বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সত্যিকার অর্থে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজকে যে ভাষায় আমরা সাহিত্যচর্চা করি, সেটা এখনো রবীন্দ্রনাথের ভাষাকে অতিক্রম করতে পারেনি। আমরা মোটামুটিভাবে তাঁর ভাষাকেই অনুসরণ করি। মোট কথা, আমাদের সাহিত্য হয় রবীন্দ্র-অনুগামী, নয়তো তাঁকে বিরোধিতা করার চেষ্টা। ফলে, রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব এই সময়েও কিছুমাত্র কমেনি, বরং উত্তরোত্তর বাড়ছে। রবীন্দ্রপূর্ব বাংলা সাহিত্য কেবল স্বভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর অতি সামান্যই পঠিত হতো বাইরে। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই আমাদের সাহিত্য বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে। পৃথিবীর মহৎ সাহিত্যিকের প্রায় সব গুণই ধারণ করতেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গি দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে এক বিস্তৃত ও ধ্রুপদি উপলব্ধির জগতে নিয়ে যায় পাঠককে। ফলে, রবীন্দ্রনাথ পাঠে যেকোনো মহৎ সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা হয় পাঠকের। জীবনের ইতিবাচকতা, তার সদর্থক বোধ, সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের এক চিরন্তন ভান্ডার যেন রবীন্দ্রসাহিত্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা নিয়ে অজস্র মতামত রয়েছে ধীমান পাঠকের, তাঁর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে বিস্তর, পক্ষে-বিপক্ষে নানা বিভাজন তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশের বিদ্যায়তনে রবীন্দ্রচর্চার স্বরূপ বোঝার জন্য তোমার সৃষ্টির পথ হতে পারে একটি আদর্শ গ্রন্থ। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের হাত ধরে ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সাহিত্য পত্রিকাটির পথ চলা শুরু হয়। ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণায় বিদগ্ধ মহলে পত্রিকাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ এটি প্রকাশ করে আসছে। ভাষা ও সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে দেশি-বিদেশি পণ্ডিতেরা এখানে লিখছেন প্রথম থেকেই। বিগত ৫০ বছরে সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রসাহিত্য বিষয়ে ৪৪টি প্রবন্ধ এই বইয়ে সংকলিত হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে, বিশেষ করে এ দেশের বিদ্যায়তনগুলোয় রবীন্দ্রসাহিত্য এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কীভাবে বিবেচিত হচ্ছেন, তার একটি রূপরেখা ও ঐতিহাসিক পরিচয় পাওয়া যাবে। ১৯২৬ সালে ঢাকার জনগণ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় আসেন। ১৯২৬ সালের ১০ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি কার্জন হলে দুটি বক্তব্য দেন। ১৯৩৬ সালে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি দেওয়া হয়। বাংলা বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগের পাঠ্যসূচিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য ও দর্শন অনেক আগে থেকেই অন্তর্ভুক্ত। ফলে, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে এ মূল্যায়ন বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে।
সংকলনটির কলেবরের কথা চিন্তা করে একে দুই খণ্ডে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথম খণ্ডের লেখকেরা হলেন শিশির কুমার ঘোষ, আশুতোষ ভট্টাচার্য, সারওয়ার মুর্শিদ, মুহম্মদ আবদুল হাই, হরেন্দ্র চন্দ্র পাল, সৈয়দ আকরাম হোসেন, আহমদ কবির, মাহমুদা খাতুন, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, আবু জাফর, সন্জীদা খাতুন, লতিফা বেগম, মনোয়ারা হোসেন, নরেন বিশ্বাস, নীলিমা ইব্রাহিম, সৈয়দ আলী আহসান, বিশ্বজিৎ ঘোষ, মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল ও এম শমসের আলী। এ খণ্ডে প্রাবন্ধিকেরা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও তাঁর মানসপ্রবণতার নানা দিক তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথের ছড়া নিয়ে আশুতোষ ভট্টাচার্যের প্রবন্ধটি আয়তনে খুব বড় না হলেও বেশ সুলিখিত। ইয়েটসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে সারওয়ার মুর্শিদ লিখেছেন ইয়েটস ও রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ। গোরা উপন্যাস নিয়ে আলোচনায় রবীন্দ্রমানসের প্রধানতম দিকগুলোর ওপর আলোকপাত করেছেন নীলিমা ইব্রাহিম। ‘প্রথম মুসলিম রবীন্দ্র-সমালোচক’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিককার এবং মুসলমান হিসেবে প্রথম সমালোচক মৌলভী একরামউদ্দিনকে নিয়ে আলোচনা করেছেন মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল। বেশ কিছু ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ এখানে তুলে এনেছেন লেখক। এ ছাড়া অন্য লেখাগুলোয় রবীন্দ্রনাথের ভাষাচিন্তা, বিজ্ঞানমানস, রহস্যবাদ, কবিতার অন্তর্গঠন, আন্তর্জাতিকতা ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে।
সংকলনটির দ্বিতীয় খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন মযহারুল ইসলাম, মুহম্মদ মজিরউদ্দীন মিয়া, রফিকউল্লাহ খান, সৈয়দ আজিজুল হক, সিদ্দিকা মাহমুদা, মো. হারুন-আর-রশীদ, সন্জীদা খাতুন, ক্ষেত্র গুপ্ত, মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী, গোপিকানাথ রায়চৌধুরী, ভক্তিপ্রসাদ মল্লিক, সৌমিত্র শেখর, আমীনুর রহমান, মাসুদুজ্জামান, ভীষ্মদেব চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, সাইম রানা, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ ও গিয়াস শামীম। রবীন্দ্রসাহিত্যে প্রবচনের ব্যবহার, তাঁর গদ্যকবিতা, গীতি-নৃত্যনাট্য, নারীবিষয়ক ভাবনা, উপনিবেশবাদের আলোকে ছোটগল্প, লোকসংগীতের প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই খণ্ডের লেখাগুলোয়। মোট কথা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন, দর্শন, তাঁর সাহিত্যের নানা রূপ ও কাঠামো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ রয়েছে এ পর্যায়ের প্রবন্ধগুলোয়। রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে বহুরৈখিক পর্যবেক্ষণের কারণে সংকলনটি বিশেষ হয়ে উঠেছে; পাশাপাশি বাংলাদেশের বিদ্যায়তনিক জায়গায় রবীন্দ্রচর্চার চেহারাটি এ সংকলনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।