
দিন শেষে আলগোছে নেমে আসা এই রাত, এই ভরা যৌবনময়ী চাঁদ, বোধ হয় গভীর সংকেতময়। রাতের এই জোছনা-রাঙানো আবছা শরীরের নেশাতেই ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে কল্পনায় মমতার ছায়ারূপ আঁকি, আর ভাবি হাসপাতালের সাদা, স্বপ্নহীন বিছানায় ও কী এখন নিঃশব্দে ঘুমাচ্ছে, নাকি ব্যথানাশকের মায়াময় প্রভাবে অচেতন হয়ে পড়ে আছে? হাসপাতালে কি মোবাইল অ্যালাউ করে? একটু দ্বিধা নিয়েই দুরুদুরু বক্ষে মোবাইলের বাটন টিপি। ওপাশ থেকে ক্ষীণ কণ্ঠে সাড়া দেয় মমতা।
‘তোমার অপারেশন কি হয়ে গেছে মমতা? ভালো বোধ করছ এখন? কত দিন থাকবে হাসপাতালে?’
একনিঃশ্বাসে প্রশ্ন করি। আমার কণ্ঠে হয়তো খানিকটা উদ্বেগ, একটুখানি ব্যাকুলতাও মিশে থাকে।
‘তুমিও? তুমিও জানতে চাইছ এসব একঘেয়ে অসুখের কথা?’
মমতার কণ্ঠে একটু বিরক্তি। তারপর আহ্লাদি গলায় নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে, ‘না গো প্রিয়ে, এসব নয়, তুমি বরং আমাকে ভালোবাসার গল্প বলো, যে ভালোবাসা আরোগ্য দেয়, সান্ত্বনা দেয়, গভীরতম ক্ষতগুলো সারিয়ে তোলে, ওই যে তুমি বলতা, হুলো বিড়াল আর দোয়েল পাখির ভালোবাসার গল্প...।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে মমতা, বলছি, ধরো, তখন তুমি ছিলা একটা বোকাসোকা মিষ্টি দোয়েল পাখি আর আমি ছিলাম একটা রাগী দুঃখী হামবড়া ধরনের হুলো বিড়াল। হুলোটা একদিন কীভাবে যেন সেই উড়ন্ত দোয়েলের প্রেমে পড়ল...।’
‘না, থাক। এইটা না, তুমি বরং নিমগাছের গল্পটা বলো...।’
মমতা মাঝপথে আমাকে থামিয়ে দিলে আমি আরেকটা ভালোবাসার গল্প শুরু করি, ‘আচ্ছা, সেই সময় তুমি ছিলা মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লম্বা, সরু, সজীব নিমগাছ। তুমি পাতা নাড়ালেই নিরাময়ী বাতাস চারপাশে ছড়িয়ে পড়ত, আর আমি ছিলাম এক বিবাগী সাধু। সংসার ছাড়তে চাইলেও সংসার আমাকে ছাড়ত না, শুধু আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরত। তারপর সেই সাধু প্রেমে পড়ল নিমগাছের...।’
মমতা এবারও বাধা দেয়, ‘এটাও না, তুমি তানপুরার গল্পটা শোনাও...।’
‘ঠিক আছে মহারানি, যা তোমার ইচ্ছা। তুমি তখন ছিলা ঘরের কোনায় শুয়ে থাকা এক বিপুলা নিতম্বিনী তানপুরা। আমি ছিলাম তার বুনো বাদক। একেক সময় তানপুরার সারা শরীরজুড়ে ঝড় তুলত আমার আঙুল আর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত অভূতপূর্ব স্বর্গীয় সুর...।’
‘এই থাক, এ রকম মিথ্যা মিথ্যা বানানো ভালোবাসার কথাবার্তা বলার দরকার নাই...।’
ওই পাশ থেকে হঠাৎ মমতার নিষেধাজ্ঞা। আমি মোবাইল ফোনটা এক কান থেকে আরেক কানে নিয়ে বলি, ‘তুমি কি আমারে একটা গল্পও শেষ করতে দিবা না?’
