‘বিদ্রোহী’র শতবর্ষ, জাগরণের শতবর্ষ

২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। এ বছর নজরুলের বাংলা কাঁপানো কবিতা ‘বিদ্রোহী’ রচনার শতবর্ষ। তাঁর জয়ন্তী উপলক্ষে এই যুগান্তকারী কবিতার দিকে ফিরে দেখা।

কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার শতবর্ষ পূরণের এই বছরে আমরা যদি এর সৃষ্টি-উৎসের দিকে তাকাই, তাহলে অনেকগুলো তাৎপর্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাতে এক বৈঠকে রচিত হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের বিপুল প্রভাববিস্তারী এই কবিতা। নজরুল তখন মাত্র ২২ বছরের যুবক। সেনাবাহিনীর কর্ম শেষে কলকাতায় ফিরেছেন দুই বছরও হয়নি। ১৯২০-এর মার্চে কলকাতায় ফেরার পর বিপুল উদ্যমে তারুণ্যের তুমুল আবেগ-উচ্ছ্বাস নিয়ে তখন তিনি সাহিত্য সৃষ্টিতে আকণ্ঠ নিমগ্ন। সমানে লিখে চলেছেন গল্প-উপন্যাস-কবিতা-গান ও প্রবন্ধ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনা হলো: গল্প ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘রাক্ষসী’; উপন্যাস বাঁধনহারা; কবিতা ‘শাত-ইল-আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহররম’, ‘আগমনী’, ‘রণভেরী’, ‘আনোয়ার’, ‘কামাল পাশা’ প্রভৃতি। তবে এ সবকিছুকে ছাড়িয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ঘটেছিল তাঁর কবিত্বশক্তির সর্বোত্তম প্রকাশ। বিভিন্ন পুরাণের নির্যাসকে এ কবিতায় যে অসীম দক্ষতায় সৃষ্টিশীলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। যুদ্ধফেরত এই যুবকের মনে তখন প্রবলভাবে বহমান উপনিবেশবাদের শোষণ ও সাম্প্রদায়িক বিভেদনাশী এক সুগভীর প্রতিবাদী চেতনা।

কবির নিরাশ্রয়ী জীবনে তখন অন্যতম সহায় সমাজতন্ত্রী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ মুজফফর আহমদ (১৮৮৯-১৯৭৩)। তাঁরই হাত ধরে সংযুক্ত ও নিবিষ্ট হন সাংবাদিকতায়ও। বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিবেশে জনমানসে সে সময় ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রবল। ১৯২০-এর সেপ্টেম্বরে কলকাতায় ভারতীয় কংগ্রেসের যে অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়, তাতে সাংবাদিক হিসেবে এই দুজনই ছিলেন উপস্থিত। অতঃপর অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের যৌথতায় স্বরাজের দাবিতে যখন প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সারা ভারত, তখন কবিও তার সঙ্গে একান্তভাবে একাত্ম, মিছিলে সক্রিয়। ‘বিদ্রোহী’ রচনার মাসটিতেই গ্রেপ্তার হন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ; তাঁর পত্রিকার জন্য পরের মাসেই এক বৈঠকে লিখে ফেলেন সাড়াজাগানো সংগীত ‘ভাঙার গান’ [কারার ঐ লৌহ কপাট]। অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেই সাম্রাজ্যগ্রাসী ইউরোপের ধনলোভী উন্মাদনার বিপরীতে সংঘটিত হয় রুশ বিপ্লবের মতো শোষণমুক্তির দুনিয়াকাঁপানো ঘটনা। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার সমসময়ে মস্কো থেকে প্রেরিত এম এন রায়ের দূতের সঙ্গে মুজফফর আহমদ ও তাঁর একান্ত সাক্ষাৎ ঘটে। ‘বিদ্রোহী’ রচনার মাসটিতেই মুজফফর আহমদ ও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা নজরুলকে সঙ্গে নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কথা ভাবেন। নজরুল অবশ্য পার্টিতে সক্রিয় হননি; তবে বৈপ্লবিক সমাজ রূপান্তরের চেতনায় ছিলেন দারুণভাবে আন্দোলিত ও উজ্জীবিত।

একনজরে ‘বিদ্রোহী’

  • ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এক বৈঠকে লেখা

  • নজরুলের বয়স তখন ২২ বছর

  • ১৯২২ সালের জানুয়ারিতে প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক বিজলী ও মাসিক মোসলেম ভারত-

