সোজা বাংলায় কথাটির অর্থ দাঁড়ায়, ‘এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি।’ কবি লর্ড বায়রন বলেছিলেন কথাটি। ১৮১২ সালে ‘চাইল্ড হ্যারল্ডস পিলগ্রিমেজ’ কবিতাটি প্রকাশের পর কবি হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে এ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন বিস্মিত বায়রন। বাংলা সাহিত্যে ঠিক এ রকমই ঘটনা ঘটেছিল কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় কবিতাটি মুদ্রিত হলে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। তবে কোনো এক তথ্যমতে, ‘মোসলেম ভারত’ কার্তিক ১৩২৮ সংখ্যায় এটি ছাপা হয়েছিল। প্রায় কাছাকাছি সময়ে ‘প্রবাসী’, ‘সাধনা’, ‘ধূমকেতু’ ও দৈনিক ‘বসুমতী’সহ বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় কবিতাটির পুনর্মুদ্রণ হয়। একই কবিতা এত বেশিসংখ্যক পত্রপত্রিকায় প্রকাশের ঘটনাও সম্ভবত এটিই প্রথম। কাব্য সমালোচক শ্যামাপদ চক্রবর্তীর মতে, ‘বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে কবি নজরুলের সৌভাগ্য আর কারুর হয়নি।’ কারণ, বায়রন এক সকালে ঘুম থেকে জেগে সবিস্ময় যে খ্যাতির দেখা পেয়েছিলেন, সেটা পেতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল জীবনের মধ্য পর্ব পর্যন্ত, কিন্তু নজরুলের কবিতার শিরোনাম আর নিজের নাম যখন একাকার, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২।
প্রকাশমাত্র কবিতাটির পাঠকসংখ্যা কত ছিল? নজরুলের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ ও ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইয়ের লেখক মুজফ্ফর আহমদ বলছেন, ‘শুনেছিলেম সেই সপ্তাহের সাপ্তাহিক “বিজলী” দুবারে উনত্রিশ হাজার ছাপা হয়েছিল।...ধরতে পারা যায় প্রায় দেড় দুলক্ষ লোক কবিতাটি পড়েছিলেন।’ অর্থাৎ এই একটি কবিতা নজরুলকে যে খ্যাতি ও পরিচিতি দিয়েছিল, তার সঙ্গে তুলনা করার মতো ঘটনা যে বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি নেই, এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। সুতরাং এর মাত্র দুই বছর পর ‘দলমাদল’ নামের একটি ঐতিহাসিক কামানের গায়ে হেলান দেওয়া কবির যে প্রতিকৃতি ছাপা হবে, সেই বিদ্রোহীর বিগ্রহটিই বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে, তাতে আর সংশয় কী?
প্রকাশমাত্র কবিতাটির পাঠকসংখ্যা কত ছিল? নজরুলের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ ও ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইয়ের লেখক মুজফ্ফর আহমদ বলছেন, ‘শুনেছিলেম সেই সপ্তাহের সাপ্তাহিক “বিজলী” দুবারে উনত্রিশ হাজার ছাপা হয়েছিল।...ধরতে পারা যায় প্রায় দেড় দুলক্ষ লোক কবিতাটি পড়েছিলেন।’ অর্থাৎ এই একটি কবিতা নজরুলকে যে খ্যাতি ও পরিচিতি দিয়েছিল, তার সঙ্গে তুলনা করার মতো ঘটনা যে বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি নেই, এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।
‘বিদ্রোহী’ লেখার আগে অবশ্য নজরুল সাহিত্য সমাজে নিতান্ত অজ্ঞাতপরিচয় ছিলেন—এ কথা বলা যাবে না। বরং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর গল্প, কবিতা ইত্যাদি প্রকাশিত হলে পল্টনফেরত এই সৈনিক কবিকে নিয়ে অনেকের মধ্যেই আগ্রহ ও কৌতূহল জন্মেছিল। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ‘মোস্লেম ভারত’ পত্রিকায় নজরুলের কবিতা পড়ে এই কবি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় এই উদীয়মানকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিলেন। এই সাক্ষাৎ নজরুলের জীবনে সুদূর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল বলে জীবনীকারদের অনেকের ধারণা। তার মানে প্রতিভার প্রকাশ তাঁর ঘটেছিল আগেই। তবে ‘বিদ্রোহী’র অপূর্ব সাহস ও শৌর্যের বাণী, তাল ও ছন্দ যেন ঢেউয়ের আঘাতে জাগিয়ে তুলেছে পাঠকহৃদয়, সেই ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গেছে জনচিত্ত।
১৯২১ সাল নজরুলের জীবনে দুটি কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ—নার্গিস ও ‘বিদ্রোহী’!
