মাকড়সা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সাহারা বেগম পলি নামের মেয়েটিকে যখন আমার চেম্বারে নিয়ে আসা হলো, রাত বাজে নয়টা। চেম্বারের লাইট নিভিয়ে লন্ঠনের আলোয় আমি রাতের শেষ রোগীটিকে দেখছিলাম। এক বছর আগে হলেও আমি পলির জন্য বসে থাকতাম না, কারণ সাতটা বাজতে না বাজতেই আরিফার মুখটা আমার চেম্বারের দেয়ালজুড়ে ভেসে উঠত এবং আমি সব ফেলে বাড়ির পথ ধরতাম।

আরিফা এখন নেই। আরিফা তিন বছর বিছানায় পড়ে পড়ে পরপারে গেছে। তিন বছর তার শরীর ছিল রাস্তার পাশের একটা নিথর মাইল-পাথরের মতো, সারা দিন জগতের আসা-যাওয়া দেখাই ছিল যার কাজ। আরিফা কথা বলত শুধু চোখ দিয়ে। চার বছর আগে সে আমার মোটরসাইকেলের পেছনে বসে ছিল। একটা গানও গাইছিল। আমরা যাচ্ছিলাম গুলিস্তানের সামনে দিয়ে বায়তুল মোকাররমের দিকে। উদ্দেশ্য ছিল আসেম জুয়েলার্স থেকে ওর কানের দুল আর নাকফুল ডেলিভারি নেওয়া। তারপর নাজ-এ একটা সিনেমা দেখা। কিন্তু আমাদের পথজুড়ে একটা বাস এল।
যাক।
এখন আমি চেম্বারজুড়ে বসে থাকি, সাহারা বেগম পলিরা এলে ভালো, না এলেও ক্ষতি নেই। এখন বাড়ি যাওয়া আর কষ্টের চোরাবালিতে পা ঢুকিয়ে দেওয়া একই জিনিস। এখন দিনকাল খারাপ। সন্ধ্যা নামে আতঙ্ক নিয়ে। অনেক রাত চেম্বারেই কাটাই, আটটা থেকে আলো নিভিয়ে। আমার লোকগুলোর কেউ কেউ থেকে যায়। যেমন মুমিন।

পলিকে নিয়ে আসা উঁচু লম্বা শরীরের শ্যামলা এক মানুষ আমাকে বলল, স্যার, আমার বউকে বাঁচান।

অবশ্যই, মানুষকে বাঁচানোটা আমার কাজ, আমি বললাম।

ওকে মাকড়সা কামড়েছে। কামড়াতে কামড়াতে সেটি তার পেটে ঢুকে গেছে। মাকড়সার বিষ ওর সর্ব অঙ্গে, লোকটা বলল।

আমি অবাক হলাম, কোনো মানুষকে মাকড়সা কামড়েছে, এ কথাটা জীবনে আগে শুনিনি, শুনছি এই কমাস থেকে। তবে আমি বেশি অবাক হলাম লোকটার মুখে ‘সর্ব অঙ্গ’ শুনে। কথাটা গানে শুনেছি, কারও বলা কথায় না। আর স্ত্রী যখন যাচ্ছে অগস্ত্য যাত্রায়, সর্ব অঙ্গ কথাটা লোকটার জিভেই-বা কীভাবে আসে? লোকটা কি কবি, ঠাকুরের ভাবশিষ্য?

নার্স তারিনা বলল, হার্ট বিট পাওয়া যাচ্ছে না। মুখের কষ বেয়ে ফেনা বেরোচ্ছে।

এই নার্সটি নতুন এসেছে। এক জেলা শহর থেকে পালিয়ে।

পলিকে দেখলাম। দুই চোখ কিছুটা খোলা। মুখটা কালো। যেন সে ঢাকা নামের বন্দিখানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য মুখে কালি মেখেছিল। অথচ তার দুটি হাত যথেষ্ট ফর্সা। পেটটাও। পেটে লাল-নীল দাগ। লালগুলো সাম্প্রতিক, নীলগুলো পুরোনো। মাকড়সাটা সত্যি তার পেটে ঢুকেছে। অনেকখানি জায়গাজুড়ে সেই ঢুকে পড়ার জখম। পলির গলাটা লম্বা, যেন পাখি হতে হতে মানুষ হয়ে গেছে মেয়েটি।

