বসন্ত বাতাসে

.
.

আমি অপেক্ষা করি ওই আচমকা দমকা এক বাতাসের। ওই বাতাস গায়ে লাগলে মনে হয়, এইবার বুঝি মানুষের সম্পর্কের যে জটিল সব সূত্র আছে তা বোঝা যাবে। এমন বাতাস বয় শুধু বসন্তে। আমার কাছে বসন্ত মানে খুব বিশেষ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ওই বাতাস। ওই বাতাস বইলে পৃথিবীটা কেমন অচেনা একটা দ্বীপ মনে হয়। এই বাতাস বইলে মাছের পোনার মতো আমার মাথায় স্মৃতি ভেসে আসে। ‘স্থল’ একটা জায়গার নাম। জায়গার নাম হিসেবে অদ্ভুত। যমুনার পারে সে জায়গা। ডুবেই গেছে বুঝি এখন। বহুদিন আগে দেখা কোনো স্বপ্নের মতো মনে পড়ে সেই স্থলে দাদার সঙ্গে ফিরছি মেলা থেকে। আমার হাতে একটা লাল কাগজের তৈরি ঘূর্ণি—কী মূল্যবান সেই ঘূর্ণি আমার! বাতাসে কী ভীষণ অস্থির হয়ে ঘুরছে। বসন্তের বাতাসে। ওই রকম একটা নিষ্পাপ লাল কাগজের ঘূর্ণি নিয়ে দাদার হাত ধরে হাঁটতে ইচ্ছা হয় আবার। মনে পড়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হচ্ছে, স্কুলের মাঠে প্যান্ডেল উথালপাতাল করছে বসন্তের বাতাসে। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, ‘শায়লা, তুমি যেখানেই থাকো, প্যান্ডেলে চলে আসো। সেখানে তোমার মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’ প্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে থাকি, কখন শায়লা ফেরে। কিন্তু দেখি প্যান্ডেল বাতাসে গর্ভবতী নারীর মতো ফুলে উঠছে—শুধু শায়লার দেখা নাই। মাইকে অবিরাম ঘোষণা হতেই থাকে। ময়মনসিংহের এক গ্রামের জোছনা রাত, কাশমতি বেওয়া কুয়ার পানি তুলতে তুলতে আমাকে বলছিলেন, ঘুঘু পাখি আর জীবনে মেয়েমানুষ ছিল। বন্যার সময় নিজের ছেলেকে বুকে আর সতীনের ছেলেকে পিঠে নিয়ে উড়তে গিয়ে নিজের ছেলে বুক থেকে পানিতে পড়ে মরে যায় আর পিঠে রাখা সতীনের ছেলে বেঁচে থাকে। সেই দুঃখে সে সারা জীবন ঘুঘুঘুঘু বলে কাঁদে। আমি দেখি কুয়ার পানিতে পড়ে আছে চাঁদ। তখনো চারদিকে সেই বিখ্যাত বাতাস।
তিউনিসিয়ার সিদি বিসাউদের পাহাড়ের ওপরে যে গ্রাম, তার সব কটা বাড়ির রং সাদা আর দরজাগুলো গাঢ় নীল। পাহাড় থেকে নিচে দেখা যায় নীল নীল সমুদ্র। সেখানে বসে যখন কফি খেয়েছি, মনে হয়েছে অন্য কোনো গ্রহে আছি বুঝিবা। সামনে তিউনিস আন্দোলনের জঙ্গি নারীকর্মী ফাতিনতিলি একটার পর একটা সিগারেট টানে। তার হাতে বালজাকের বই। তার কাছে তার ছেলেবন্ধুর খবর জানতে চাই, যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আগের বছর। সে বলে, তার সঙ্গে আর দেখা হয় না, তার প্রেম ভেঙে গেছে। কারণ ছেলেটা শুধু বোঝাতে চায়। ‘ছেলেদের এই এক সমস্যা বুঝলেন? শুধু বোঝাতে চায়’—ফাতিনতিলি বলে। এ সময় টেবিলে রাখা তার সিগারেটের প্যাকেটটা বসন্ত বাতাসে উড়ে যায়। আমি দেখি উড়তে উড়তে সে প্যাকেট ছুটে যাচ্ছে নীল সমুদ্রের দিকে। বন্ধুর সঙ্গে দেখা না হলেও বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়িতে আসতে পারে শুধু বসন্ত বাতাসেই, একথা জানতেন আমাদের শাহ আবদুল করিম। প্রেমিকার ফুলের গন্ধ না পেলেও তার চুলের গন্ধ প্রথম পেয়েছিলাম বসন্ত বাতাসে। এক বাড়ির ছাদে দিনের শেষ আলোয়। সে বাড়ি থেকে নদী খুব কাছে। সে নদীতে জাহাজ যায়। জাহাজের ভেঁপু বাজে। সেই ভেঁপু কেমন বিষণ্ন, ফাঁকা ফাঁকা। প্রেমিকা বলেছিল, ‘এই বিভ্রান্তিতে তোমাকে চাই’। আমার সেই চেনা চেনা বাতাসে খুব উড়ছিল তার চুল। সেই চুলে নারী গন্ধ। সে গন্ধ চুরি করে বাতাস খুব গর্বিত ভঙ্গিতে আমাকে উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছিল দূরে। বাতাস আর তার চুলের ওই যুগলবন্দী দেখতে দেখতে নিহত হই আমি। মোমবাতি যে জ্বলে থাকে, তাতে তো তাকে দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু যে পতঙ্গ উড়ে যায় ওই আলোর শিখার দিকে, সে জন্য কি সে দায়ী?
