
বইয়ের শুরুতেই প্রকৃতিবিদ লেখক দ্বিজেন শর্মা যখন ‘অশোক’গাছের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘ছেলেবেলা থেকেই অশোকগাছ চিনি। আমাদের কয়েক প্রজন্ম কবিরাজ চিকিৎসক। তাই বাড়িতে ছিল নানা জাতের ভেষজ গাছপালা এবং অশোকও। বসন্তে সারা গাছ থোকা থোকা হলুদ-লাল ফুলে ভরে উঠত—যেন জড়োয়া গয়না গায়ে নববধূ। বাতাস ভরে উঠত মধুগন্ধে। ভারি নজরকাড়া সেই দৃশ্য’, মন তখন নিছক একজন প্রকৃতিবিদ নয়, মুহূর্তে প্রকৃতি-প্রেমিক একজন কবির অন্তরঙ্গ সহচর হয়ে ওঠে। এই রকম মনকাড়া ভাষায় ‘ছোট্টপিডিয়া’ সিরিজের অন্তর্গত গাছ শিরোনামের আলোচ্য এ বইয়ে ২৮টি গাছের পরিচয় তুলে ধরেছেন লেখক। বইটি কিশোরদের উপযোগী করে লেখা হলেও বড়দের কাছেও সমান উপভোগ্য। প্রতিটি লেখার ওপর চোখ বুলিয়ে এবং লেখা-সম্পৃক্ত ছবি দেখেই চিনে নেওয়া যায় বর্ণিত গাছটির প্রাথমিক পরিচয়।
প্রবল যান্ত্রিকতার এই কালে, প্রকৃতিকে ধ্বংস করার যজ্ঞ যখন বলতে গেলে সর্বব্যাপী, তখন এই সিরিজের গাছ শিরোনামের বইটি সত্যিই উল্লেখের দাবিদার। দাবিদার এই অর্থে যে বইটি খুবই প্রয়োজনীয়।
এ বইয়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এই যে যে ২৮টি গাছের পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে, তাদের প্রতিটির কোনোটিরই আয়তন এক পৃষ্ঠার বেশি নয়। এবং আমরা অবাক হব এমন কিছু গাছের নাম শুনে, যেগুলোর নামও আমরা, বলতে গেলে, কোনো দিন শুনিনি। অথচ তারা আমাদের চারপাশের চরাচরে কিংবা প্রকৃতির কোথাও না কোথাও আছে। যেমন, ‘কলকে’, ‘ডুলিচাঁপা’, ‘পবনঝাউ’, ‘লাল সোনালু’ প্রভৃতি। এমন সব গাছের পরিচিতি এ বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে যখন পড়ি, মনটা যেন সকালবেলার পরিষ্কার প্রকৃতির মতো ঝলমল করে ওঠে। বিস্মৃত গাছগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে চোখের সামনে।

গাছ
দ্বিজেন শর্মা
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: অশোক কর্মকার
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ডিসেম্বর ২০১৪
৩২ পৃষ্ঠা
দাম ১৫০ টাকা
‘অশ্বত্থ’গাছ সম্পর্কে এত পড়েছি, দেখেছিও একসময় দুচোখ ভরে, তার সম্পর্কে যখন নতুন করে এ বইয়ে পড়ি, মনে হয়, সবকিছু ছেড়েছুড়ে আবার প্রকৃতির উদার কোলে ছুটে যাই। গাছটি সম্পর্কে আমাদের জানাচ্ছেন দ্বিজেন শর্মা, ‘এই সেই বৃক্ষ, যার তলায় বসে গৌতম বোধি লাভ করেন। তাই এর আরেক নাম বোধিবৃদ্ধ এবং এ জন্য এটি বৌদ্ধদের পূজ্য। অশ্বত্থ হিন্দুদের কাছেও পবিত্র।’ আরও জানাচ্ছেন তিনি, ‘এই গাছ দীর্ঘজীবী। শ্রীলঙ্কায় দুই হাজার বছরের বেশি বয়সী একটি অশ্বত্থ আজও বেঁচে আছে।’ পরিশেষে তিনি উল্লেখ করছেন গাছটির জন্মস্থান সম্পর্কে। জানাচ্ছেন, এই গাছ ‘বাংলাদেশে পালিত’।
‘কনকচূড়া’গাছের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে দ্বিজেন শর্মার যে বর্ণনাভঙ্গি, তা সত্যিই অতুলনীয়। তিনি বলছেন, ‘চৈত্র-বৈশাখে আমাদের শহরগুলোতে যে তিন ধরনের গাছ ফুল ফোটানোর পাগলামিতে মেতে ওঠে, তারই একটি এই কনকচূড়া (পেল্টোফরাম)। অন্য দুটি-জারুল ও কৃষ্ণচূড়া।’
ছাতিমগাছের পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক জানাচ্ছেন, ‘ছাতিমকে বিদ্যাবৃক্ষও বলা যায়, এর কাঠ দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ড বানানো হতো। ছাতিমতলায় পাঠশালাও বসত।’ জানাচ্ছেন আরও, ‘গুচ্ছ গুচ্ছ, সরু, লম্বা ফল। ছাল ও দুধকষের ঔষধি গুণ আছে। বীজে চাষ। আফ্রিকা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত ছড়ানো।’
যে ২৮টি গাছের বর্ণনা ধারণ করে এ বই, তার প্রতিটি গাছের সংক্ষিপ্ত বর্ণনাই শুধু নেই এতে, আছে তাদের ছবিও। আছে প্রতিটি গাছের ঔষধি গুণাগুণের বর্ণনা। কোথায় তাদের আদি জন্মস্থান, আছে তার কথা। উল্লেখ করা হয়েছে তাদের বৈজ্ঞানিক নামও। কোন পরিবারভুক্ত কোন গাছ, সে কথা উল্লেখ করতেও ভোলেননি লেখক। এত সংক্ষিপ্ত লেখা, প্রতিটি গাছের বর্ণনা, তারপরও মন ভরে যায়। চেনা-অচেনা গাছগুলোকে নতুন করে চেনা হয়ে যায়। এবং বললে অত্যুক্তি হবে না যে এ বইয়ের প্রতিটি লেখা সজীব ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে দ্বিজেন শর্মার মতো প্রাজ্ঞ প্রকৃতিবিদের লেখনীগুণের কল্যাণে। প্রথমা প্রকাশন ও তার ‘ছোট্টপিডিয়া’ সিরিজ আরও নানা বিষয়কে ধারণ করে সমৃদ্ধ হোক, এই কামনা করি।