার। শেষ কথাগুলোও তিনি বলেছেন সেই প্রথম দিনের স্যারের মতোই, বুদ্ধিরসে ভিজিয়ে।

আমার সবচেয়ে ইংরেজি-ভিতু বন্ধুটিকেও ক্লাসে ধরে রাখতে পারতেন আতাউর রহমান স্যার। ঘণ্টাটা কোথা দিয়ে চলে যেত, বলতে পারব না, যদিও পড়াটা ঠিকই হয়ে যেত, কিন্তু একটা লাভ হতো আমাদের: স্যারের নানান কৌতুক, রসগল্প শুনতে শুনতে সপ্তাহের হাসি এক দিনে হেসে নিতে পারায়। তাঁর ক্লাসে বসার জায়গা পাওয়া কঠিন ছিল, অথচ কোনো পাঠ তিনি শেষ করেননি—এমন কেউ বলতে পারবে না।

একসময় স্যার সরকারি চাকরি বেছে নিয়ে শিক্ষকতায় ইস্তফা দিলেন। আমার মনে হয়েছিল, ক্ষতিটা হলো ছাত্রছাত্রীদের, লাভটা হলো সরকারি দপ্তরের—তাঁর কর্মক্ষেত্র ডাক বিভাগের।

স্যারের পদায়ন হতো নানান জায়গায়। কূটনীতিতেও তিনি যুক্ত হয়েছিলেন কিছুদিনের জন্য, বিলেতে ছিলেন কিছুদিন। কিন্তু মাঝেমধ্যে স্যারের সঙ্গে দেখা হতো। পরিচ্ছন্ন মনের মানুষ ছিলেন, আচরণে ছিল সৌজন্য ও বিনয়। স্যারের বেশভূষায় পরিপাটি ভাব থাকত; তাঁর সংস্কৃতির মানটিও ছিল উঁচু। মানুষের প্রতি বিশ্বাস ছিল, নিজের ওপরও এবং তাঁর আত্মসম্মানবোধটি ছিল প্রখর। এমসি কলেজে পড়ার সময়ই জেনেছিলাম, তিনি জন্মেছিলেন রক্ষণশীল পরিবারে, পিতামহ ছিলেন পীর। কিন্তু তাঁর ইংরেজি সাহিত্য পড়ার ইচ্ছায় কেউ বাধা দেননি। নিজে ধার্মিক ছিলেন এবং বলতেন, ধর্মের একটা যে দিক আছে জ্ঞানতত্ত্বের, তাকে তিনি খুব মূল্য দেন।

ডাক বিভাগের প্রধান দপ্তরে আতাউর রহমান স্যারের অফিসে মাঝেমধ্যে আমার ডাক পড়ত। সব কাজ ফেলে যেতাম। তাঁর সঙ্গে আলাপের একটা আকর্ষণ ছিল, তা শুধু তাঁর কৌতুকবোধের প্রকাশের জন্য নয়, বরং কিছু মূল্যবোধকে সব সময় সামনে নিয়ে আসার জন্য। সময়কে তিনি মূল্য দিতেন, পরিশ্রমকেও, পঠন-পাঠনকেও। স্যারের টেবিলে একদিন গোর্কির বই দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বলেছিলেন, ফুটপাত থেকে সংগ্রহ করেছেন।

আতাউর রহমান স্যারের ছাত্রছাত্রীরা দীর্ঘদিন যা জানত, প্রথম আলোর পাঠকেরা তা জানতে শুরু করলেন এর পাতায় তাঁর রম্য কলাম ‘দুই দুগুণে পাঁচ’ শুরু হওয়ার পর। রম্যলেখাগুলো সুখপাঠ্য হওয়ার কারণ তাঁর লেখার গুণ। তিনি লিখতেন না, যেন পাঠককে একটা বৈঠকি মেজাজে কৌতুক শোনাতেন। কারণ অবশ্য আরও ছিল: তাঁর বিস্তৃত পড়াশোনা, কৌতুক বা জোকস (তিনি ইংরেজি শব্দটিই বেশি পছন্দ করতেন) মনে রাখার তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা এবং কখন, কোন উপলক্ষে, কোন বৈঠকে, কোন জোকটা শোনাতে হবে, তা নির্ধারণ করার এক অব্যর্থ বিচারবোধ। তবে স্যারের জোকগুলো শুধু যে হাসাত, তা নয়, সমাজের নানা সমস্যা, অসংগতি, বিচলন নিয়ে পাঠকদের সতর্কও করে দিত।

আতাউর রহমান অনেক বই লিখেছেন, তাঁর অনেকগুলোই কৌতুক বা জোকসের সংগ্রহ, যেমন মধ্যরাতের জোকস, সাত সতেরো অথবা রসগল্পের রাজকোষ, কিন্তু কিছু বই, যার মধ্যে আমার প্রিয় অল্প অম্ল বিস্তর মধু কিছুটা বর্ণনা বা ব্যাখ্যামূলকও। এ বইতে প্রেম-ভালোবাসা ও বিয়ে নিয়ে কিছু গল্পও আছে, তাতে মাথা দিয়ে হাসার ব্যাপারটা প্রধান। এই রসগল্পগুলো পাঠককে ভাবায়ও।

আতাউর রহমানের ভাষা ছিল সাবলীল, লেখাতে ছিল পরিমিতিবোধ। তিনি এক লেখায় জানিয়েছিলেন, তিনি মনে করেন লেখকেরা প্রধানত দুই শ্রেণির—একশ্রেণি হচ্ছে মাকড়সা, তারা মৌলিক। মাকড়সা যে রকম নিজ নাভি থেকে সুতো বের করে বুনে যায়, এই শ্রেণির লেখকেরাও তা–ই করেন। অন্য শ্রেণিটি তাঁতি। সুতার সরবরাহ আসে বাইরে থেকে, তাঁতি শুধু বুনে যান। তিনি বলতেন, তিনি কথা-তাঁতি, তাঁর সুতার সরবরাহ অফুরন্ত। লেখাও হবে অফুরন্ত।

মৃত্যু এসে সেই সম্ভাবনার এ রকম সমাপ্তি ঘটাবে, এটি আমরা কেউ ভাবতে পারিনি।

যেখানেই থাকেন স্যার, বাঙালির প্রসন্নচিত্ততার এক উত্স হয়েই আপনি থাকবেন।