ভাগলকান্দির মির্জা বেগের বৃত্তান্ত

.
.

আয়নার দিকে তাকিয়ে খোশ মেজাজে তিনি মৃদু হাসেন। নিপুণ হাতে খেজাব মাখানোর ফলে তাঁর ধূসরিম চুলে এসেছে গাঢ় কৃষ্ণাভ আভা। ভাগলকান্দির সাবেক জমিদার মির্জা আসফ জাহান বেগ ইজিচেয়ারে আয়েশ করে বসলে তাঁর খাসবরদার আদমসুরত মৃদা পরিবেশন করে এক পেয়ালা চা। তিনি দ্বিতীয় বন্ধনীর মতো বাঁকানো মোচে তা দিয়ে তাকে ইশারায় কামরা ত্যাগ করতে বলেন। স্পষ্টত তিনি নিরলে চিন্তাভাবনার উদ্যোগ করছেন। এ সময় চাকর-নকরের উপস্থিতি নিতান্ত বেজরুরি। খাসকামরার পাথরের টেবিলে ফ্রেমে আটকানো তাঁর বেগমদের ছবি। পর্দাপুশিদা বহাল রাখার জন্য ফ্রেমগুলোর আয়নায় পরানো আছে মখমলের নেকাব। মির্জা আলগোছে তা সরান। জিন্দেগিতে তিনি শাদির মসনদ তকিয়াতে হেলান দিয়েছেন মাত্র তিন বার। তাঁর মনের মুরাদ সম্পূর্ণ মেটেনি। পানপাত্রে তলানির মতো আরেক দফা বিবাহিত হওয়ার কিঞ্চিত এরাদা এখনো অবশিষ্ট আছে।
তাঁর প্রথম বেগম সুতরফের সৈয়দ বংশজাত। এ রমণী বিবাহের পর সুচিত্রা সেনের কায়দায় চুল বাঁধতেন। নীরব কিসিমের হলেও এঁনার ব্যক্তিত্ব প্রচুর। রেশমে আনারকলির কিসসা আঁকতে আঁকতে সংসারের তাবৎকিছু নিয়ন্ত্রণের ফন্দি আঁটেন হামেহাল। মারাত্মক মেজাজের মজুফ রিয়াফত ফকিরের তিনি মুরিদ। তাঁর জন্য জুমাবারের রাতে রান্না করেন মাগুর মাছের কোর্মা ও গব্যঘৃত দেওয়া অড়হরের ডাল। অবসরে এ বেগম তাঁর পোষা তিনটি কনি-বগুলাকে মখা মাছ খাওয়াতে পছন্দ করেন।
তাঁর দোসরা বেগম খাস কলকাত্তার মেয়ে। এঁনার পরিবার পার্টিশনের পর বিন্নাবাড়ির আট-আনি অংশের মালিক রায় বাহাদুর নিহার রঞ্জন সেনগুপ্তের সাথে সহায় সম্পত্তি বিনিময় করে এপার বাংলায় হালফিল থিতু হয়েছেন। খানিক পৃথুলা গড়নের এ নারী বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন। শিগগির তাঁর বাতচিত শুনতে পেলে মনে হয় এ আওরাত যেন মির্ণাভা থিয়েটারে নটী কুমুদিনীর সংলাপ আওড়াচ্ছেন। মাঝেমধ্যে ইনি গুনগুনিয়ে গান গীতা দত্তের ‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ...’। আর ডাগর চোখ তুলে খামোখা আসমানে তাকাতাকি করেন। কামকলায় অত্যন্ত পারদর্শী এ গুরু নিতম্বিনীর দেহমনে কখনো কখনো আছর হয় জিন্নে মোমিনের। তখন তিনি ভরদুপুরে জ্বালান বেশুমার মোমবাতি, থেকে থেকে তেলাওয়াত করেন আয়তল কুরছি; এবং পায়েস রান্না করে খেতে দেন জিন কওমের পরহেজগার, তবে অদৃশ্য এক মরদকে।