আমার প্রথম কাজ পলির পেট কেটে মাকড়সাটা বের করা। তারিনাকে বললাম, আনুকে ডাকো, মুমিনকে ডাকো। ওটি সাজাও।

তারিনা বলল, তাতে কী লাভ, স্যার। হার্ট বিট নেই। ব্রেনে অক্সিজেন যায়নি পনেরো মিনিট। ব্রেনটা সবজি হয়ে গেছে।

আমি কড়া গলায় বললাম, যা বলেছি তা-ই করো। ডাক্তারিটা আমার হাতে ছেড়ে দাও।

আমার কড়া গলা ধরার কারণ, তারিনা সবকিছুতেই যুক্তি খোঁজে। অথচ আমার অভিজ্ঞতায় যুক্তির বাইরে একটা জগৎকে পেয়েছি, অযুক্তির; যাকে ডাক্তারি জ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এই কমাস থেকে অসম্ভব কিছু ঘটনা ঘটছে, যেগুলো আমি কোনো যুক্তি দিয়ে মেলাতে পারি না।

চোখে বিষাদ নিয়ে তারিনা ওটি সাজাতে গেল।

২.

রাত তিনটায় সাহারা বেগম পলি চোখ মেলল। ঘরের আলো নেভানো, শুধু একটা লন্ঠন অল্পখানি আলো ছড়াচ্ছে। তারিনা একটা চেয়ারে বসে পলিকে দেখছে, তার চোখে আলো পড়ে একটা আশ্চর্যের প্রশ্ন জ্বলজ্বল করছে। মুমিন শুয়েছে ওটির বাইরে চাটাই পেতে। আরেক চাটাইয়ে পলির স্বামী।

পলি কীভাবে চোখ মেলল সে কথা জানাতে আমি অপারগ। কিছু কিছু বিষয় থাকে, যেগুলোর ব্যাখ্যা দিতে গেলে আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি গুলিয়ে যায়। এই কটি মাস আমার প্রতিদিন কাটছে বোঝা না-বোঝার ছায়া ছায়া পথে। আমি জানি এবং বুঝি, মানুষকে বাঘ পেলে খায়; এমনকি শেয়ালও মানুষকে বাগে পেলে ভোজনের আশ মেটাতে ছাড়ে না। কিন্তু ইঁদুর? মাকড়সা? অথবা তেলাপোকা?

এক রাতে সার্চ লাইটের আলো জ্বেলে, উর্দু-পাঞ্জাবিতে গালি আর চিৎকার দিতে দিতে, যুদ্ধের পোশাক পরা কিছু বর্বর লোক ঢাকাকে যখন একটা কসাইখানা বানাল, আমি দেখলাম, আমার বিশ্বাসের ঘরবাড়িগুলো ভেঙে পড়তে লাগল; কিন্তু অবাক, অন্যদিকে কিছু মজবুত দালানকোঠাও দাঁড়িয়ে গেল, ওই বিশ্বাসেরই। মানুষের চেহারা ধরা, মানুষের শব্দে কথা বলা খুনিগুলো মানুষ নিয়ে আমার বিশ্বাস গুঁড়িয়ে দিল। আবার আমার ছোট ভাইটা, পোলিওতে একটা পা বেঁকে যাওয়ায় সেই ছোটবেলা থেকে যে ঘরের ভেতর স্বেচ্ছাবন্দী, যাকে পড়াশোনা যা করানোর তা করিয়েছি আমি; স্বভাবে যে লাজুক, অনেকটা ভীতু; যে জীবনকে পকেটে রেখে দিয়েছে একটা অচল মুদ্রার মতো, আর প্রতিদিন বিষণ্ণতার কলের নিচে যে শরীর ধোয়, একদিন আমাকে একটা চিঠি লেখে, কোথা থেকে একটা বন্দুক জোগাড় করে চলে গেল নিজের একটা পরীক্ষা নিতে। পেছনে যা রেখে গেল, তা এক চকমকে বাস্তুকলা, যা দিয়ে আমার বিশ্বাসের ঘরটা আবার তুললাম।

পলি চোখ খুলল, কিছুক্ষণ সময় নিল নিজের নিশ্বাসটা খুঁজে পেতে। আরও কিছু সময় নিল তার গলাটা আবিষ্কার করতে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে খুব দুর্বলভাবে বলল, আপনি কে?

