
যুদ্ধের মেয়েরা ও অনান্য গল্প
মূল: চিনুয়া আচেবে
অনুবাদ: রওশন জামিল
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রথমা প্রকাশন
১১২ পৃষ্ঠা দাম: ১৮০ টাকা
‘নিয়তির যুক্তি’র মতোই যেন আফ্রিকায় ঢুকেছিল বাইবেল, বন্দুক, দাস-ব্যবসা, ইংরেজি ভাষা আর সাহিত্য; তাই চিনুয়া আচেবের মতো অনেক লেখককে মাতৃভাষার বদলে বেছে নিতে হয়েছিল ইংরেজিকে। কেনিয়ার লেখক নগুগি ওয়াথিউংগো যদিও এতে নাখোশ হয়েছিলেন, তবু লেখকদের অনেকেই স্থির ছিলেন ইংরেজি ভাষামাধ্যমে। আচেবে তাঁদের অন্যতম, যিনি ভেবেছেন ইংরেজি ভাষা আফ্রিকীয় অভিজ্ঞতাকে ধারণ করতে সক্ষম; কিন্তু তাকে হতে হবে নতুন ইংরেজি। এই বিশ্বাসের ভরসায় আচেবে কৃষ্ণ দুনিয়াকে আঁকতে নেমেছিলেন ১৯৫৯-এ থিংস ফল অ্যাপার্ট উপন্যাসের মাধ্যমে। উপন্যাসের বিশ্বজোড়া খ্যাতির কারণেই হয়তো বা তাঁর গল্পগুলো প্রায় যেন আড়ালে পড়ার উপক্রম। বাংলাভাষী পাঠকও প্রধানত তাঁকে ঔপন্যাসিক বলেই চেনেন। পাঠকের চেনাজানার সীমানাকে আরও একটু বাড়াতে রওশন জামিলের অনুবাদে আচেবের ১২টি গল্প নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে যুদ্ধের মেয়েরা ও অন্যান্য গল্প।
১৯৫২ থেকে ১৯৭২ কালপরিধির ভেতর লেখা গল্পগুলোতে আচেবে ছুঁয়ে-ছেনে দেখেছেন কালো মানুষের বৃত্তান্ত। ফলে চেনা যায় সেই আফ্রিকাকে, যার পিঠের ওপর জোয়ালের মতো চেপে বসেছে ঔপনিবেশিক ইতিহাস, ধর্মে-রক্তে-মর্মে গেঁথে আছে বহিরাগত সংস্কৃতির ছাপ। ভূমিজ সংস্কৃতি বনাম বহিরাগত সংস্কৃতির সংঘর্ষের কালে যে রকম ঘটে—হার, জিত অথবা সমন্বয়, যেকোনো কিছুর দিকে সংস্কৃতির ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা—সে রকম একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত যেন রচিত হয়েছে আচেবের লেখায়। তাই গল্পগুলো থেকে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির আঘাতে ভেঙে পড়া ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির দাগ ও নকশাগুলোকে শনাক্ত করা খুব কঠিন কাজ নয়।
এদিক থেকে বিবেচনা করলে, খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি গল্প ‘মৃত মানুষের পথ’, যেখানে স্কুল কম্পাউন্ডের সামনে দিয়ে গোরস্তানের দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটিকে বন্ধ করে দেয় প্রধান শিক্ষক। স্থানীয় বিশ্বাস মতে, ওই রাস্তা দিয়েই ‘মৃত স্বজনেরা বিদায় নেন’ এবং ‘পূর্বপুরুষেরা এই পথে আমাদের দর্শন দিতে আসেন।’ ওদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষার স্তাবক ও প্রচারক প্রধান শিক্ষক মাইকেল ওবির অবস্থান প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। কৃষ্ণ আফ্রিকায় ওবির মতো অগুনতি মানুষ পাওয়া যাবে, যাঁরা শিশুস্তরে শিখে এসেছেন কথিত আধুনিকতার বীজমন্ত্র—‘সাহেবি ধারা’র অর্থ ‘সনাতন ধারার ঠিক বিপরীত।’ এমন অভিজ্ঞতার গল্প ‘চিকের স্কুলের দিনগুলো’, যেটিকে সহজেই বলা চলে নাইজেরীয় শিশুর সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ইতিহাস।
পুরোনো সংস্কৃতির জনমানুষ যেগুলোকে আদর্শ রূপে চেনে, তারই প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে এসেছে বহিরাগত ভাবাদর্শ, যদিও তার জাদুদণ্ড সংখ্যালঘু হাতে গোনা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের হাতে। সংখ্যাগুরুর বিপরীতে ইউরোকেন্দ্রিকতা থেমে থাকেনি। ফলে লড়াই শুরু হলো নতুন ও পুরোনোর, আদর্শ ও ভাবাদর্শের। ইউরোকেন্দ্রিক ভাবাদর্শীরা ভবিষ্যতে হয়ে উঠল কালোদের নিজস্ব নেতা ও শাসক। ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ক্ষমতা হাতে নিয়েছে এরাই। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর বখরাবাজির ফল হিসেবে অচিরে নাইজেরিয়ায় দেখা দিল গৃহযুদ্ধ। আচেবের গল্পের জমিনেও জায়গা পেল নতুন আধেয়। ‘প্রতিশোধপরায়ণ মহাজন’, ‘গৃহশান্তি’ বা ‘যুদ্ধের মেয়েরা’ গল্পে দেখা যাচ্ছে ঔপনিবেশিক জোয়ালমুক্ত নাইজেরিয়া নিজেই নিজের হাতে ধ্বংসের মুখোমুখি। সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান, খাদ্যাভাব ও মৃত্যু মিলিয়ে দেশটিতে মানুষের দৈনন্দিন জীবন মূলত নরকের দিনলিপি। তাই ‘ভোটার’ গল্পটিতে আচেবে দেখান অল্প টাকায় বিকিয়ে যাওয়া ভোটের রাজনীতি আর উদার গণতন্ত্রের মুখ ও মুখোশ। মোটামুটি সবগুলো গল্পে সামাজিক নকশাকারের মতো করে আচেবে হাজির করেন নাইজেরীয় সমাজের উপনিবেশকালীন ও উপনিবেশ-উত্তর চেহারা।
এই সূত্রে অনুবাদকের বিবেচনা যথার্থ, গল্পগুলোতে বাংলাদেশের ‘উত্তর-মুক্তিযুদ্ধ জনজীবনের সাদৃশ্য লক্ষ করা অসম্ভব নয়।’ শুধু নাইজেরিয়া বা বাংলাদেশ নয়, আচেবের গল্পসূত্রে ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত তৃতীয় দুনিয়ার অধিকাংশ ভূখণ্ডকে পাঠ করা সম্ভব। অাচেবের বাংলাভাষী পাঠক, কাতর আগ্রহ নিয়ে যাঁরা এত দিন গল্পগুলোকে খুঁজেছেন, রওশন জামিলের অনুবাদ তাঁদের জন্য নিঃসন্দেহে আনন্দ-সংবাদ।