তাঁর তিসরা বেগমের বয়স অতি অল্প। খানদানি বংশের কন্যা নন তিনি। তবে এঁনার বাবা বিত্তশলী, পিত্তশূলের ওষুধ বানানোর কারখানা আছে। রায়টের পর ওপারে বেফানা হয়ে চলে যাওয়া হিন্দুদের সহায় সম্পত্তি তিনি সস্তায় খরিদ করেছেন। ওপার থেকে তিনি চাপলিশে আমদানি করেন গোদরেজের তালা ও ইঁদুর ধরার কল। চাঁদপুরের ইলিশ বোঙ্গায় বর্ডারে চালান দেওয়ার তেজারতিও তাঁর চলছে রমরমিয়ে। তিসরা—কন্যা হিসেবে খুবই সুলক্ষণা। রাত জেগে শশধর দত্তের দস্যু মোহন পাঠ করা ছাড়া অন্য কোনো বদ অভ্যাস নেই। একহারা গড়নের এ শ্যামার কথা ভাবলে মির্জার শরীর লড়াইয়ের ময়দানে তীরন্দাজের মতো লক্ষভেদী হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু কেন জানি কামিয়াবি হাসিল হয় না। মির্জা নানা প্রকারের তত্ত্বতালাবি করেন। খোদ কলকাত্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে আংরেজি সাহিত্যে সবক নেওয়া লোক তিনি। মাঝ-রাইতে সুইনবর্নের কবিতার বাছা বাছা চরণ ঘুম পাওয়া যুবতীর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে আবৃত্তি করে দেখেছেন। হামদর্দি দাওয়াখানার হেকিমের দেওয়া উদ্দীপক সালসা রুহ আফজা শরবতের সঙ্গে মিশিয়েও খাইয়েছেন, ফায়দা কিছু হয়নি। এতে মির্জার দিলে পয়দা হয়েছে জবরদস্ত রকমের বিরহ। তাতে ফিদা হয়ে তিনি রচনা করেছেন বাংলা ভাষায় সাতটি পদ্য, আংরেজিতে তিনটি সনেট এবং উর্দুতে দুটি রুবাই।
তিন বেগম তিন কিসিমের হলেও একটা ব্যাপারে এঁনাদের তুমুল সাযুজ্য আছে। কলহ-কোন্দল ও হরেক রকমের কাজিয়া-বিবাদে এঁরা সমান পারদর্শী। এবং মির্জাকে নাস্তানাবুদ করার বিষয়ে তাঁরা শুধু একাট্টাই না, রীতিমতো ওয়াদাবদ্ধও। তাই তিনি দিনের বেলা অন্দর মহল পরেজ করে চলেন, পারতপক্ষে ওদিকে পদার্পণ করেন না। বাইরের মহলের এ বাংলাঘরের খাসকামরার নিরাপত্তায় ইজিচেয়ারে বসে বসে দিনযাপন করেন। সময় কাটতে না চাইলে কখনো কখনো মারফি রেডিওতে সংবাদ শোনেন। আজও তিন বেগমের তেরো রকমের লীলালাস্যে তিনি বেহদ জেরবার হয়ে আছেন। তাই নভ টিপে রেডিও চালান। মাগরেবি পাকিস্তান থেকে ভাষ্যকার চুসতি মুজাহিদের জবানিতে তোড়জোড়ে এলান হচ্ছে বিরানব্বই ক ধারা জারি হওয়ার ফলে তেঁতুলিয়া থেকে খাইবার পাস অব্দি সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নের সংবাদ। করাচির তখ্ত এবার পুরোপুরি কবজা করেছেন জেনারেল ইসকান্দার মির্জা। ভাগলকান্দির মির্জা বেগ মোম ঘষা মোচে মৃদু তা দিয়ে ভাবেন, এবার কমিন কমজাতরা বুঝতে পারবে তমুদ্দুন আর তরক্কি কী চিজ? যুক্তফ্রন্ট করে জমিদারি লাঠে উঠিয়ে, বনিয়াদি রইসদের বেইজ্জত বেহুরমত করে, দুনিয়ার যত কুলি-ঢুলি, কটাই-মজর ও কিরানদের খুব বাড় বেড়েছিল। এই বার বেল্লিকরা বুঝতে পারবে কত ধানে কত চাল।