  • ওই জানুয়ারিতেই পুনর্মুদ্রিত হয় প্রবাসীর মাঘ সংখ্যায় এবং সাধনার বৈশাখ সংখ্যায় (এপ্রিল ১৯২২)

এই ছিল সমসময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক উত্তাল পটভূমি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনবোধ ও জীবনাচারের কিছু মহিমান্বিত বৈশিষ্ট্য। যথার্থ অর্থেই তিনি ছিলেন সর্বহারা, ‘কলমপেষা মজুর’; তাঁর ছিল না কোনো পিছুটান তথা মধ্যবিত্তসুলভ দ্বিধার দোলাচলতা। বরং বেপরোয়া যৌবনের বিপুলতম উদ্দামতা নিয়ে শোষণ-পীড়ন-বঞ্চনা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে সততাতাড়িত প্রতিবাদে তিনি ছিলেন দুঃসাহসী, পরিণামভয়শূন্য। শাসক-শোষক আর ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে তীব্র প্রাণাবেগময় দ্রোহের কথাই উচ্চ কণ্ঠে ব্যক্ত হয়েছে এই কবিতায়। ফলে তা বিপুলভাবে পাঠকচিত্তকে আকৃষ্ট করেছে। সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় ১৯২২-এর ৬ জানুয়ারি প্রকাশের সমসময়েই কবিতাটি বের হয় মাসিক মোসলেম ভারত-এ (এটি ১৯২১-এর কার্তিক সংখ্যা হলেও বের হয় জানুয়ারির প্রথমার্ধে); কবিতাটির জনপ্রিয়তার কারণে বিজলী পত্রিকার ওই সংখ্যা দুবার ছাপতে হয়। এ ছাড়া কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয় ওই জানুয়ারিতেই প্রবাসীর মাঘ সংখ্যায় এবং সাধনার বৈশাখ সংখ্যায় (এপ্রিল ১৯২২)।

‘বিদ্রোহী’র এই তুমুল জনপ্রিয়তার কারণ, সমকালীন মুক্তি-আকাঙ্ক্ষী মানুষের প্রতিবাদী আবেগকে তা যথার্থভাবে ধারণ করেছিল। আর এতে প্রতিফলিত হয়েছিল নজরুলের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিভার সর্বময় দীপ্তি। নজরুল-প্রতিভার মৌল প্রবণতা তথা প্রাণভোমরারও উৎসবিন্দু হয়ে আছে এ কবিতা। বিপুল প্রাণাবেগে উচ্ছল যৌবনদীপ্ত বাসনার প্রাবল্যে এর প্রতিটি উচ্চারণ হয়ে উঠেছে গভীর আবেদনবাহী, চিত্তাকর্ষী ও নির্ভীকতার ইঙ্গিতবাহী। তাঁর শিল্পীসত্তার মৌল প্রবণতা হিসেবে রোমান্টিকতার দুই প্রধান প্রান্তও এখানে উচ্চকিত হয়ে আছে। প্রতিনিধিত্বশীল একটি পঙ্‌ক্তি: ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণ-তূর্য!’ পৌরাণিক কৃষ্ণের দুই রূপ হলেও তা ধারণ করে আছে রোমান্টিসিজমেরও দুই বৈশিষ্ট্য; প্রণয় আর মুক্তিকামী সংগ্রাম। এতে চিত্রিত ও আবিষ্কৃত হয়েছে ইউরোপের রেনেসাঁ-উদ্ভূত প্রবল পরাক্রমশালী মানুষেরই শক্তিমান রূপ, তার বীরত্বব্যঞ্জকতা: ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!’ এই শক্তিকে তিনি খুঁজেছেন পৌরাণিক আবহে; শুধু ভারতীয় পুরাণের মধ্যে নয়, তাঁর আরাধ্য হয়েছে পশ্চিম এশীয় ও গ্রিক পুরাণও। এটা তাঁর শিল্পীসত্তারও এক মৌল বৈশিষ্ট্য, অদম্য ও অপরাহত শক্তির দিক। এই ত্রিমাত্রিক ভারতীয়, পশ্চিম এশীয় ও ইউরোপীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করেই তাঁর প্রতিভা পূর্ণায়ত হয়ে উঠেছে। তিনি মানুষের মধ্যেকার শুভবোধতাড়িত শক্তির সন্ধান করেছেন আর সেই শক্তির সব কল্যাণকর উপাদান একত্র করে তীব্রভাবে আঘাত করেছেন ক্ষমতাকাঠামোর শোষণপ্রবণতার অশুভকর অপশক্তির বিরুদ্ধে। বিপ্লব, শোষণমুক্তি আর স্বাধীনতার চেতনাবাহী কবিতার প্রকৃত রূপ কী হতে পারে বাংলায় তার একটি অনন্য মৌলিক স্বরবাহী দৃষ্টান্তও এ কবিতার মাধ্যমে তিনি উপস্থাপন করেন। উপনিবেশবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে, তাদের অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে কবিতার ভাষায় এমন বাঙ্‌ময় ও স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল অভূতপূর্ব। বাংলা কবিতার পাঠকদের কাছে এ ভাষা আর এ কণ্ঠস্বর নতুন; কালের স্পন্দনকে ধারণ করেও তা কালান্তরী। ফলে বাংলা কবিতার ভাষা বদলেও এ কবিতা পালন করে এক অমোঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

