মৃত্যু-উত্তর ওয়ালীউল্লাহ্

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ [১৫ আগস্ট ১৯২২—১০ অক্টোবর ১৯৭১], প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ [১৫ আগস্ট ১৯২২—১০ অক্টোবর ১৯৭১], প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

এই সময়ের প্রেক্ষাপটে আমরা যদি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহেক দেখি, তাহলে তাঁর সম্পর্কে সবই মৃত্যু-পরবর্তী আলোচনা মনে হতে পারে। কিন্তু একজন প্রকৃত লেখক তো কখনো মরতে পারেন না। তাঁর সৃজনশীলতার মৃত্যু হয় প্রতি-মুহূর্তে, আবার জন্মায়ও পরক্ষণেই! এই স্থলে ওয়ালীউল্লাহ্ একেবারে ক্ষণে ক্ষণে স্মরণীয় এক কথাশিল্পী। তাঁর জীবদ্দশায় তিনটি উপন্যাস (লালসালু, চাঁদের অমাবস্যা, কাঁদো নদী কাঁদো), দুটি গল্পগ্রন্থ (নয়নচারা, দুই তীর ও অনান্য গল্প), তিনটি নাটক (বহ্নিপীর, সুড়ঙ্গ, তরঙ্গভঙ্গ) প্রকাশ পায়। তবে এই সব গ্রন্থসহযোগে তাঁকে নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রটি একেবারেই সীমিত হয়ে আছে; কেবলই আলোচিত হয় তাঁর অস্তিত্ববাদ, চেতনাপ্রবাহ, ধর্মীয় সংস্কারকে আঘাত করা, লেখনীর নতুন বিন্যাস ইত্যাদি সম্পর্কে। কিন্তু তাঁর তো নিজেকে আবিষ্কারের ধরন আছে, লড়াই-সংগ্রাম আছে, আছে নিজের শিকড়ের প্রতি দায়বদ্ধতা। তাঁর সাহিত্যবোধ, দর্শন ও জীবনকে দেখার ধরন নির্ণয় করতে এই রচনায় আমরা ওয়ালীউল্লাহ্র মৃত্যু-পরবর্তীকালে প্রকাশিত দুটি উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করব।ওয়ালীউল্লাহ্ সাধারণত সৃজনশীল লেখালেখি বাংলায় এবং মননশীল লেখা লিখেছেন ইংরেজিতে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আবু শরিয়া ছদ্মনামে তিনি ইংরেজিতেও উপন্যাস/গল্প লিখেছেন। তাঁর এমন একটি উপন্যাস কদর্য এশীয় আর একটি উপন্যাসিকা শিম কীভাবে রান্না করতে হয়। দুটিরই অনুবাদক শিবব্রত বর্মন। শিম কীভাবে রান্না করতে হয় উপন্যাসিকাটি একজন এশীয় কর্তৃক ফ্রান্স ভ্রমণের ইতিবৃত্ত। এর নামের ভেতরই আছে রহস্য, আছে আচরণের নিগূঢ় একেক বিষয়। এখানে ভাষার নতুন কারুকাজ যেমন আছে, রচনার পরাবাস্তববাদী ঢংটিও খুব চমৎকার। এতে কথক কর্তৃক ফ্রান্স যাত্রা আছে। একজন এশীয়র জায়গা থেকে সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতা দেখার কথকতা আছে। এটিই হয়তো সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র শেষ উপন্যাসিকা। তত দিনে তাঁর ভেতর সাম্রাজ্যবাদকে একেবারে স্পষ্টভাবে দেখার বাসনা জাগছে। ফ্রান্সের শিম-রান্না এখানে কার্যত এক প্রতীক, আসল কথা হলো, ঔপনিবেশিক আচরণের সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এখানে তিনি জানাচ্ছেন, একজন এশীয় নিজ ভূমে বা নিজ লোকের সামনে এশীয় হতে পারেন না, অন্যদের সামনে তাঁদের প্রকৃত রূপটি ভেসে ওঠে। এই উপন্যাসিকা সম্পর্কে ওয়ালীউল্লাহ্-বিষয়ক অনুসন্ধানকারী সাজ্জাদ শরিফের বোঝাপড়া এই ফাঁকে দেখে নেওয়া যাক। তিনি জানাচ্ছেন, ‘বর্তমান উপন্যাসিকায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ নেমেছেন সরাসরি ভাঁড়ের ভূমিকায়; একজন প্রাচ্যবাসীর দৃষ্টিকোণ থেকে পশ্চিমের একটি দেশকে হাজির করেছেন উদ্ভট চেহারায়, তার বাইরের চামড়াটির খোলস খসিয়ে দিয়ে।’