মির্জা বেগ চা পান শেষ করে টেবিল থেকে তুলে নেন ফটোগ্রাফসের অ্যালবাম। তার পয়লা পৃষ্ঠায় আছে ভাগলকান্দির সাহেববাড়িতে খাজা নাজিমুদ্দিনের সফরের চিত্র। বড় আফসোস হয়, এ ধরনের দরাজদিল মানুষের ক্ষমতাচ্যুতির জন্য। খাজা সাহেব পূর্ব বাংলার উজিরে আলা হিসেবে গদিনশিন থাকলে কখনো জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ হতো না। আর জমিদারি বহাল থাকলে হালফিল যে সব কটাই-মজরদের বাড় বেড়েছে তাদের স্রেফ পয়জার মেরে শায়েস্তা করা যেত অনায়াসে। আনমনাভাবে মির্জা পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখে পড়ে মোসাম্মৎ শবনম আরার ফটোগ্রাফে। তিসরা বেগমের ছোট বোন শবনম ভালোবাসে শাপলা-শালুক ও অথৈ জল। তো, মির্জা পানসিতে করে তাঁর বিনন্দের বিলে নৌবিহারের বন্দোবস্ত করেছিলেন। তিসরা বেগম সাথে থাকলেও বিলটিলে তাঁর আগ্রহ কম। তিনি নায়ের গলুইতে হেলান দিয়ে মশগুল হয়ে পাঠ করছিলেন মোহন ও রমা বইটি। একঝাঁক বালিহাঁস জল ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছিল। মির্জা খুব দাব রোয়াবের সাথে তাদের নিশানা করে ছুড়েছিলেন বন্দুকের ছিটা গুলি। তাতে হাঁসদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও পিলে চমকে গিয়েছিল শবনমের। মেয়েটি দ্রুত বন্দুকের শক সামলে নিয়ে মশকরা করে বলেছিল, ‘দুলাভাই, আফনার বন্দুক মারা দেখিয়া পাখিনতে এখন আসা-আসি করের’। গোধূলির আলো এসে পড়েছিল শবনমের কচমা মুখে। কিেশারীটি যে ইতিমধ্যে সুস্তনী হয়ে উঠেছে, বিষয়টি মির্জা নজর করেন। সাথে সাথে তাঁর দিলে মেয়েটিকে চতুর্থ বেগমের মর্যাদা দানের হাউস জাগ্রত হয়।
আকাঙ্ক্ষা তুমুল হলেও তা বাস্তবায়ন সহজ হয় না। কারণ, তিসরা বেগম তাঁর বাপের বাড়ি থেকে নিয়মিত মাসোহারা পান। মির্জা তাঁর কাছ থেকে হামেশা হাওলাত নেন। মাঝে মাঝে হাতবাক্স থেকেও হাতান শ-দুই শ রুপিয়া। এবং এ পয়সা ব্যয় করেন ব্র্যান্ডি কিংবা জিন ও টনিক ক্রয়ে। তাই তিসরাকে চটানোর হিম্মত তাঁর হয় না বটে, তবে হৃদয়ে আফসোস বলকে ওঠে। নিশিরাইতে তিনি চাঁদের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্ণৌয়ের খাস উদুর্তে মুসাবিদা করেন বিরহ বিধূর একটি নাগমা। তাতে শবনমকে সম্বোধন করেন সুরভিত ‘গুল’ বলে। বালিকাটির সান্নিধ্যের জন্য চুলবুল করে উঠতে থাকে তাঁর তনুমন।

>কি​েশারীটি যে ইতিমধ্যে সুস্তনী হয়ে উঠেছে, বিষয়টি মির্জা নজর করেন। সাথে সাথে তাঁর দিলে মেয়েটিকে চতুর্থ বেগমের মর্যাদা দানের হাউস জাগ্রত হয়

খাসবরদার আদমসুরত সাইনবোর্ড নিয়ে কামরায় ঢোকে। চোখে চশমা লাগিয়ে মির্জা দেখেন তাতে ট্রাক্টরের ছবির পাশে লেখা, ‘ভাগলকান্দি প্রাইভেট ফারম, গরু-বইশ চরানো নিষেধ। বাই অর্ডার—মির্জা আসফ জাহান বেগ, বি, এ (হন্স) এম, এ (ক্যালকাটা)’। ঘটনা হচ্ছে, সাহেববাড়ির জয়েলে আছে ছয় হাল বা বাহাত্তর কেদার জমিন। শোনা যাচ্ছে, এ মিরাশ ডিসির খতিয়ানে উঠে যাবে। এ প্রক্রিয়া ঠেকানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে তাতে চাষাবাদ করে খাসজমি হিসেবে দেখানো। তো, মির্জা বেগের হালফিল ট্রাক্টর