এ বছরের এপ্রিলে অগ্রজতুল্য বন্ধু আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে তাঁর বাড়ি কুমিল্লার দৌলতপুরে বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে আলী আকবরের ভাগনি সৈয়দা আসার খানমের (নজরুল নাম দিয়েছিলেন নার্গিস) সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেই প্রথম প্রেম ও বিহ্বলতার স্পর্শ লেগে আছে তাঁর অনেক গান-কবিতায়। কিন্তু মিলনের পূর্ণতা পায়নি এই প্রেম। জুনের ১৭ তারিখ বিয়ের পিঁড়িতে বসেও কিছু রহস্যময় কারণে নার্গিসের সঙ্গে চিরস্থায়ী বিচ্ছেদের বেদনাকে সঙ্গী করে কলকাতা ফিরেছিলেন কবি। সে অন্য প্রসঙ্গ। তবে ভেবে নেওয়া স্বাভাবিক, এরপর তরুণ কবির সব কাব্য-গানে উত্কীর্ণ হবে চিরন্তন বিরহের হাহাকার। কিন্তু মানুষটির নাম নজরুল। তাই ব্যর্থ প্রেমের ভস্মস্তূপ থেকে যেন ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠলেন তিনি। ডিসেম্বরে রচিত হলো ‘বিদ্রোহী’।
উত্তম পুরুষের এই কাব্যিক বয়ানে আগুন ছিল, সেই আগুনের উত্তাপ স্পর্শ করেছিল পাঠককে। ব্রিটিশ শাসনাধীন স্বদেশে নিগৃহীত, অপমানিত মানুষ নিজের অব্যক্ত ক্ষোভের প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছিল এ কবিতায়।
কুমিল্লার দৌলতপুর পর্ব যে তিনি বিস্মৃত হননি, তার ছায়াও যেন লক্ষ করা যায় কিছু পঙ্ক্তিতে:
‘আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী–নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
…আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত– চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর–থর–থর প্রথম পরশ কুমারীর!’