ডাক্তার।

পলির গলা শুনে তারিনা এগিয়ে এল, তার দুটি চোখ একেবারে সাদা করে দিয়েছে বিস্ময়। এ-ও কি সম্ভব?

পলি তারিনাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি?

নার্স।

ও, এটা তাহলে ডাক্তারখানা।

মাকড়সাটা পেটে ঢুকল কী করে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

প্রশ্নটা শুনে পলি কাঁপল, ও কোথায়? জিজ্ঞেস করল, মনির?

মনির, অর্থাৎ পলির স্বামী। ঘরের বাইরে ঘুমাচ্ছে।

পলি অল্প একটু হাসল, মাকড়সাটা আমার পেট কামড়েই ঢুকেছিল, সে বলল।

তাই তো দেখেছি, তারিনা বলল, আপনার পেট কেটে স্যার আবার সেটি বের করেছেন।

পলি হাসল। তারিনাকে বলল, মাকড়সাটা পেটের ভেতর জন্মাতেও পারত, তাই না? মাকড়সা না হোক অন্য কিছু, এমনকি নিষ্পাপ একটা কিছু। বুঝতে পারলেন?

তারিনা মাথা দোলাল—পারেনি। আমি বুঝলাম, পেটে তাহলে ঢুকল কীভাবে?

 মনিরকে ডাকেন।

তারিনা মনিরকে ডাকতে গেল।

এখন রাত কত? পলি জানতে চাইল।

সাড়ে তিনটার মতো।

সন্ধ্যার পর বাড়িওয়ালা আমারে ঘরে ঢুকল। সঙ্গে এক উর্দু বলা লোক। তার হাতে বন্দুক। কিন্তু সেই বন্দুকে কোনো কাজ হলো না। মনিরকে দেখেছেন? তার হাত দুটি দেখেছেন?

মাকড়সাটা তাহলে জন্মানোর সুযোগ পায়নি? মাকড়সা, অথবা অন্য কিছু, অথবা নিষ্পাপ কিছু? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

না, কিন্তু বাড়িওয়ালার হাত দুটি সিমেন্টে বানানো। ধস্তাধস্তিটা কঠিন হলো। মনির না থাকলে তাই নিশ্চয় হতো।

তারিনা ঢুকল মনিরকে সঙ্গে নিয়ে। মনির আমাকে দেখেই দুই হাতে জড়িয়ে ধরল। তার হাতে লন্ঠনের আলো পড়েছে। লাল। সেই লাল দুই হাতে এবার সে পলিকে জড়িয়ে ধরল। পলি লজ্জা পেল। বলল, যেতে হবে।

গোপীবাগের আকাশে ভোরের আলো ফুটুক। তারপর যাব, মনির বলল। কবি মনির।

কোথায় যাবেন? তারিনা জানতে চাইল। সে কথার উত্তর না দিয়ে মনির আমাকে জিজ্ঞেস করল, জীবন আপনার ছোট ভাই না, স্যার?

হ্যাঁ।

অনেকক্ষণ থেমে মনির বলল, জীবন মারা গেছে। আপনি জানেন?

না, আমি জানতাম না। তবে হয়তো জানতামও। কিন্তু, আমি নিজেকে বললাম, জীবন আবার জীবনে ফিরবে। অনেকবার।

বাড়িওয়ালার নামটা কী? আমি পলিকে জিজ্ঞেস করলাম।

নামটা মনিরই বলল। মুমিন এসে দাঁড়িয়েছিল দরজার পাশে, খেয়াল করিনি। নামটা শুনে ভয়ে সে একটা আর্তনাদ দিল।

গোপীবাগের আকাশে ঝিলিমিলি আলো ফুটল। মনিরের হাত ধরে পলি বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে মনির জানাল, যুদ্ধের পোশাকপরা লোকজন এসে বাড়িওয়ালাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সে বেঁচে ফিরবে।

 ৩.