‘প্রেমের গল্প কি কখনো শেষ হয়, বলো! আগুনের মতো কোথাও না কোথাও জ্বলতেই থাকে, জলের মতো নিঃশব্দে বইতেই থাকে...।’
আমি প্রসঙ্গ পাল্টাই, ‘আচ্ছা, আমি তোমারে একবার দেখতে আসি হাসপাতালে। আসব, বলো শাহারজাদি?’
‘কিন্তু তোমাকে আমার রুগ্ণতা দেখাতে সংকোচ হয় যে জাহাঁপনা; বরং সুস্থ হলে দেখতে আইসো, অবশ্য যদি কখনো সুস্থ হই। কী জানো, ভয়াবহ বোঝার মতো মনে হয় আমার এই বেঁচে থাকা... শরীরের এই যন্ত্রণাগুলো মনে হচ্ছে কোনো দিনই ফুরাবে না... উহ্ ...।’
অস্ফুট স্বরে মমতা বোধ হয় একটু কোঁকায়।
‘কী হইলো মমতা? খারাপ লাগছে? কষ্ট হচ্ছে তোমার?’
এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না মমতা; কিন্তু সেলফোনে আমি ঠিক শুনতে পাই, এগিয়ে আসছে কারও জুতার খটখট শব্দ। কে এসেছে? ডাক্তার নাকি নার্স? মমতা ঠিক আছে তো?
‘আবারও ফোন করছ তুমি? এই হাসপাতালেও? মেয়েটাকে একটু শান্তি দিতে চাও না তুমি?’
সুদীপার কর্কশ কণ্ঠ ঝনঝন শব্দে বেজে ওঠে। এত রুক্ষ কেন ও, এত নিষ্ঠুর?
‘মমতা কেমন আছে?’—শান্তভাবে জানতে চাই আমি।
‘মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে ও, বুঝতে পারছ? মৃত্যুর জন্য। এখানকার ডাক্তাররা বলে দিয়েছে, এ দেশে আর চিকিৎসা নাই। তোমার লাল গোলাপ আর নীল চাঁদের আলো এখন কোনো কাজে আসবে না। চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার, বুঝছ? অনেক টাকা।’

সুদীপা একটু থামে। তারপর আবার বলে, ‘আচ্ছা, মমতার সাথে তোমার সম্পর্কটা ঠিক কোন পর্যায়ের—বলো তো আমাকে? ও মারা গেলে সত্যি তোমার কিছু আসে যায়? ভালোবাসো ওকে?’
সুদীপা আরও অনেক কিছু বলতে থাকলেও সব ছাপিয়ে আমার মাথায় ‘টাকা’ শব্দটি ঘুরপাক খেতে থাকে। গত কয়েক বছর টাকার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমি খুব একটা মাথা ঘামাইনি। কিন্তু এখন সুদীপা আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, মাথা ঘামানো দরকার ছিল। আচ্ছা, আমি যদি ওই কাজটা করি, যা করতে আমার মন একেবারেই সায় দিচ্ছে না, তাহলে হয়তো মমতার চিকিৎসার জন্য কিছু টাকার ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু শুধু কয়েকটা টাকার জন্য কাজটা কি আমি করব, নাকি করব না? আর করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত আমার অনিচ্ছুক হাত, বিদ্রোহপ্রবণ মন একজন অপরাধীর মহৎ প্রতিকৃতি আঁকবে কি না কে জানে! ওই ভদ্রলোক, যিনি আমাকে কাজটা দিয়েছেন, যাকে আমি সূর্যমানব বলে ডাকি, তিনি স্বীকারই করেছেন যে তাঁর মৃত পিতা একাত্তরের ঘাতকদের পক্ষ নিয়েছিলেন। সেই ঘাতককে আর কতখানি মহান করে আঁকতে পারি আমি? আর যেকোনো শিল্পই তো ঈশ্বরের মতো পরম সন্তোষ ও আনন্দ নিয়ে সৃষ্টি করতে হয়; অন্তত আমি তো তা-ই বিশ্বাস করি। অন্তরের মধ্যে নিদারুণ অসন্তোষ আর চূড়ান্ত ঘৃণা নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী আঁকব আমি? মনের বিরুদ্ধে গিয়ে যা আঁকব, তা কি কখনো ভালো কিছু হতে পারে? নিজের বাবার সেই প্রতিকৃতি যদি সূর্যমানবের পছন্দ না হয়, তাহলে সে কি আমাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবে? আর সেই পারিশ্রমিক না পেলে মমতার চিকিৎসার জন্য আমি অর্থসাহায্য করব কীভাবে?