দিয়ে চাষাবাদের খায়েশ হয়েছে। পয়লা বেগমের ইয়াকুত ও জমরুদ পাথর বসানো বেশ কয়েকখানা জড়োয়া জেওরাত বিক্রি করে কালুটি চা-বাগান থেকে নিলামে তিনি কিনেছেন একখানা সেকেন্ডহ্যান্ড ট্রাক্টর। কলের লাঙলখানা রাখা আছে পিলখানায়। তাঁর লাক্কড় দাদার আমলে বানানো পিলখানায় যুক্তফ্রন্টের ইলেকশনের আগেও মজুত থাকত দুটি দাঁতাল। এ জোড়া হাতি তাঁর পরদাদার আমলের। তিনি ভালোবাসতেন হিন্দুস্থানি মার্গসংগীত। তাই হাতিদের একটির পরিচিত ছিল মুলতানি বলে, অন্যটির নাম ছিল ভীমপলাশি। বড় বেগমের তরফে যমজ দুটি কন্যাসন্তানদের বিবাহ এবং সরকারের সাথে মামলা-মোকদ্দমার খরচাদি গোনজায়েশের জন্য দাঁতাল দুটিকে বিক্রি করে দিতে হয়। বিক্রির বিষয়টি ভাবতে চান না মির্জা। হাতি দুটোর মৃত্যু হয়েছে—এটি কল্পনা করে মনকে প্রবোধ দেন হামেশা। এদের নিয়ে তিনি মুসাবিদা করেছেন জোড়া এলিজি। এবং তা পাঠ করে শুনিয়েছিলেন মেজো বেগমের কনিষ্ঠ ভ্রাতা খসরুকে। খসরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ছে। ছুটিতে সে ভাগলকান্দি এসেছে। উচ্চশিক্ষায় রত থাকলেও তার মনে নেই সহজাত হামদর্দি, কাব্যকলা শ্রবণে নেই তার কোনো সংবেদনশীলতা। জোড়া এলিজি শুনে ফিচেল হেসে শালা বলে কি না, ‘দুলাভাই, হাতি নিয়ে তো কবিতা লিখলেন, এবার ছাতি লিখেন একটি সনেট। আপনাদের বাড়িতে খাজনা আদায়ের পুণ্যাতে যে ব্যাপক বিরাট ছাতা এস্তেমাল হতো, এটা নিয়ে তো লিখতে পারেন আস্ত একটি এপিক।’
শ্যালকের কথা ভাবতেই খসরু এসে ঢোকে খাসকামরায়। দুলাভাইয়ের সিগ্রেট কেইস থেকে একশলা ক্যাপস্টেন তুলে নিয়ে তাতে আগুন দিতে দিতে সে সাইনবোর্ডের দিকে তাকায়। তারপর মন্তব্য করে, ‘দুলাভাই, ক্যালকাটার পাশে হাইফেন দিয়ে জুড়ে দেন পলাতক শব্দটা।’ মির্জা এবার খেপে গিয়ে তাকে কষে দাবড়ে দেন। কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে খসরু গুনগুনিয়ে গায় গুলজারের রচিত একটি গীত, ‘আব মুজে কই ইন্তেজার কাহা’। খসরু সারাক্ষণ যেভাবে গীতে মজে আছে তাতে মির্জা আন্দাজ করেন ছোকরা হয়তো ‘লভে’ পড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলে তিনি যখন ক্যালকাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সের সমাপনী পরীক্ষা দিচ্ছিলেন, তখন নগরে উড়ে আসতে শুরু করে জাপানি জঙ্গিবিমান, সম্ভাবনা দেখা দেয় বোমাবর্ষণের। তিনি পরীক্ষা শেষ না করে স্রেফ জান রক্ষার্থে পালিয়ে এসেছিলেন—এটা সত্য, তাই বলে সাইনবোর্ডে পলাতক লিখতে হবে! শালাটি তো বড় বেবাট, রীতিমতো বেখাটা, তার বেয়াদবির কোনো সীমা-সরহদ নেই। মির্জার মেজাজ এবার সত্যিই বিলা হয়ে ওঠে।