দুদিন গেল। তারিনার বিস্ময় বাড়ছেই। একটি মেয়ের হার্ট বিট নেই, সে যে মরে গেছে, তাতে সন্দেহ নেই। তাহলে কীভাবে বাঁচে? আরেকটি মেয়ের হাত থেঁতলে গেছে, যে হাত কেটে ফেলতে হবে, সে হাত কীভাবে ভালো হয়ে যায়! এক বুড়ো মানুষের পেটে কিলবিল করছে ভয়ানক সব পোকা, তাকে তার ছেলে নিয়ে এসেছে ক্লিনিকে। ছেলেটা বসে থাকতে থাকতেই সব পোকা, স্যার, আপনি বের করে ফেললেন। কিন্তু সন্ধ্যায় আবার তাকে ধরে-বেঁধে নিয়ে এল ছেলে, আবার পোকা হয়েছে পেটে। কীভাবে? ছেলেটাকে এরপর পোকাগুলোই খেয়ে ফেলল, স্যার। তারিনা বলল।

আমি আর কী বলি।

অবাক স্যার, তাতে বুড়ো লোকটারও সায় ছিল, স্যার।

তারিনা কখনো আমাকে বলেনি, কীভাবে, কোথা থেকে সে ঢাকা এসেছে। আজ বুড়ো লোকটার গল্প ওঠায় নিজ থেকেই কেন জানি বলল, বুড়ো লোকটার ছেলেটার মতো একটা ছেলের সঙ্গে সে ঢাকা এসেছিল। এমনিতেই আসার কথা ছিল, এসে বিয়েটা সেরে ফেলার, কিন্তু মাঝখানে ওই রাত চলে এল।

তারপর?

ওই বুড়ো লোকের মতো কিছু লোক—তবে সব বুড়ো না—ওকে রিকশা থেকে নামিয়ে নিয়ে গেল।

তার মধ্যে সাহারা বেগম পলির বাড়িওয়ালাও ছিল, আমি অনুমানে বললাম।

 ৪.

সন্ধ্যাটা বৃষ্টি মাখামাখি হয়ে নামল। তারিনের চোখেও বৃষ্টি। তার পেটে একটা পাথর, বিশাল পাথর ছিল, সেটি বের করে ফেলেছি। এতে তার বিস্ময় আরও বেড়েছে। আমাকে বলেছে, স্যার, আপনি হাতে কাঁচি নিলেন না, আমাকে ওটিতে নিলেন না, শুধু কথা বললেন। তাতেই পাথরটা বেরিয়ে গেল! স্যার, এটা কীভাবে সম্ভব? পাথরটা যখন আমার পেটে, নাকি বুকে, আমি তো ভিন্ন মানুষ ছিলাম, স্যার। আয়নায় নিজেকে দেখে চিনতাম না।

আমি হাসলাম। তারিনার যুক্তি ধারালো হচ্ছে। সে পারবে।

 ৫.

 বৃষ্টি গায়ে দরজা ঠেলে প্রথমে একজন মানুষ ঢুকল। পরে আরেকজন।

 মানুষ না মাকড়সা?

 তারপর বাড়িওয়ালা।

 তারা হাসছে। হাসুক, তাদের হাসি শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি মাকড়সাদের কাছে মাফ চেয়ে নেওয়ার সময় পাব।

 মাকড়সাদের নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তাদের জগতে তারা মানুষ থেকেও হয়তো উত্তম। তারা আহার-নিদ্রা-মৈথুন-রেচন-সন্তান ধারণ—সবই করে। হয়তো প্রেমও, কে জানে।

কিন্তু সাহারা বেগম পলির কাছে মাকড়সাদের চেহারাটা ভীতির। মাকড়সা নিয়ে বিবাদটা তারই। পলি থেকে আপাতত এটি ধার নিয়েছি।

 বাড়িওয়ালা আমাকে হাতের ইশারায় উঠতে বলল। দুজন লোক এখন তার দুদিকে।

 কিন্তু বাড়িওয়ালা দেখেনি, তাদের পেছনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছে তারিনা আর মুমিন। তাদের চোখে আলো।

 আমিও চেয়ার ছেড়ে উঠছি। কিন্তু হাতে যে একটা বস্তু আছে—যে বস্তুটার কথা জীবন আমাকে বলে গেছে, তার সামনে বাড়িওয়ালা আর তার দুই সঙ্গীর জন্য তাদের মাকড়সাজীবন ধরে রাখা যে মুশকিল হবে।

 ভালোই হবে। অনর্থক আমার গল্পে আর মাকড়সাদের টেনে আনার প্রয়োজন হবে না। মাকড়সাদের জন্যও ভালো হবে, পলির আর আমাদের রূপক চিন্তায় তাদের আর ভিলেন হয়ে থাকতে হবে না। তারা তাদের ছিমছাম জীবনে ফিরে যেতে পারবে।