কদর্য এশীয় পড়তে পড়তে আমরা পাই সম্পূর্ণ নতুন এক ওয়ালীউল্লাহেক। এ উপন্যাসেও আছে এশিয়ার কথা—এর পূর্বাঞ্চলীয় জনপদের কথা। আছে আমেরিকার কথাও। তবে কার্যত আমরা এখানে এক জনপদের দেখা পাই; এমন একটা সময়কে পাই, যা আসলে গত শতকের পঞ্চাশ দশকের পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান।

এ তো গেল সরল হিসাব, কিন্তু এর ভেতরে যে রাজনীতি ও সময়ের ভ্রাম্যমাণতা আছে, তা যেকোনো পাঠককে চমকে দিতে পারে; এমনকি তাঁকে হকচকিত করে আঁতকেও দিতে পারে। পাঠক, অবাক হবেন এই ভেবে যে সেই পঞ্চাশের দশকের যে দেশটা উপন্যাসে আছে, তা কি এখনকার বাংলাদেশও নয়! সেই একই শাসন, কূটচাল, রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, ষড়যন্ত্রের হুলস্থূল কারবার, বিদেশিদের কাছে মুহুর্মুহু ধরনা দেওয়া—সবই এক। সময় হয়তো পাল্টেছে (নাকি আদৌ পাল্টায়নি?)

উপন্যাসটির শুরু এশীয়ার এক নগরে, যেখানে জনসন নামে এক আমেরিকান সাংবাদিক মূলত দেশটিকে পাঠ করতে আসেন। বদলে-যাওয়া দেশের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক জিইয়ে রাখা যায়, তা-ই প্রকাশ করতে থাকেন ক্ষণে ক্ষণে। এভাবে আসে আমেরিকান যোগসূত্রতা, প্রশাসন, রাষ্ট্রদূত, কনসাল—নানা কর্মকর্তার কথা। পররাষ্ট্রব্যবস্থার বিষয়-আশয় এখানে বেশ নিখুঁতভাবেই আছে। গ্রন্থে উল্লিখিত দেশের শাসনব্যবস্থা—প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী পক্ষ, পূর্বেকার ক্ষমতাবানেরা, এমনকি জনতার কথা ঘুরে-ঘুরে এসেছে। এসেছে এই দেশের জনতার মনোভঙ্গি, তাদের দ্রোহ, নিজেদের মতো দাঁড়ানোর এক কর্মযজ্ঞ। লেখক যেন এখানে নান্দনিক এক গণতন্ত্রীর প্রতিভূ হয়ে বিমূর্ত ভালোমানুষিকেও সাপোর্ট করেন! দেশ আর গ্রাম এখানে আলাদা থাকে না। উপন্যাসে সেনা কর্মকর্তা, প্রশাসন ও পররাষ্ট্রনীতিকে তিনি যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে বিশেষ জরুরি আইনের দেশের নাম তো লুপ্ত রাখাই লাগে! রাজনীতির মারপ্যাঁচ, সেনাছাউনির প্রচণ্ড ষড়যন্ত্র যেভাবে স্পষ্ট হয়, তাতে বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে যে এ দেশের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এক ভয়ংকর ইঙ্গিত উপন্যাসের ভেতর কীভাবে আগাম রাখতে পারলেন ওয়ালীউল্লাহ্!

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

এখানে আছে অতি অল্প সময়ের চরিত্র, আহসান ও তিন্নি। এরা যেন কাঁদো নদী কাঁদোর চৈতন্য মুক্তিজনিত অন্তঃপ্রবাহের একধরনের এক্সটেনশন! ওই উপন্যাসে এই নামে সরাসরি কোনো চরিত্র নেই, তবে এই জনপদের মানুষের জেগে ওঠার আবহ আছে। সেই ধারার চরিত্র হচ্ছে এ দুজন (লালসালুর জমিলা, চাঁদের অমাবস্যার যুবক শিক্ষক আরেফ আলী আর কাঁদো নদী কাঁদোর খোদেজার স্বপ্নসৌন্দর্যের কথাও এখানে বলা যায়), যারা স্বাধীনতা, প্রেম-ভালোবাসার ইশারা রাখে।উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে পাঠক ক্রমশ হতবিহ্বল আর রোদনমুখর হতে বাধ্য হবেন। দেশজ রাজনীতির এমন স্পষ্ট-ইতিহাসমুখর আলামত আর কোনো উপন্যাসে আমরা দেখি না!বইয়ের সবচেয়ে দরকারি দিক হচ্ছে আমেরিকার ব্যাপারে লেখকের নতুন উপলব্ধি। তিনি যেন একজন উচ্চপর্যায়ের সরকারি লোক হিসেবে আমেরিকার লোকজনের অন্তর্জগৎ পাঠ করে যাচ্ছেন। উপন্যাসে দেখা যায়, আমেরিকানরা মনে করছে যেহেতু এশীয়রা ভুখা, অসহায়, বোকাসোকা, কাজেই সেই জায়গাটি দূর করাই তাদের মূল কাজ। তারা মনে করে, সমাজতন্ত্রীরা খুব খারাপ। অনুন্নত দেশের মানুষকে তারা বোঝাতে চায়, স্থানীয় লোকের উন্নয়ন মানে তাদের কিছু সমস্যার উন্নয়ন। কিন্তু তারা তো মানুষের একেবারে অন্তর্জগতে ঢুকতে পারে না। কারণ, সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের সেই সম্পর্ক তৈরি হয় না। কিন্তু সমাজতন্ত্রীদের মাধ্যমে রাশিয়া বা চীন এটি পারে। কাজেই আমেরিকার ভয় সমাজতন্ত্রী রাশিয়া ও চীনকে নিয়ে। কিন্তু আমেরিকান সাংবাদিক জনসনের মাধ্যমে এই উপন্যাসে অন্য এক ভাবধারার প্রচার আমরা দেখতে পাই: মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে, এমনকি কিউবার মতো সমাজ-বদলেও যেন আমেরিকার (!) সহমর্মিতা আছে। নতুবা আমেরিকার পাশের দেশ কিউবার সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বহাল আছে কী করে! তারা এও ভাবে, চীন-রাশিয়া না থাকলেও পশ্চাৎপদ দেশের জনগণের সমস্যা থাকবে, তারা তাদের মুক্তির কথা বলতেই থাকবে!

