বাবার সঙ্গে আমি

আমার বাবার দাঁতগুলো নিয়ে ছিল সমস্যা। সেই ছোট্টটি কাল থেকে প্রায় প্রতি মাসেই দেখেছি তাঁকে দাঁতের ব্যথায় কাতরাতে। তার পরবর্তী চার-পাঁচ দিন অবধারিত ছিল বিকেলের পরে দাঁতের ডাক্তার আর সন্ধ্যায় এক পাশ ফিরে শুয়ে থাকা। বাবার নেওটা ছিলেম বলে এসব আমার একদম পছন্দ হতো না। সন্ধ্যাটা আমাদের একত্রে কাটানোর কথা। রাগ হতো, বাবা কেন সব দাঁত ফেলে দেন না। তবে পাঁচ দিন পর সুস্থ হয়ে বাবা যখন স্কুল থেকে আনার পথে নিউমার্কেটের জিনাত বুক শপে নিয়ে এই বই সেই বই কিনে দিতেন আমাকে, রাগটা কমে যেত। কিন্তু দাঁতের ব্যথা কমার পর থেকেই শুরু হতো বাবার তদারকি। আমি ঠিকমতো দাঁত মাজলাম কি না। ঘুমুতে যাবার আগে আর সকালে উঠেই তাঁর প্রথম কথা, ‘আমি আর বড় ভাই দাঁতের যত্ন নিইনি, তাই আজকে আমার এই অবস্থা, আব্বু দাঁত মেজেছে?’ আরও ছোট্টটি যখন ছিলাম, আমার এলোমেলো দাঁতগুলো প্রতিদিন নিয়ম করে টিপে দিতেন তিনি। এত বছর পরও ডাক্তার যখন আমার দাঁত দেখেন, বলেন, আপনার বাবার মতো বাবা তো বিরল, আপনার দাঁতটাও তিনি তদারক করতেন!
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে সারা দেশই চেনে। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে এই ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তেই তো তিনি দেশের মানুষের অন্তর–চোখকে নান্দনিকতার দিকে নির্দেশিত করেছেন। তাঁর কাজের ব্যাপ্তিও সবার জানা। কিন্তু এই দেশের প্রতি তাঁর ‘কমিটমেন্ট’-এর উৎস-উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবনাটা বোধ হয় প্রয়োজনীয়। আমার বাবা গোটা দেশটাকে তাঁর পরিবার ভাবতেন। আর তাই পরিবারের সব সদস্য—তিনি যে আত্মপরিচয়েই পরিচিত হোন না কেন, বাবার কাছ থেকে তাঁরা কেউ ‘না’ শোনেননি। একটু আগে বলা আমার দাঁতের গল্পের ‘আমার’ মতোই এই দেশের প্রায় প্রত্যেক মানুষেরই মননের ‘দাঁত টিপে’ দেওয়ার কাজটি অতি একান্তভাবেই করতে চেয়েছিলেন তিনি। একটি পরিপূর্ণ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজের মধ্যে থেকে, তাঁর দর্শনটিকে হাজার মানুষের কাছে বলে এবং আরেকটি না-বলা কথার কষ্ট দিয়ে আমার বাবা চলে গেলেন। তাঁর জন্ম তো আর আমি দেখতে পেতাম না, তবে মৃত্যুটা হাজার মানুষের সঙ্গে সঙ্গে আমিও দেখলাম। লুকিয়ে মৃত্যু তাঁর সইত না, তাঁর পরিবারটি তো অনেক বড়! তাই সবার সামনেই চলে গেলেন তিনি। ভাবতে চোখে জল আসে, তবু ভাবি, আমার বাবার চাইতে ভালোভাবে আর কয়জন যেতে পেরেছেন?
বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক পিতা-পুত্রের স্নেহ ভালোবাসা কিংবা বন্ধুত্বের শুধু নয়, যুগপৎভাবে এটি শিক্ষক-ছাত্রের, গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক। বাবা আমাকে তাঁর চোখ বলতেন। বিদেশে থাকতাম আমি। প্রতিদিন সকাল কি রাতে বাবার সঙ্গে ঘণ্টা খানেক কথা না বলে আমার খুব কম দিনই কেটেছে।
বাবা আমায় কী বলতেন? তাঁর প্রথম কথাটি ছিল, আজ কী দেখলে? এখন কোন শিল্পী কী কাজ করছেন? ওই ছবিটা দেখেছ? নতুন গ্যালারিগুলোতে কী চলছে? ওই লেখাটা পড়েছ? পড়ে একটু জানাও তো! আইপ্যাডে হাত ঘষে ঘষে নানা ওয়েবসাইট ঘুরে বাবা প্রতিদিন খবর বের করে আমাকে বলতেন, ‘জেনে আসো, রাতে কথা বলব।’ আমার গবেষণার কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁর সঙ্গে আমার এসব কথা চলত।
বাবা চাইতেন, শিল্পকে আমি নিজের মতো ভালোবাসি এবং আমাকে বলা তাঁর শেষ কথাটিও ছিল এ-সংক্রান্তই। বেঙ্গল-এর অনুষ্ঠানে আমার পাশে বসে ছিলেন; হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘এই, তোমার লেখাটা হাসনাতকে (কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত) দাওনি এখনো?’ আমি বললাম, ‘কাল দিয়ে দেব’। এ-ই আমাদের শেষ কথা। বাবা-ছেলের স্বাভাবিক বৈষয়িক সম্পর্কের চেয়েও গুরু-শিষ্যের এই অভূতপূর্ব সম্পর্কটি যে কত বিরল, তা আমি জানি। আর তাই একা চলে গিয়ে বাবা যেন আমায় কূলহারা নাবিক করে দিলেন।
সেই ছোট্টবেলা থেকে সবকিছুতেই বাবার সঙ্গে আমি। বড় বড় মানুষের পার্টিতে আমাকে না নিয়ে যেতেন না বাবা-মা। আমাদের ডাইহাটসু গাড়িতে পেছনের সিটে বসে মনু মামার (গাজী শাহাবুদ্দীন) বাড়ি যেতাম—কত কত লেখক, শিল্পী, রসিকের মধ্যে বসে, বুঝে না-বুঝে সময় কাটিয়ে অনেক রাতে সেই ডাইহাটসুর পেছনের সিটে শুয়ে শুয়ে ফিরতাম বাড়িতে। যে দিনগুলোতে আমার যাওয়ার নিয়ম ছিল না, সে দিনগুলো ছিল আমার ক্রন্দনরজনী। তবে পরদিনের পুরস্কার ছিল নতুন বই। বাবার বন্ধুদের মাঝখানে সময় কাটিয়েছি বলেই, তাঁরা কেউ আমার মামা-খালা, কেউ চাচা-কাকা। আজ অবাক হয়ে ভাবি, বাংলাদেশের অনেক বড় বড় লেখক-কবি-শিল্পী-বিজ্ঞানীকে ‘তুমি’ সম্বোধন করি এখনো আমি। অনেক চেষ্টায়ও ‘আপনি’ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারি না। এই যে নিজের ভেতরের পরিবারটিকে বাইরের বৃহৎ পরিবারের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলতে পারা এবং দুটোকেই সমানভাবে প্রতিপালন করা—আমার বাবার এই গুণটি তো খুবই বিরল। নিজের পুত্রকে নানাভাবে নানা মানুষের সান্নিধ্যে রেখে যে চোখ খুলে দেওয়ার চেষ্টা তিনি করতেন, তা তাঁর গুরু-শিষ্যের পরোক্ষ প্রকাশই বটে।