কবিতার শিরোনামটি তাঁর নামের সঙ্গে উপাধি হিসেবে স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়ে তাঁর পরিচয়কে বিশেষভাবে অর্থবহ করে তোলে। এই কবিতার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তাঁর আসনও নিশ্চিত হয়ে যায়। শুধু নিজের আসন নয়, সেই সঙ্গে বাংলা সাহিত্য পরিমণ্ডলে তিনি একটি পুরো সম্প্রদায়ের আগমনকেও নিষ্কণ্টক ও অবাধ করে তোলেন। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ১৯২১ সালের কথা ধরলে, দেড় শ বছরের অধিককালের উপনিবেশবাদী শাসন বাঙালি মুসলমানকে করে তুলেছিল শোষণ-বঞ্চনা-অত্যাচার-নিপীড়নে সীমাহীনভাবে কাতর ও অধঃপতিত। সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও সংখ্যালঘুর অমর্যাদা নিয়ে তাকে জীবন নির্বাহ করতে হতো। সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি সর্বত্রই তার অবস্থান ছিল নিম্নবর্গের, ব্রাত্যের, ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে দূরের। এই সমাজ থেকে লেখক হিসেবে যাদেরই আগমন ঘটেছে, বাংলা সাহিত্যের মূল আসরে তাদের আসন মেলেনি। এ ক্ষেত্রে ভাষাও একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসনের অনুকূলতায় উনিশ শতকজুড়ে বাংলা ভাষার লেখ্যরূপে যে সংস্কৃতায়ন ঘটে, তা বাঙালি মুসলমানকে সাহিত্যের মূল স্রোত থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অব্যর্থ ভূমিকা পালন করে। নজরুল তাঁর তারুণ্যের উদ্দামতা দিয়ে, চিন্তার বৈশ্বিক ঔদার্য দিয়ে, অসাম্প্রদায়িকতার আন্তরিকতা দিয়ে, মানবিকতার বিশ্বপ্রসারিত দৃষ্টিকোণ দিয়ে—সর্বোপরি স্বকীয় ভাষাভঙ্গি দিয়ে নিঃসংকোচে বাংলা সাহিত্যের মূল আসরে গিয়ে নিজ শক্তিবলেই আসন করে নেন। কারও আহ্বানের অপেক্ষা তাঁকে করতে হয়নি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ভূমিকা এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।

