বাংলা থ্রিলারের জনক কাজী আনোয়ার হোসেন

কাজী আনোয়ার হোসেন প্রায় এক হাতেই আমাদের দেশে দাঁড় করিয়েছিলেন রহস্য–রোমাঞ্চ গল্পের জনপ্রিয় সাহিত্যধারা। পাশাপাশি ধ্রুপদি বিদেশি সাহিত্যগুলোও সুলভ করেছিলেন পাঠকদের জন্য। তাঁর সৃষ্ট কিংবদন্তি গুপ্তচর মাসুদ রানার জীবন যেমন বিচিত্র ছিল, তেমনি এর স্রষ্টা, পাঠকের প্রিয় ‘কাজীদা’র জীবনও কম বর্ণিল ছিল না। ১৯ জানুয়ারি সেই বর্ণময় জীবনের ইতি ঘটল। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

কাজী আনোয়ার হোসেন
ছবি: সুমন ইউসুফ

বাংলা বইয়ের পাঠকমাত্রই কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখার সঙ্গে পরিচিত। গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে আরম্ভ করে পাঁচ দশকের অধিক কাল বিশাল জনপ্রিয়তা ধরে রাখার কৃতিত্ব কাজী আনোয়ার হোসেন এবং তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি স্বপ্ননায়ক মাসুদ রানাকে অবশ্যই দিতে হবে। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় সেই ষাটের দশক থেকে। বয়সে তিনি আমার ১৪ বছরের বড় হলেও আমরা একই বিদ্যালয়ে, একই মহাবিদ্যালয়ে এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে চৌদ্দ বছরের ব্যবধানে শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেছি।

লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে কাজী আনোয়ার হোসেন একজন জনপ্রিয় গায়ক ছিলেন। একটি আধুনিক সংস্কৃতিমনস্ক পরিবারে জন্ম হয়েছিল তাঁর। পিতা জাতীয় অধ্যাপক, পরিসংখ্যানবিদ, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরম সুহৃদ কাজী মোতাহার হোসেন প্রায় ১০০ বছর আগে কাজী আবদুল ওদুদদের ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ করেছেন। তাঁর তিন বোন সন্​জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন রবীন্দ্রসংগীতের কালজয়ী শিল্পী। তাঁর সহধর্মিনী ষাটের দশকের সুপরিচিত কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিন, যাঁর ছোট বোন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী নিলুফার ইয়াসমিন ও সাবিনা ইয়াসমিন। এমন একজন সৃজনশীল মুক্তচিন্তার মানুষের সান্নিধ্যে কেটেছে আমার লেখালেখির সূচনাকাল।

স্বল্প পরিসরের এই রচনায় তাঁর বহুমুখী প্রতিভার কোন বিষয়ে লিখব ভেবে পাচ্ছি না। ‘মাসুদ রানা’ সৃজনশীল সাহিত্য নয় বলে সমালোচকেরা যতই উপেক্ষা করুন, তিনি কখনো এ নিয়ে বিচলিত বোধ করেননি। অন্তর্মুখী প্রচারবিমুখ এই লেখকের যথার্থ মূল্যায়ন কখনো হয়নি। আমাদের বাংলাদেশের বইয়ের বাজার যখন পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশকদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেই সময় সেগুনবাগিচায় তিন মহলা পৈতৃক বাড়ির পাশে একটি টিনের চালায় সেবা প্রকাশনী স্থাপন করে প্রথমে গোয়েন্দা ‘কুয়াশা’ সিরিজ এবং পরে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ লেখা আরম্ভ করেন। তরুণদের যেমন তিনি বই পড়ার প্রতি আকৃষ্ট করেছেন, ঢাকায় ভারতীয় বইয়ের অবাধ বাজারও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে কিংবদন্তির জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, কাজী আনোয়ার হোসেন তাঁকে কীভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন।

তিনি পশ্চিমের বিভিন্ন ভাষার কালজয়ী সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ করেছেন। বাংলা অনুবাদ সাহিত্যেও তিনি অদ্বিতীয়। তাঁর মতো স্মার্ট গদ্য খুব কম লেখকই লিখেছেন। গল্প-উপন্যাসে চরিত্রাবলির সংলাপ কিংবা বর্ণনার বাক্যগঠনে তিনি নিজস্ব রীতি সৃষ্টি করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে বহু লেখককে প্রভাবিত করেছে।