মাঝেমধ্যেই সময়মতো আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে পারতেন না বাবা। কিন্তু আমাকে একা বাড়ি যেতেও দেবেন না তিনি। তাই ছোটবেলায় প্রায় প্রতিদিনই আর্ট ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টরের ফোনে দুপুর দুটোয় ফোন করতাম, আমাদের প্রধান শিক্ষকের অফিস থেকে। আধা ঘণ্টা দেরি হলেই আমার টেনশন-কান্না, বাবার কিছু হলো না তো? এসব দেখেই আমার অন্যায় আবদারগুলো মেনে নিতেন আমাদের প্রধান শিক্ষক। কখনো-সখনো আবার বাবার সঙ্গেই আর্ট ইনস্টিটিউটে (বর্তমান ফ্যাকাল্টি অব ফাইন আর্টস) দুপুরটা কাটাতাম গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের করিডর কিংবা পরিচালকের ঘরের চারপাশ ঘেরা বারান্দা দিয়ে হেঁটে বেড়িয়ে। গাছের পাতা, পাখি, মানুষ দেখে, ওখানকার শিক্ষক-ছাত্রদের গুরুগম্ভীর কথা শুনেটুনে বাবা আর আমি বাড়ি ফিরতাম গান গাইতে গাইতে, ‘অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি বিচার দিনের স্বামী’, কিংবা ‘অল্প লইয়া থাকি তাই...’।
বাবা যে কত কাজ করতেন, কত লোকের সঙ্গে মিশতেন, কত কিছুতে জড়াতেন, তবু আমাকে সময় দেবার কাজটিতে কোনো ঘাটতি তিনি রাখতেন না। বরং বলব, আমাকে এমনভাবে স্কুলের অনেক পড়ার হাত থেকে তিনি বাঁচিয়েছেন। সেই ছোট্টবেলাতেই বলতেন, ‘ইচ্ছে না হলে পড়ো না।’
সহজ পাঠ দিয়ে শুরু হয়েছিল আমার। তারপর রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি শিক্ষা আর বিদেশ থেকে বের হওয়া ইংরেজিতে লেখা বিজ্ঞানের বই। প্রতিদিন আমার কাজ ছিল এসব পড়া। বাবা বসে বসে সময় দিয়ে পড়াতেন আমায়। আমি আর বাবা এক টেবিলেই কাজ করতাম, আমাদের খাবার টেবিলে। এক পাশে আমি অন্য পাশে তিনি। মাঝেমধ্যে আসতেন শামসুল হক (বর্তমানে প্রথম আলোয় কর্মরত) ভাই। বাবা যতক্ষণ কাজ করছেন, ছেলেও ততক্ষণ পড়ছে-লিখছে-আঁকছে। আমার ছোট্টবেলায় বাবা কখনো আমায় এটা
করো সেটা করো বলেননি; বরং পাশে বসে তাঁর কাজের সঙ্গী করে আমার নিজের কাজে আগ্রহী করেছেন। এতে আমার মা আর মামা-খালাদেরও বেশ অবদান ছিল বটে, তবে এ লেখায় আমি বাবার কথাই বলছি বলে ওগুলো অনুল্লেখ্য রাখলাম।
আমার বড় হওয়ার পরিবেশটা শিল্পকলা, সিনেমা, গানে যতটা ভরপুর ছিল, ঠিক ততটা ভরাট ছিল বিজ্ঞান-গণিতে। বাবা নানা বিজ্ঞানের বই এনে দিতেন, রাতের অন্ধকারে তারা পরিচিতি হাতে ছাদে পাঠাতেন আকাশে আগ্রহী করে তুলতে। একবার রাশিয়া থেকে ফেরার সময় বাবা ফোনে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমার জন্য কী আনব?’ আমি বললাম ‘টেলিস্কোপ’। বাবা আনলেন মাইক্রোস্কোপ। আমার তো প্রচণ্ড রাগ। শেষে তিনি বললেন, ‘তুমি তো রাতে তারা দেখতেই পাও, এবার এই যন্ত্র দিয়ে দেখো পানির মধ্যে কত জীব-জীবাণু আছে!’ আমার স্কুলে আমি কোনো দিন এই যন্ত্রের ব্যবহার করেছি কি না জানি না, তবে বাড়িতে আমার শিল্পী-বাবার কল্যাণে এ যন্ত্রটি আমার খেলার সাথি হয়েছিল। বাবার ছিল এই গুণ। কখনো শিখতে পড়তে বলতেন না, বরং পরোক্ষভাবে শেখার প্রতি আগ্রহী করে তুলতেন। সেই ছোটবেলা থেকে মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত আমাকে তিনি এভাবেই বড় করেছেন। মাঝেমধ্যে ভাবতাম, এই মানুষটিকে ছাড়া তো আমি অচল। এখন এই লিখতে গিয়ে বুঝছি, এমনটি আমার খটমটে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধটিও যাঁকে প্রথম পড়িয়ে নিতাম, আজকেই এই অক্ষম লেখাটিকে তো তাঁকে পড়াতে পারব না—আমার অচলাবস্থার এই তো বুঝি শুরু।
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পীজীবন নিয়ে এ নিবন্ধ নয়। এটি একটি অসাধারণ বাবার সাধারণ সন্তানের কালিঘর মাত্র। তবে একটি কথা আমি হলফ করে বলতে পারি, শুধু আমি নই, আমার বাবার সংস্পর্শে যাঁরাই এসেছেন, তাঁরা সবাই আমার এই জীবনঘটনার সঙ্গে অনেকাংশেই একাত্ম হতে পারবেন। এর কারণ বাবা ঘরেবাইরে সবার জন্যই এমনই আন্তরিক ছিলেন। তিনি কত বিষয়ে কত জানতেন, এই বয়সেও কত জানতে চাইতেন, কত কিছু করতে চাইতেন, তা আমি যত জানি, তাঁর সান্নিধ্যের অনেকেও ততটুকুই জানেন। জীবনে শিল্পকে যতটুকু বশ মানিয়েছিলেন তিনি, তার চেয়ে বেশি ধারণ করেছিলেন শিল্পদর্শনকে। শিল্পপথে, তাঁর সহযোগী ছিল বাংলার লোককলা থেকে উৎসারিত গড়ন-গঠন-রং; তবে শিল্পবোধ তিনি শাণিয়েছেন বিশ্বব্যাপী ছড়ান নানা উপকরণ থেকে নির্যাস নিয়ে। অনেকেই প্রয়াস চালান এই প্রক্রিয়ায় নতুন কিছু করার। কাইয়ুম চৌধুরী বাংলাদেশের মানুষকে দেখিয়েছেন, লেগে থাকলে, শিল্পদর্শনকে ধারণ করতে পারলে, শিল্পের মধ্যে বসবাস করতে পারলে সেটি সম্ভব। তবে সবচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন তা হলো, মানুষকে আপন ভাবতে শেখা। নিজের পরিবারের মধ্যে বিশ্বব্যাপী যে-ই চাইবে তাকেই গ্রহণ করতে শেখা—কোনো মানুষ, শিল্প, জ্ঞান, বিশ্বাসকে ভিনদেশি/ভিনগ্রহী ভাবতে না শেখা।
সবাই তাঁর পরিবারের বলে হাজার মানুষের ভিড়েই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। তাঁর এই রাজকীয় প্রস্থান যেকোনো মানুষের জন্য লোভনীয়, তবে সকলের জন্য এটি শিক্ষণীয়ও বটে। কাইয়ুম চৌধুরী যেন যাবার বেলায় বলে গেলেন, মৃত্যুকোলে ঢলে পড়া আমার দিকে ছুটে আসা আমার সন্তানের মতো এই মঞ্চপাশে উদ্বিগ্ন সবাই তাঁর পরিবার।
পরিবারকে তিনি অকাতরে বেসেছেন ভালো। আর তাই আমার কান্নার জল হাজার হাজার মানুষের চোখের জলের সঙ্গে মিশেই গেল। ভাবতে ভালো লাগে, আমার বাবা আরও অনেকেরই অভিভাবক ছিলেন। আমি হারিয়েছি আমার ‘আব্বুকে’, দেশ হারাল তার ‘কাইয়ুম ভাইকে’।
লেখক: কাইয়ুম চৌধুরীর ছেলে