আমার রাত্রিগ্রস্ত আত্মা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না। আকাশে নক্ষত্র রাত। এমনকি রাস্তার কুকুরগুলোও কেন যেন শব্দ করছে না—একটা করুণ স্তব্ধতা চারপাশে। আমি সকাল হওয়ার অপেক্ষায় চোখ বন্ধ করি। মমতার শুকনো, রোগাক্রান্ত, যন্ত্রণাক্লিষ্ট চেহারার কথা ভাবি। এটা সেই চেহারা, যা আমি দেখিনি কখনো; আবার যেন দেখেছিও বহুবার। ডানায় আঘাত পাওয়া অসহায় রক্তাক্ত পাখির মতো মমতা মেঘের নিচে খুব কষ্টে উড়ে বেড়াচ্ছে কোথাও ডানা মুড়ে একটুখানি বসার জন্য।
দুই.
‘আমার রাজাকার শ্বশুরের পোর্ট্রেট করতে না চাইলে করবেন না, ওটা না করলেও আপনি টাকা পাবেন। আমি আপনাকে টাকা দেব আমার ছবি আঁকার জন্য।’
অমৃতা আজ পড়েছে কালো আলখেল্লার মতো একটা জামা। বসে আছে জানালার পাশে কাঠের চেয়ারে। ওর মুখের এক পাশে শেষ বিকেলের হালকা রোদ পড়ে অপূর্ব দেখাচ্ছে। ‘আমি হবো আপনার মোনালিসা, ঠিক আছে?’—অমৃতা হাসে। ‘টাকা আসলে কোনো সমস্যা না, সমস্যা হচ্ছে মন। মন আমাদের নাচায়, খেলায়, আর কোথায় কোথায় যে ছুটিয়ে নিয়ে যায়! অদ্ভুত!’
অমৃতার সামনে আমি চুপ করে থাকি। আমার ভাষা বিলুপ্ত হয়, কথারা থেমে যায়। আমি ওর দুরন্ত সংলাপের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে বোবা, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
‘আচ্ছা, কখনো ন্যুড পেইন্টিং করেছেন আপনি? এঁকেছেন কোনো অনাবৃত শরীরের ছবি?’
প্রশ্নটা আমাকেই করা, কিন্তু এর উত্তর দিতে গিয়ে স্রেফ পাথরের মূর্তি হয়ে যাই আমি। তারপর অস্ফুটে সত্যি কথাটাই বলি, ‘হ্যাঁ, মানে, অন্যদের পেইন্টিং কপি করেছি।’
‘ও।’—ঠোঁট ওল্টায় অমৃতা। ‘জানেন, আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে প্রায় সারা পৃথিবীর বড় বড় গ্যালারিগুলো দেখা হয়েছে। সব বিখ্যাত শিল্পীই কিন্তু ন্যুড এঁকেছেন। পিকাসো নাকি ন্যুড মডেলকে অনেকক্ষণ ধরে দেখতেন। দেখতে দেখতে মনের মধ্যে একটা ছাপ এসে পড়ত, তারপর তাঁর ছবি আঁকতেন। আচ্ছা, ন্যুড ছবি নিয়ে কী ধারণা আপনার?’