পড়ন্ত বিকেলে আলেপ্পোর শতাব্দীপ্রাচীন রাজপ্রাসাদের চত্বরে দাঁড়িয়ে যখন সিরিয়ার কবিবন্ধু ফুয়াদের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন আকাশে দেখা দিল প্রথম তারা। আর বইতে লাগল খুব পরিচিত সেই বাতাস। আমি ফুয়াদকে বললাম আমাদের এক কবি আকাশের একাকী তারাকে বলেছিলেন পাড়া-গাঁর বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলিমদির মেয়েটার মতো কিংবা তার মিসরীয় প্রেমিকা বুকের মালা থেকে একটা মুক্তা খুলে নীল মদের গ্লাসে রাখলে তা দেখতে যেমনটা হয়েছিল, তেমন। চমকে উঠেছিল ফুয়াদ। উদ্গ্রীব হয়ে জানতে চেয়েছিল সে কবির নাম। আমি বলেছিলাম কোনো দিন মিসরে না যাওয়া, বরিশালের সেই কবির নাম, যিনি লিখেছিলেন ‘আজ এই বসন্তের রাতে, এইখানে আমার নকটার্ন’। ফুয়াদ এরপর তার ফেসবুক পেজের প্রোফাইলে দীর্ঘদিন রেখে দিয়েছিল সেই কবির ‘আট বছর আগে একদিন’ কবিতাটির অনুবাদ। সিরিয়ার সেই রাজপ্রাসাদ এখন বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত, ফুয়াদ বৈরুতে উদ্বাস্তু। তার স্ত্রী আলেপ্পোতে ফেলে আসা তাদের নতুন বাড়ির চাবি হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুমায় প্রতিরাতে। সেখানে ফিরবার স্বপ্ন দেখে। আলেপ্পোর ওই ধ্বংসস্তূপের ওপর দিয়ে এখনো নিশ্চয়ই বয়ে যায় চেনা সেই বসন্তের বাতাস।
আমার এক বাল্যবন্ধু আছে, আধা সামরিক বিদ্যালয়ের সেই খাকি চত্বরের দিনগুলো থেকে সে আমার পাশে থাকে। মনের পাশে। সে এমন এক বন্ধু যে ‘কেমন আছিস’ জিজ্ঞাসা করে সত্যি সত্যি অপেক্ষা করে এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য। আমার সেই বন্ধু উঁচু-নিচুর হাহাকারময় এই দেশকে, এখানকার অগণিত আত্মমুগ্ধ প্রতিযোগিতাপরায়ণ মানুষের দিকে এমন নির্বিকারভাবে তাকায় যেন মঙ্গল গ্রহের লাল মাটিতে একটা চেয়ার পেতে বসে অনেক দূরের এই পৃথিবীর তামাশা দেখছে সে। যখন বিশ্বাসে চির ধরে, যখন খুব কাছের মানুষগুলোকে অচেনা মনে হয়, যখন নিজেকে খুব শূন্য মনে হয়, তখন সেই বন্ধুর কাছে যাই। তেমন এক ভেঙে-পড়া দিনের কথা মনে পড়ে ছুটে গিয়েছিলাম তার কাছে। সে তখন ফরিদপুরের এক ছোট্ট মফস্বলের চাকুরে। সেখানে একটা মস্ত খেলার মাঠ। মাঠের ঘাসে বসে ছিলাম সেদিন অনেকক্ষণ। সেদিনও খুব বাতাস ছিল। বসন্তের বাতাস। সে বন্ধু আমাকে তার এক প্রিয় কবির কবিতা শুনিয়েছিল:
মৃত্যুঞ্জয় তুমি ভাই ঝিলমকে আদর করো আর
তোমার ছোঁয়াতে যেন কাঠবিড়ালী বলে ওঠে
মৃত্যুঞ্জয় মৃত্যুঞ্জয় আমে রং ধরেছে।
ঔপনিবেশিক প্রভুর দেশ বিলাতে শীতের দৌরাত্ম্য। তবু এখানেও বসন্ত আসে। এখানে যেসব ফুল ফোটে সেগুলো চিনি না তেমন, এখানে কোকিলের ডাক শুনি না। কিন্তু এখানেও বসন্তে যে বাতাস বয় তাকে চিনতে পারি। এই বাতাস আন্তর্জাতিক। নিউ ক্যাসেলের ঝকঝকে পার্কে হাঁটি। বর্বরতার বদলে সাম্য আসবে পৃথিবীতে—এই স্বপ্নে পৃথিবীর নানা পথ হেঁটেছি। ক্রমশ কেমন বর্বরতারই জয় হচ্ছে যেন। চারদিকে ক্ষতি, মৃত্যু, ভয়। এক যুদ্ধ শেষ হলে আরেক যুদ্ধের নান্দীরোল। এইসব ভাবতে ভাবতে যখন হাঁটি, তখন হঠাৎ দমকা বাতাসে উড়ে এসে গায়ে পড়ে কোনো এক অচেনা গাছের পাতা। হঠাৎ এই বাতাসের ভেতর কেমন একটা খুশির ঘ্রাণ যেন পাই। এই বসন্তের বাতাস যেন কী এক গোপন খবর দিয়ে যেতে চায়। সে কি এই কথা বলে যে এ ভয় সত্য, তবু শেষ সত্য নয়? সে কি বলে যে অবিরাম আতঙ্ক, অবিশ্বাসের ভেতরও আমাদের মুখ ফিরিয়ে রাখতে হবে সুন্দর, কল্যাণ আর প্রেমের দিকে? বসন্তের বাতাস এই গোপন খবর নিয়ে হানা দেয় আমার মনে। আমার কাছে বসন্ত মানে তাই বাতাস। আশ্চর্য, উন্মাতাল সেই বাতাস।