মনজুরে মওলার ৮০তম জন্মবার্ষিকী আজ

মনজুরে মওলা
ছবি: সংগৃহীত

নিমগ্ন, কী করে পারো ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত মনজুরে মওলার (জন্ম: ১৯৪০ সালের ১ অক্টোবর) প্রথম কবিতার বই। এরপর আরও কিছু কবিতার বই বেরিয়েছে তাঁর। সুচিত্রা সেনের জন্য শিরোনামে একটি বই তো বেশ দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছিল পাঠকের। কিন্তু নিজের কবিতার চেয়ে তিনি কথা বলতে আগ্রহী রবীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, টি এস এলিয়ট থেকে এই এখনকার বাঙালি কবিদের নিয়ে। জরাগ্রস্ত দেহে কিন্তু সক্রিয় মননে এখনো ব্যস্ত এলিয়টের সময় বইয়ের নতুন সংস্করণ নিয়ে। বই আর জ্ঞানচর্চার প্রতি আগ্রহটা সম্ভবত শিক্ষক পিতা কাজী আম্বর আলীর কাছ থেকেই পেয়েছেন, যাঁর সম্পর্কে তাঁর স্কুলজীবনের কিছু স্মৃতিকথায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আমাদের হেড স্যার কাজী আম্বর আলী অত্যন্ত জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যেকোনো পরিস্থিতিতে সময়োচিত পদক্ষেপ নিতে পারতেন। তাঁর প্রচেষ্টায় এই স্কুলের (আজিমপুর গার্লস হাইস্কুল) সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল।’

মনজুরে মওলার পরিচয় নানাবিধ। পেশাজীবনে বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে সব ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে আশির দশকে প্রায় তিন বছর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে তাঁর কার্যকাল। ‘একুশ আমাদের পরিচয়’ প্রত্যয়ে সে সময়েই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা, আজ যা বিশ্বের দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলা বই উৎসব। ঐতিহাসিক বর্ধমান ভবন সংস্কার, প্রথম জাতীয় ফোকলোর কর্মশালা আয়োজন, আরজ আলী মাতুব্বর বা খোদা বক্স সাঁইয়ের মতো লোকমনীষাকে ফেলোশিপ প্রদান, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ডেভিডসনের চিকিৎসাবিজ্ঞান কিংবা আনিসুজ্জামানের পুরোনো বাংলা গদ্য-এর মতো বই প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। বাংলা একাডেমিতে তাঁর অসামান্য কীর্তি ‘ভাষাশহিদ গ্রন্থমালা’র ১০১টি বই। এমন অনেক বই এই সিরিজে প্রকাশিত হয়েছে, যা বিষয় হিসেবে ছিল নতুন; এমন অনেকে এই সিরিজে লিখেছেন, যাঁরা পরে সে বিষয়ে অর্জন করেছেন বিশেষ পরিচিতি। এই সিরিজের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বইয়ের শিরোনামে দৃষ্টি দিলেই আমরা বুঝতে পারি এর পরিসর—মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ, জামাল নজরুল ইসলামের কৃষ্ণবিবর, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর অনুবাদ, সেলিনা বাহার জামানের সংখ্যা, শরীফ হারুনের অস্তিত্ববাদ, শান্তনু কায়সারের কাব্যনাটক, মালেকা বেগমের নারীমুক্তি আন্দোলন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের নন্দনতত্ত্ব

বাংলাদেশের কবিতা ১৯৪৭–২০১৭
সম্পাদনা: মনজুরে মওলা

কার ২৮ এপ্রিল ১৯৮৪ সংখ্যায় ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব: বাংলাদেশ থেকে ফিরে’ নামের লেখায় তিনি লিখেছেন, ‘সাক্ষাৎ পরিচয় হলো একাডেমির মহাপরিচালক মনজুরে মওলার সঙ্গে। মওলা কাজের লোক, নিজে পরিশ্রমী, অন্যদের দিয়েও কাজ করিয়ে নিতে জানেন। ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান উপলক্ষে তাঁর পরিকল্পনা ছিল যে পুরো মাস ধরে প্রত্যহ একটি করে নতুন বই প্রকাশিত হবে। কোনো কোনো দিন দেখেছি রাত ন’টা–দশটাতেও পাণ্ডুলিপির প্রুফ সংশোধন এসব নিয়ে একাডেমির দপ্তরে কাজ হচ্ছে। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে একাডেমি থেকে এই মাসে ৪২টি বই প্রকাশিত হয়। দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি, ভাষাতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান কিছুই অবহেলিত হয়নি। কিন্তু মওলা এসেছিলেন সিভিল সার্ভিস থেকে।’

২.

