ভিন্ন এক সুলতান

জলোচ্ছ্বাস, শিল্পী এস এম সুলতান
জলোচ্ছ্বাস, শিল্পী এস এম সুলতান

কয়েক দিন আগে শিল্পী এস এম সুলতানের প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়েছে ডেইলি স্টার বেঙ্গল আর্টস প্রিসিন্টে ডেইলি স্টারের যৌথ উদ্যোগে। পুরো প্রদর্শনীটা আয়োজিত হয়েছে প্রথিতযশা শিল্প-সংগ্রাহক আবুল খায়ের লিটুর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। শিল্পীর জীবনকালে তাঁর সঙ্গে আবুল খায়েরের ছিল ব্যক্তিগত সখ্য। তাই দীর্ঘদিন ধরে তাঁর কাছে জড়ো হয়েছে একটা বড় সংগ্রহ। সুলতান সচরাচর ছোট আকারের কাজ করেননি, ছোট যা করেছেন তা নেহাতই অনুশীলন ।
প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘পরাদৃষ্টি’৷ ১৮টি পেইন্টিং ও ১৫টি ড্রাইয়ারের সমারোহে এই আয়োজনের ড্রইংগুলো ৫৬-এর দিকে করা ৮৭’র জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রদর্শনীতে কিছু ছোট মাপের কাজ আমরা দেখি। যেখানে তিনি নিবিড় যত্নে প্রকৃতির প্রতিটি সূক্ষ্ম ডিটেইল ধরেছেন আবার প্রচুর পানি নিয়ে পাতলা ওয়াশা সাজ করেছেন, যাকে তিনি বলেছেন ‘ওয়াটার প্লে’। কিন্তু এবারের প্রদর্শনীতে যে ধরনের জলরং দেখা গেল, তা একেবারেই ব্যতিক্রম। এমনই একটি কাজের শিরোনাম ‘হারভেস্টিং’, যা আমাদের চেনা সুলতানের বর্ণলেখনে—টেকনিক থেকে স্বভাবগতভাবে একেবারেই আলাদা।
সুলতানের বৈশিষ্ট্য বলতে আমরা জানি, পেশিবহুল কৃষক আর নাদুসনুদুস সুখী রমণী। ছবির এই ধারা সৃষ্টির আগে নানাভাবে কাজ করেছেন তিনি। এর মধ্যে কিছু কাজ পাওয়া যায় আর বেশির ভাগই পাওয়া যায় না। একটি ক্যানভাস, যা শিরোনামহীন—ধারণ করে আছে একটা সুখী গ্রাম্যজীবন। ভেতরে বহুচেনা ‘চর দখল’ এবং ‘জলোচ্ছ্বাস’–এর বিখ্যাত ছবি। জলোচ্ছ্বাসের ছবিটি তাঁর শেষ জীবনের একটি মাইলস্টোন, যেখানে আমরা প্রথম ও শেষবারের মতো সুলতানের ছবিতে প্রাণহীন কৃষক ও তাঁর পরিবারকে দেখি। বাংলাদেশের বিশাল বিস্তৃত সমতলে সুলতানের এই পাহাড়প্রতিম মানুষ নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন, অনেক ব্যাখ্যাও হয়েছে। আবার সুলতান নিজেও অনেক বলেছেন। সৃষ্টি করেছেন ভিন্ন জীবনদর্শন।
স্বাধীনতার পর পরই যে সুলতানকে দেখতে পাই, তাঁর অনুশীলন বা সুপ্ত বীজ আমরা ’৫৬-তেই দেখি বেশকিছু স্টার্ডিতে। যেখানে জালবোনা বা জেলেকেও দেখা গেছে পেশিবহুল দেহ নিয়ে তবে এই প্রদর্শনীতে ওই কালপর্বের যেসব কাজ আমরা দেখি তা চরিত্রগতভাবে যথেষ্ট আলাদা। তবে ’৬৯-৭৬ সময়কালে এ ধরনের ড্রইং করতে দেখা গেছে তাঁকে। যা তিনি ’৫৬-তেও করতেন বলে জানা গেছে সম্প্রীতি। তবে এ কথা বলা যায়, সুলতানের সুলতান হয়ে ওঠার উপাদান কোনো টেকনিকের ওপর নয় বরং একটি দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সুলতানকে সুলতান করে তুলেছে তার ইয়াং ফার্মার ও ফাস্ট প্ল্যানটেশনের মতো কাজ। যে কারণে এই কাজগুলোর মধ্যেই সুলতানের আত্মপরিচয় নিহিত। শিল্পের সামাজিকায়নের জন্য উত্তাপ প্রয়োজন এবং যে উত্তাপ সমাজে গতিসঞ্চারের সহায়ক তা আমরা দেখতে পাই এসব কাজের মধ্যেই। কিন্তু জলোচ্ছ্বাসের কাজটি আমাদের কী এভাবে ভাবায় না, যে শক্তি থেকে তার উত্থান সেখান থেকে তিনি নিজেই কী প্রস্থান করতে চাচ্ছেন? ২৩ মে শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি শেষ হবে ১৩ জুলাই৷