চাষাবাদের ব্যাপারটি মির্জার খানদানে পয়লা চালু হতে যাচ্ছে। ঘটনাটি ঐতিহাসিক; এবং তিনি ক্যামেরা দিয়ে এর ছবি তুলে রাখতে চান। তাই আজ সকালে আদমসুরতকে পাঠিয়ে এত্তেলা দিয়েছেন শিশির ভট্টাচার্য্যকে। শখের ফটোগ্রাফার শিশির ভট বাজারে বৃন্দাবন ফটো স্টুডিও খুলেছেন। ওখানে নন্দন কাননের সরোবরে ভেসে বেড়ানো মরাল ও মায়া হরিণের চিত্রিত সিন-সিনারির সামনে টাই পরে অথবা আচকান গতরে দিয়ে ফটো তোলার বন্দোবস্ত আছে। শিশিরবাবুর জ্যাঠামশাই ভাগলকান্দি এস্টেটের সদর নায়েব ছিলেন। রায়টে এই পরিবারের সবাই ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্মনগরে চলে গেলে ভিটা আঁকড়ে এপারে থেকে যান কেবল শিশির ভট। পার্টিশনের আগে স্বদেশি আন্দোলনের সাথে তাঁর যৎসামান্য সংযুক্তি ছিল। তখন হুলিয়ায় ফেরার হলে মির্জা তাঁকে তাঁর মোটর কারের ড্রাইভার ভটর উল্লার বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন মাস ছয়েক। একপর্যায়ে মির্জা সিআইডির দরোগাকে হাতঘড়ি উৎকোচ দিয়ে ওয়ান্টেড লিস্ট থেকে তাঁর নাম কাটান। কিন্তু নিম্নবর্গের ম্লেচ্ছোর সংসারে অন্ন গ্রহণ করার অপরাধে হিন্দু সমাজে অচ্যুত হন শিশির ভট। অতঃপর অত্যন্ত পবিত্র, তবে আদতে প্রাণী-বর্জ্য, বর্ণে কালো ও থিকথিকে এক বস্তু কামানো চাঁদিতে মাখিয়ে জাতে ফেরেন তিনি। বক্স ক্যামেরায় ছবি তোলা ছাড়াও শিশির ভটের মোটরবাইক চালানোর শখ আছে। তাঁর বাহনটি হাটে-বাজারে বিচিত্র শব্দে দাবড়ে বেড়ায় বলে এ আত্রাফে তা ‘ভট বাবুর ভটভটি’ নামে পরিচিত।
আদমসুরত এসে জানায় যে জমিনে পানি সেচা শুরু হয়েছে। ড্রাইভার ভটর উল্লা ঝাড়ন দিয়ে সাফসুতরো করছে ট্রাক্টরখানা। পয়লা বেগমের খাস-বান্দি প্রকাণ্ড হান্ডিতে করে খেতি-জমিনে নিয়ে যাচ্ছে মইড়ছা গুড় দিয়ে রান্না করা বিরইন চাউলের ক্ষীর। মজুফ রিয়াফত ফকিরও এসে পড়েছেন। তাঁর লাঠির আগায় বাঁধা ভাঙা ছাতির কালো কাপড়। আঙিনায় দাঁড়িয়ে তা ঊর্ধ্বে তুলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে জবর হল্লাগুল্লা করছেন তিনি। ভট বাবুর ভটভটিরও শব্দ শোনা যাচ্ছে। মির্জা আলিগড়ি পায়জামা ও আদ্দির কোর্তা বদলিয়ে কোট-পাতলুন পরে মাথায় চড়িয়ে নেন শোলার হ্যাট। এ সময় ওড়নায় মুখ-মাথা ও বুক ঢেকে শবনম এসে ঢোকে তাঁর খাসকামরায়। সে ফিক করে হেসে বলে, ‘দুলাভাইরে বন্দর বাজারো গোল ছাত্তির তলে উবাইল ট্রাফিক পুলিশোর লাখান লাগের।’ মেয়েটির মৃদু মশকরায় মির্জার জান তর হয়ে যায়।
তখনই শিশির ভট এসে কামরায় ঢুকে তাঁর মস্ত বক্স-ক্যামেরাটি পাথরের টেবিলের ওপর রেখে বলেন, ‘আদাব আইগা।’ মোটরবাইকে চড়ে এসেছেন বলে তাঁর কুঁচানো ধুতি ঊরুর কাছে ক্লিপ দিয়ে আটকানো। শবনমের দিকে চোখ পড়তে তিনি শরম পেয়ে ক্লিপ খুলতে যান। সে-ও ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে নিষ্ক্রান্ত হয় পেছনের দুয়ার দিয়ে। তখনই দুঃসংবাদটি শোনা যায়! ভটর উল্লা ড্রাইভার মুখ কাঁচুমাচু করে এসে জানায়, ‘ট্রাক্টর কিছুতেই স্টার্ট করা যাচ্ছে না, ইঞ্জিন পুরা ডাউন হুজুর।’ মির্জার মেজাজ খিঁচড়ে যায়। ইচ্ছা হয় ভটর উল্লা হারামজাদার ভিটায় পুকুর খুঁড়ে ঠান্ডা পানি পান করার। কিন্তু সে জামানা গুজরে গেছে। তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ভটরকে বেরিয়ে যেতে ইশারা করেন তিনি।
শিশির ভটকে নিয়ে মির্জা তব্দিল হয়ে বসে ছিলেন। খসরু এসে তাঁর কেইস থেকে সিগ্রেট তুলে নিতে নিতে মশকরা করে, ‘দুলাভাই, ট্রাক্টরের তো অপমৃত্যু হলো, এটা নিয়ে লিখবেন না এলিজি?’ নিজেকে সামলাতে পারেন না তিনি, চিৎকার করে বলেন, ‘খামোস বেয়াদব।’ খসরু বেরিয়ে যেতেই শিশির তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘আপনার ক্রোধ সঞ্চার হয়েছে আইগা। এ সময় সোম রস সেবন করা শাস্ত্রে বিধেয় আছে।’ মির্জা তাঁর মন্তব্যের কোনো জবাব না দিয়ে আলমিরা থেকে ব্র্যান্ডির বোতল বের করে পেয়ালায় ঢালেন। শিশির ভট সুরা পান পছন্দ করলেও গন্ধ সহ্য করতে পারেন না, তাই তিনি ধুতির খুঁট নাকে চেপে চুমুক দিয়ে বলেন, ‘চাষবাসে আইগা রাশিচক্রের অবস্থান মেনে কাজে হাত দিতে হয়। দোষ ট্রাক্টরের ইঞ্জিনের না। সকালে আমি পাঞ্জিতে দেখেছি শনি মহারাজ আজ অবস্থান করছেন কর্কট রাশিতে। বড় শক্ত দেবতা তিনি। চিন্তা করবেন না আইগা, আমি জ্যোতিষশাস্ত্র জানা ব্রাহ্মণ জোগাড় করে দিতেছি। উনি গুণেবেছে দিনক্ষণ-লগ্ন ঠিক করে দেবেন, তখন চাষবাসে বউনি করলে ট্রাক্টর ঠিকই ঠেকঠেকিয়ে চলবে।’
শিশির ভটের কথায় বিশেষ একটা আগ্রহ দেখান না মির্জা। তিনি নীরবে ব্র্যান্ডি পান করেন। তাঁর চোখে ভেসে ওঠে শবনমের ওড়না জড়ানো কচমা মুখ। তাকে কখন কে সাহেববাড়িতে নাইওর আনালো, তিনি তো কিছু জানেন না; তবে মেয়েটির আগমনে যে তাঁর মন প্রফুল্ল হয়েছে, বিষয়টি বুঝতে পারেন। মনে একটু বেপরোয়া ভাব আসে। ভাবেন, গোল্লায় যাক ট্রাক্টর, প্রজাস্বত্ব আইনে মহাল-কে-মহাল হাতছাড়া হয়ে গেছে। এ বাহাত্তর কেদার জমিন খাসে রেখে আর কী ঘোড়ার ডিম হবে? মন থেকে তিনি ট্রাক্টরের প্রসঙ্গ সরিয়ে শবনমের কথা ভাবেন। নিজেকে কেমন যেন দিওয়ানা দিওয়ানা লাগে। তখনই অনুভব করেন, সান্নিপাতিক জ্বরের মতো তাঁর দিলে পয়দা হচ্ছে পদ্য লেখার অনির্বচনীয় জোশ। শিশির ভটকে তিনি জ্যোতিষ জানা ব্রাহ্মণের তালাশে যেতে হুকুম করেন। উনি বেরিয়ে যেতেই মির্জা হেন্ডোল পেন দিয়ে খসখসিয়ে আংরেজিতে লিখেন একটি লাভ-পোয়েম। নিজের লেখা পদ্যটি বারবার পড়তে গিয়ে তাঁর আতান্তর হয়, বালিকাটি মাত্র অষ্টম মানে উঠেছে, সে কি অনুধাবন করতে পারবে এর ছন্দ-প্রতীকে তিনি পুরে দিয়েছেন কী মর্মযাতনা। মির্জার বড় বেচইন লাগে, তাই তিনি আরেকটু নিট ব্রান্ডি পান করেন।