প্রেম ও বিদ্রোহ এখানে একাকার। অবশ্য প্রেমের প্রেরণা ও প্ররোচনা ছাড়া কখনোবা বিদ্রোহ এমন তীব্র রূপ পেয়েছে, তা সে ব্যক্তিপ্রেমই হোক বা স্বদেশপ্রেম। সুতরাং দুকূলপ্লাবী এই কবিতা প্রকাশের পর এক সকালে সবিস্ময় কবি যে নিজেকে বিখ্যাত হিসেবে দেখতে পাবেন, তা তো অনিবার্য। কবিতাটি পড়ে শোনানোর পর রবীন্দ্রনাথ যে নজরুলকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন—এমন তথ্যও আমরা পাই মুজফ্ফর আহমদের ‘স্মৃতিকথা’ বইয়ে।
রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে থাকতেন যে কবি যশোপ্রার্থীরা, নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় যাঁদের ‘অনুচর তথা ভক্তজন’ বলে তীব্র ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করেছেন, তাঁদেরই একজন মন্তব্য করেছিলেন, ‘মার মার কাট ও অসির বনাঝনার মধ্যে রূপ ও রসের প্রক্ষেপটুকু হারিয়ে গেছে।’ এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এ-ও তোমাদের আবদার বটে। সমগ্র জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করবে বৈকি! আমি যদি আজ তরুণ হতাম, তাহলে আমার কলমেও ওই সুর বাজত।’ (‘কবি-স্বীকৃতি’, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়)।
তবে যেকোনো সাফল্যেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। নজরুলের ক্ষেত্রেও এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। একদিকে পাঠকমহল উচ্ছ্বসিত–অভিভূত, অন্যদিকে চলছে কবির ওপর চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ আর তাঁর ‘ধৃষ্টতার’ সমালোচনা। নজরুলের এককালের শুভাকাঙ্ক্ষী ও পরবর্তীকালে শত্রুভাবাপন্ন কবি মোহিতলাল মজুমদার অভিযোগ করলেন, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি তাঁর গদ্য রচনা ‘আমি’র ভাব চুরি করে লেখা। কিন্তু ‘আমি’ ও ‘বিদ্রোহী’র মধ্যে ভাবের যে বিরাট দূরত্ব, সাহিত্য-পাঠক তা অনায়াসেই শনাক্ত করতে পারবেন। তার চেয়েও বড় কথা, দুজনের লেখা দুটি ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশিত। গদ্যের ভাব চুরি করে কবিতা রচনার জন্য অভিযুক্ত হওয়া বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এমনকি একটি গদ্যের দ্বারা প্রভাবিত হলেও এ রকম কবিতা রচনার জন্য যে অসাধারণ কাব্যপ্রতিভার প্রয়োজন পড়ে, তার স্বীকৃতিটুকু দিতেও মোহিতলাল ভুলে গেছেন ঈর্ষাবশত।
শুধু মোহিতলাল নন, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর কবি-লেখকদের মধ্যে অনেকেই প্রকাশ করেন বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকার সম্পাদক আবদুল হাকিম রীতিমতো অশালীন ভাষায় নজরুলকে আক্রমণ করেন ‘বিদ্রোহ দমন’ শিরোনামের একটি কবিতা লিখে। মোহাম্মদ গোলাম হোসেন নামের একজন কবি একটি কবিতা লেখেন, যার শিরোনাম ছিল ‘বিদ্রোহী এক ইবলিস’। নজরুলের কাছের লোকদের মধ্যে কবি গোলাম মোস্তফা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ব্যাঙ্গাত্মক প্যারোডি রচনা করেন ‘নিয়ন্ত্রিত’ শিরোনামে। তবে এই ঈর্ষাকাতরদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি প্রতিভাবান ছিলেন ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ দাশ পর্যন্ত কেউই যখন তাঁর তীব্র ব্যঙ্গ–বিদ্রূপের হুল থেকে রেহাই পাননি, সেখানে নজরুলই-বা ছাড় পাবেন কেন? তিনি লিখলেন ‘ব্যাঙ’ নামের একটি প্যারোডি:
‘আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাঙ
ভৈরব রবসে বরষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাঙ
আমি পথ হতে পথে দিয়ে চলি লাফ
শ্রাবণ নিশার পরশে আমার সাহসিকা
অভিসারিকা
ডেকে ওঠে “বাপ বাপ”।’
কিন্তু সময় থেমে থাকেনি। যাবতীয় বাকবিস্তার আর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। ‘বিদ্রোহী’ হারায়নি। লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে অসম্মান ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো মানুষের সাহসের উচ্চারণ হয়ে উঠেছে:
‘শির নেহারি’ আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!’
১০০ বছর পরও আজ বিস্ময় মানি, কোথাও এতটুকু মরচে পড়েনি—একটি বাক্য, এমনকি একটি শব্দেও। একটুও ক্ষয়ে যায়নি সেই সুর, তাল ও ছন্দ!