মূলত মান্নান সৈয়দের চারিত্র এবং আবুল হাসনাতের সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য পাতার আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। এরপর একে একে প্রকাশ পেয়েছে একটি কবিতা: এলিয়ট, রবীন্দ্রনাথ ও আরও দুইজন, রবীন্দ্রনাথ: কবিতায় ছবি, অল্প একটু রবীন্দ্রনাথ, একজন কবি বিষয়ে, গ্রহণ করেছো যতো, রবীন্দ্রনাথ: রোগশয্যায়, আমি কবি–এর মতো বই, দুই খণ্ডে সম্পাদনা করেছেন রবীন্দ্রনাথের নির্বাচিত কবিতা। রবীন্দ্র–বিষয়ে তাঁর অসাধারণ এক কীর্তি গ্রন্থমালা সম্পাদক হিসেবে তাঁরই পরিকল্পনায় রবীন্দ্র সার্ধশত জন্মবর্ষে রবীন্দ্রবিষয়ক ১৫১টি বই প্রকাশ।

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দশমী বইটিকে কেন্দ্র করে নষ্ট নীড় নামে বই লিখেছেন মনজুরে মওলা। অনুবাদ করেছেন ইবসেনের নাটক ব্র্যান্ড, এলিয়টের সুইনি ও দ্য রক, গির্জায় খুন। এলিয়ট অনুবাদের পাশাপাশি তাঁর ব্যাখ্যাভাষ্যও করেছেন সমান গুরুত্বে। যে বয়সে আত্মজীবনী লেখা স্বাভাবিক, সে বয়সে এসে টি এস এলিয়ট নিয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র মনজুরে মওলা একাডেমিক গবেষণা করেছেন, অন্বেষণ করে চলেছেন এলিয়টের জীবন। এলিয়ট নিয়ে একগুচ্ছ সমীহ-জাগানো বই লেখার পরও নিজেকে গবেষকের বদলে আখ্যা দিয়েছেন ‘এলিয়ট-এর মুগ্ধ পাঠক’ হিসেবে।

একসময় তিনি সম্পাদনা করতেন শ্রাবণ নামের উঁচু মানের সাহিত্যপত্র; যেন সে সম্পাদনা-কৃতিত্বেরই উত্তরকালীন নিদর্শন ধরা রইল তাঁর সম্পাদিত পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা (মূর্ধন্য, ২০১৭) এবং বাংলাদেশের কবিতা ১৯৪৭-২০১৭–তে (মূর্ধন্য, ২০১৮)। পরিশ্রমসাধ্য সংকলনে বিস্মৃত বহু কবির কবিতা উদ্ধার আর অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে বাংলাদেশের কবিতার ধারাক্রম যেভাবে ধারণ করেছেন তিনি, তা আসলে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাজ। কিন্তু একজন কবি ও কবিতাপ্রেমী হিসেবে তিনি নিজে সে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন৷

এলিয়ট–এর সময়
মনজুরে মওলা

৩.

প্রশাসক-গবেষক-সম্পাদক- অনুবাদক- কবি মনজুরে মওলা লিখেছেন দুটো কাব্যনাট্য আমি নই এবং জালিয়ানওয়ালাবাগ

গোয়েন্দা–গল্পের ইতিহাস রচনাতেও মনজুরে মওলা আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন। গল্পের গোয়েন্দা, পড়তে চাই গোয়েন্দাগল্প-এর লেখক মনজুরে মওলা মনে করেন, কোনো কোনো গোয়েন্দা–গল্পে যেমন শরদিন্দুর ব্যোমকেশে সমকালীন সমাজ এত চমৎকারভাবে এসেছে যে বিস্ময় মানতে হয়। আবার শার্লক হোমসকে তাঁর মনে হয় এলিয়টের মতোই একজন ভীষণ চেনাজানা মানুষ, যে আমাদের কাছেই ঘুরে বেড়াচ্ছে আর এই ধাঁধার দুনিয়ার জটিল সব রহস্যের নিপুণ সমাধান করে চলেছে।