এ তো গেল একটা দিক। অন্যদিকে আমেরিকা মুক্তবাণিজ্য ও অস্ত্রের ব্যবসা চালু রাখতে চায়। কাজেই সর্বগ্রাসী ব্যবসা আর সহমর্মিতা তো একসঙ্গে টিকতে পারে না। তারা যদি সহমর্মীই হয়, তবে তাদের ব্যবসা আর সাম্রাজ্যবাদী পেষণ চলবে কী করে? এই ধরনের মতদ্বৈধতার ভেতর আমরা এবার যেন পাই ভিন্ন এক ওয়ালীউল্লাহেক। এখানে এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট যে ছোট ছোট দেশ বড় দেশের লীলাক্ষেত্র হয়ে ওঠে।

এই দুই উপন্যাসের মাধ্যমে মেজাজে, বর্ণনায়, দেশজ আবহের বাইরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির দিকে চোখ ফিরিয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। কদর্য এশীয়র ভেতরে সরকারি হম্বিতম্বি, প্রেসনোট, আত্মরক্ষার নামে একধরনের ক্রসফায়ারীয় প্রচারণা, বিরোধী দলের কাঁধে যাবতীয় ষড়যন্ত্রের দায়ভার চাপানোর হাস্যকর কৌশল যেন এক চলমান প্রক্রিয়া, যা কদর্য এশীয়তেই প্রকাশ পায়। এমনকি সমাজতন্ত্রের সেই উত্থানপর্বেও তিনি আশঙ্কা করছেন, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকেই সমাজতন্ত্র বিলোপ হতে পারে। এভাবেই ওয়ালীউল্লাহ্র সাংস্কৃতিক দূরদর্শিতা দেখে সততই অবাক হতে হয়!

এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, কাঁদো নদী কাঁদোতে যে জনপদকে তিনি দেখেছেন, সেখানে বর্ণনার জাদুময়তা আছে, একধরনের অস্তিত্বের প্রকাশ আছে। আর সবচেয়ে বেশি আছে একটি জনপদকে সাংস্কৃতিকভাবে চিহ্নিত করার তীব্র বাসনা। অবহেলিত পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি হচ্ছে উপন্যাসের কুমুরডাঙ্গা নামের জায়গা, আর পশ্চিম পাকিস্তান যেন কামালপুর নামের স্বল্পোচ্চারিত স্থান। সেই যে রাজনৈতিক ধারা তাঁর মধ্যে স্পষ্ট হওয়া শুরু করল, পরের দুই উপন্যাসে এটি একেবারে জীবন্ত হয়ে আছে।

ওয়ালীউল্লাহ্র ভাষা যে ক্রমাগত বদলে যাচ্ছিল, তা তো উপন্যাসগুলোর ধারাবাহিক নির্মাণকৌশল দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু এটা খুবই অবাক হওয়ার মতো বিষয় যে আমরা তাঁকে নানা তকমার আবরণে, খণ্ডিত আলোচনায় বন্দী করে রাখতে চাইলাম। এর কারণ কী? এই যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, জীবনকে তন্নতন্ন করে চেনানো এক কথাশিল্পী, তাঁকে আমরা কেবল কয়েকটা উপমার ভেতর বন্দী করে রাখব কেন? মনে হয়, এও হয়তো একধরনের রাজনীতি, যেই রাজনীতির অপচেষ্টার কথা আমরা তাঁর কাছ থেকেই বারবার পাঠ করি।