যেন পড়া শিখে না আসা ছাত্রকে হঠাৎ পড়া ধরেছেন শিক্ষক—অমৃতার এমন প্রশ্নের সামনে ধরা খাওয়া ছাত্রের মতো থতমত খেলাম আমি।
‘লজ্জা পাচ্ছেন নাকি?’—কৌতুক ঝিলিক দেয় অমৃতার চোখে।
‘না না, তা কেন!’—হড়বড় করে বলি আমি, ‘সুন্দর শরীরের চেয়ে বড় সৌন্দর্য পৃথিবীতে আর কিছু নাই, রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বলে গেছেন সে কথা। আর নগ্ন শরীরও অনেক সময় নিষ্পাপ দ্যুতি ছড়ায়। আমাদের টিচাররা বলতেন ন্যুড স্টাডি করার সময় নগ্নতা আর যৌনতাকে আলাদা করে দেখতে হয়, তাহলে সুন্দরকে উপলব্ধি করা যায়...।’
একনিঃশ্বাসে বলে ফেলি আমি। অমৃতা হঠাৎ চোখ সরু করে কুটিল ভঙ্গিতে বলে, ‘আমার কথাবার্তা শুনে আপনি আবার ভাবছেন না তো, আমি এখনই আপনাকে আমার ন্যুড ছবি আঁকার প্রস্তাব দিয়ে বসব!’
অতল জলের মধ্যে আরেকবার হাবুডুবু খাই আমি। আমার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চেহারা দেখেই সম্ভবত খিলখিল করে হাসতে থাকে অমৃতা। তারপর আঙুল দিয়ে কপালের চুল সরিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘টাইটানিক ছবির ওই দৃশ্যটা আমার খুব প্রিয় জানেন, ওই যে যেখানে রোজ, জ্যাকের সামনে মডেল হয়ে পোজ দেয়, আর জ্যাক বিস্ময় চেপে রেখে ওর ছবি আঁকে, কী রোমান্টিক, তাই না?’
অমৃতা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। যেন ও আর এখানে নেই, চলে গেছে সমুদ্রে ভাসতে থাকা বিশাল সেই জাহাজের ডেকে; সমুদ্রের নোনা বাতাস ওর চোখে-মুখে ঝাপটা দিচ্ছে। ও ভিজে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে নিজের ভেতর, স্বপ্নের ভেতর।
বিকেলের স্বল্প স্থায়ী রোদ এরই মধ্যে সরে গেছে। ধূসর পাখা মেলে সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। আমি হতবিহ্বল, বাকরুদ্ধ। এর মধ্যে কখন যে নিঃশব্দে অমৃতার মৃত শ্বশুরের চার নম্বর স্ত্রী এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছেন, টেরই পাইনি। পেছন থেকে হঠাৎ তাঁর গলা শুনে চমকে উঠি, ‘কী গো মা, বাতি জ্বালাও নাই? সন্ধ্যা হইয়া গেছে তো।’
বুঝতে পারলাম, সেই আচমকা প্রশ্নে অমৃতা তার স্বপ্নের জাহাজ থেকে এক ঝটকায় নেমে এসেছে। আমি তাড়াতাড়ি সুইচ টিপে আলো জ্বালালাম। আর অমৃতা কোনো কথা না বলে হন হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মাঝ বয়সী মহিলাটি, যাকে অমৃতা কিছুই ডাকে না, তিনি এবার চলে এলেন আমার কাছে। তারপর শীতল গলায় বললেন, ‘জানো তো, অমৃতা মাসুদের তৃতীয় স্ত্রী।’
‘হ্যাঁ, জানি।’—একটু অস্বস্তির সঙ্গেই বলি আমি।
‘মাসুদের প্রথম বউ আত্মহত্যা করছিল আর দ্বিতীয় বউ পাগল হইয়া মারা গেছে, সেইটা জানো?’
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি আবার বলেন, ‘মাসুদ কিন্তু বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমা করে না, তাগোর পিছে কুত্তা লেলায়া দেয়।’
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাঝ বয়সী মানুষটি দ্রুত চলে যান।
নিচ থেকে গেটের কাছে বেঁধে রাখা ভয়াল কুকুরগুলোর হিংস্র চিৎকার ভেসে আসে।