ওই যে স্বকীয় ভাষাভঙ্গির কথা বললাম, আরবি-ফারসি শব্দগুচ্ছের সৃষ্টিশীল প্রয়োগে যা প্রাণময় ও গতিশীল, সেটি তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আয়ত্ত করেছেন নিজ সমাজ-শ্রেণি আর পরিপার্শ্ব থেকে। শুধু এই কবিতাটিই এর পুরো ক্ষেত্র অবশ্য নয়; বরং সমসাময়িক কালে লেখা অগ্নি-বীণার কবিতাগুচ্ছ এর প্রোজ্জ্বল প্রমাণ। স্মরণীয় যে বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়নের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের অবস্থানও ছিল বাস্তবোচিত, সদ্বিবেচনাপূর্ণ ও কার্যকর। সংস্কৃতের নিগড় থেকে বাংলা ভাষাকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে তাঁকে রীতিমতো তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। তবে নজরুলের নতুন কাব্যভাষা এ ক্ষেত্রে ছিল তাৎপর্যদীপ্ত আরেক মোক্ষম প্রতিবাদ। এই ভাষা তাঁর নিজ সমাজ-শ্রেণির সাহিত্যানুরাগীদের মধ্যকার সংকোচ ও দ্বিধা দূরীকরণেও রেখেছে অসামান্য অবদান। উপনিবেশবাদী শাসন-শোষণে বাঙালি মুসলিম মানসে যে দৈন্য ও হীনম্মন্যতা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল, নজরুলের উদ্দীপ্ত আবির্ভাবে তার অবসান ঘটল। দূর হলো সংকোচপরায়ণ ভীরুস্বভাবের; এভাবে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে দেখা দিল আস্থাশীলতার এক অভূতপূর্ব জাগরণ। এই জাগরণেরও শতবর্ষ পূরণ হয়েছে এবার। সুতরাং একটি কবিতা কী শক্তিধর হতে পারে, তা ভাবলেও বিস্মিত হতে হয়। তার অন্তর্গত কাব্যিক-নান্দনিক আর বিষয়-বৈভবসহ বক্তব্যগত শক্তি তো আছেই, কিন্তু তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভাববিস্তারী শক্তি আরও বিপুল ও ব্যাপক।

এই জাগরণের ক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও বিশাল; সেটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তারও প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে এবার। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১-এর জুলাইয়ে আর ‘বিদ্রোহী’ রচিত হয় ডিসেম্বরে। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত আর সাংস্কৃতিকভাবে নিষ্পিষ্ট একটি সমাজ-শ্রেণির উত্থানে এই বছরটিকে চিহ্নিত করা যায় তার সূচনাবিন্দু হিসেবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে সূচিত হয় মুসলিম সাহিত্য সমাজ তথা ‘শিখা’ গোষ্ঠীর বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন; ৩১ বছরের ব্যবধানে ঘটে ভাষা আন্দোলন, যা জন্ম দেয় ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ও শহীদ মিনারকেন্দ্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির। আর ৫০ বছরের ব্যবধানে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম উড্ডীন হয় একটি স্বাধীন দেশের রক্তখচিত পতাকা; মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হয় একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের প্রতিষ্ঠা, রক্তক্ষয়ী সর্বাত্মক বিজয়; তারও সুবর্ণজয়ন্তী আমরা পালন করছি এ বছর। সবকিছু যেন এক সূত্রে গাঁথা; ওই যে বিদ্রোহ, ওই যে জাগরণ। উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে, শোষণ-অত্যাচার-নির্যাতন আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে, ব্রাত্য বলে বঞ্চিত অবহেলিত নিম্নবর্গের মানুষের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তিকল্পে এ এক অসামান্য বিদ্রোহ, উত্থান ও জাগরণ। এরই আজ শতবর্ষ।

এই শতবর্ষে দাঁড়িয়ে আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করি ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রাসঙ্গিকতা ও তার অম্লান তাৎপর্যের কথা। উপনিবেশবাদের অবসান ঘটলেও বিশ্বায়নের শৃঙ্খল আর ধনতন্ত্রের শোষণ বঞ্চনা অত্যাচার নির্যাতনসহ আর্থসামাজিক বৈষম্য সবকিছুই বলবৎ আছে। ‘অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণে’র তলে ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল’ এই বাংলার আকাশে-বাতাসে আজও প্রতিনিয়ত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। অন্যদিকে মানুষের শক্তির প্রতি, তার বীরত্বের প্রতি অনাস্থাও সমানভাবে অটুট। তাই নজরুলের ভাষায়, শান্ত থাকার অবকাশ মিলছে না। চতুষ্পার্শ্বের প্রতিবাদহীন মেরুদণ্ডহীনতার পরিপ্রেক্ষিতে বিপুলভাবে কাম্য হয়ে উঠেছে ‘উন্নত মম শির’-এর বজ্রদীপ্ত ঘোষণা। শোষণ, পীড়ন আর বৈষম্য থেকে মুক্তির সংকল্প নিয়ে মানুষের অপরিমেয় শক্তির উদ্বোধন ঘটিয়ে নজরুল-কথিত বিদ্রোহের রণে অবতীর্ণ হওয়ার যেন বিকল্প নেই।