‘মাসুদ রানা’ সিরিজে বইয়ের সংখ্যা পাঁচ শর মতো। এর ভেতর প্রথম দুটি তাঁর মৌলিক রচনা, পরেরগুলো ইয়ান ফ্লেমিং, জেমস হেডলি চেজ, অ্যালিস্টার ম্যাকলিন, ডেসম-ব্যগলি, নিক কার্টার প্রমুখ জনপ্রিয় থ্রিলার লেখকদের বিভিন্ন কাহিনি অবলম্বনে লেখা। একই বইয়ের জন্য তিনি একাধিক পশ্চিমা থ্রিলারের সাহায্য নিয়েছেন। তবে নায়ক মাসুদ রানা কিংবা সিরিজের অন্যান্য প্রধান চরিত্র—জেনারেল রাহাত খান, কবীর চৌধুরী, সোনিয়া, গিল্টি মিয়া ইত্যাদি একান্তই তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি। কাহিনির দেশীয়করণে তিনি অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। সিরিজের প্রথম বই ধ্বংস পাহাড় লেখার আগে কাহিনির পটভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার মোটরসাইকেলে চষে বেড়িয়েছেন। তাঁর রোমাঞ্চকর এই ভ্রমণের বর্ণনা শুনে মুগ্ধ হয়ে নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড় লেখার সময় না দেখেই আমার প্রথম কিশোর রহস্য উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে কক্সবাজারকে বেছে নিয়েছিলাম।

‘মাসুদ রানা’ প্রথম থেকেই পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কাজী আনোয়ার হোসেন ভেবেছিলেন, বছরে একটা ‘রানা’ সিরিজ, একটা ‘কুয়াশা’ সিরিজ এবং অন্যান্য বই লিখবেন। ‘রানা’র অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তায় প্রথম দিকে কখনো তিন মাসে, কখনো চার মাসেও ‘মাসুদ রানা’র নতুন বই লিখতে হয়েছে। পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে শ্রম লাঘবের জন্য তাঁকে লেখক ভাড়া করতে হয়েছে এবং কাহিনির নতুনত্বের জন্য পশ্চিমা স্পাই থ্রিলার লেখকদের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। পশ্চিমের অনেক জনপ্রিয় লেখকের ‘গোস্ট রাইটার’ থাকে।

বাংলা রোমাঞ্চ-রহস্য-গোয়েন্দা সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিদেশি সাহিত্য অবলম্বন করে লেখা অভিনব কোনো বিষয় নয়। আমাদের গোয়েন্দা ও রহস্য সাহিত্যের পথিকৃৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর দীনেন্দ্রকুমার রায়, জগদানন্দ রায়, পাঁচকড়ি দে কিংবা হেমেন্দ্র কুমার রায়ের অনেক রচনাই বিষয়ের ক্ষেত্রে পশ্চিমা গোয়েন্দা সাহিত্যের শরণ নিয়েছে। এদের ভেতর সবচেয়ে জনপ্রিয় দীনেন্দ্রকুমার রায় (১৮৬৯—১৯৪৩) তাঁর ‘রহস্য লহরী’ সিরিজের গোয়েন্দা রবার্ট ব্লেককে সৃষ্টি করেছিলেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা সিরিজ সেক্সটন ব্লেক সিরিজের নায়কের আদলে, যে সিরিজের লেখকসংখ্যা এক ডজনের বেশি।

কাজী আনোয়ার হোসেনের জোগান দেওয়া কাহিনির ওপর ভিত্তি করে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের বই লিখেছেন শাহাদত চৌধুরী, শেখ আবদুর রহমান, রাহাত খান, কাজী মাহবুব হোসেন, শেখ আবদুল হাকিম এবং আরও অনেকে। এঁদের লেখার পর পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ পরিমার্জন করতেন ‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন। ভিন্ন ভিন্ন লেখকের ভাষারীতির তারতম্য যা থাকত, মূল লেখক সেগুলো ঘুচিয়ে দিতেন। যে কারণে পাঠকদের পক্ষে কখনো জানা সম্ভব হতো না, কাজী আনোয়ার হোসেন ছাড়া অন্য কেউ ‘মাসুদ রানা’ লিখেছেন।

শেষ জীবনে তাঁর বিরুদ্ধে ‘মাসুদ রানা’র একজন গোস্ট রাইটার বা ‘চুক্তিবদ্ধ লেখক’ শেখ আবদুল হাকিমের কপিরাইট মামলা তাঁকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল। ১৯৯২ সালে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ করার কারণে সাপ্তাহিক বিচিত্রার নির্বাহী সম্পাদকের পদ থেকে আমাকে বরখাস্ত করার পর মতিঝিল, সেগুনবাগিচা এলাকায় যাওয়ার তাগিদ কমে গিয়েছিল। আনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগও ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। তবে পত্রিকায় তাঁর বিরুদ্ধে শেখ আবদুল হাকিমের মামলার খবর শুনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে কাজী আনোয়ার হোসেনকে ফোন করে জানিয়েছিলাম, প্রয়োজন হলে আমি তাঁর পক্ষে আদালতে সাক্ষ্য দেব—‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা তিনি ছাড়া আর কেউ নন। অন্তমুর্খী কাজী আনোয়ার হোসেন এই মামলায় ব্যথিত হলেও খুব একটা উচ্চবাচ্য করেননি।

‘মাসুদ রানা’র লেখক হিসেবে কাজী আনোয়ার হোসেনের পর যিনি সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন, তিনি বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী। যত দূর মনে পড়ে, তিনি এই সিরিজের ছয়-সাতটা বই লিখেছিলেন। রাহাত খানের মতো বিশিষ্ট লেখকও ‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের বই লিখেছেন। তাঁরা কেউ, এমনকি হাকিমের অগ্রজ শেখ আবদুর রহমানও কখনো দাবি করেননি—‘মাসুদ রানা’র লেখক তাঁরা বা লেখকস্বত্ব তাঁদের।

‘মাসুদ রানা’র আগে বাংলা রহস্য সাহিত্যে ‘গোয়েন্দা’ বা ‘ডিটেকটিভ’ অনেক থাকলেও ‘গুপ্তচর’ বা ‘স্পাই’ বলতে যা বোঝায়, তেমন চরিত্র ছিল না। ‘মাসুদ রানা’ই বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল গুপ্তচর নায়ক—দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে দুঃসাহসী অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়তে যে এতটুকু ইতস্তত করে না। ব্যক্তিগত জীবনে রানা একজন নিঃসঙ্গ মানুষ, যেমনটি ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। মাসুদ রানাকে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর স্বপ্নপুরুষ হিসেবে। চরিত্রটি ইয়ান ফ্লেমিং বা অ্যালিস্টার ম্যাকলিনের নায়কদের মতো দুঃসাহসী অভিযানে অংশ নিয়েছে বটে, তবে সে আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক বাঙালি। এ কারণেই তরুণ পাঠকেরা ‘মাসুদ রানা’ পড়ে নিজেদের একেকজন রানা ভাবতে পেরেছেন। ষাটের দশকের অনেক তরুণ ‘মাসুদ রানা’ পড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী হয়েছেন—এটি বলা অতিরঞ্জন হবে না।

১৯৭০ সালে কাজী আনোয়ার হোসেন রহস্য পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করে আমার মতো এক তরুণকে সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মূল সম্পাদক হিসেবে তাঁর নামই অবশ্য ছাপা হতো। সে সময় রহস্য পত্রিকা ছিল তরুণ লেখক ও শিল্পীদের প্রধান আড্ডাস্থল। হাশেম খান, রাহাত খান, শাহাদত চৌধুরী, রফিকুন নবী, আবু কায়সার, শেখ আবদুর রহমান, আলী ইমাম, মুনতাসীর মামুন—কে না এসেছেন সেই আড্ডায়, যাঁর মধ্যমণি কাজী আনোয়ার হোসেন। তিনি বলতেন কম, শুনতেন বেশি। ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণ শুনে রহস্য পত্রিকার অফিসে এসে সবাই কীভাবে তুমুল আড্ডায় মেতে উঠে বঙ্গবন্ধুকে এ পত্রিকার প্রচ্ছদে আনার পরিকল্পনা করেছিলাম, সে কাহিনি অন্যত্র লিখেছি।

কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’ দেশের তরুণদের যুগ যুগ ধরে গ্রন্থপাঠ ও দেশপ্রেমে যেভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে, বিশ্বসাহিত্যের অনন্য অনুবাদের মাধ্যমে তিনি আমাদের সাহিত্যের এই অবহেলিত ধারাকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন, মরণোত্তর হলেও এ বছরের স্বাধীনতা পদক তাঁকে প্রদানের দাবি জানাব।