যে চায় সে যায়

অলংকরণ: অশোক কর্মকার
অলংকরণ: অশোক কর্মকার

একদিন বেলা হয়ে গেলেও অনি ঘর থেকে বেরোয় না। অনির রুদ্ধ দ্বারের খবর কেউ জানে না। কে কার খবর রাখে! অনি একাই; যেমন প্রতিটি ছোট ঘরে প্রত্যেকে একা, যে যার মতো। কেউ ফোন করবে, এমন সম্ভাবনাও নেই। আজকাল কে কাকে ফোন করে? বাস্তবে দেখা হওয়াও প্রাচীন ব্যাপার। এমনকি বন্ধুত্ব বা প্রেমের দেখা-সাক্ষাৎও না। একাকিত্বে ছেদ পড়ার ঝামেলা আছে, নানান ছোঁয়াচে রোগের ভয় আছে। এ রকম অবস্থায় এক অনির অনুপস্থিতি ধরা কারও পক্ষে অসম্ভব। কদিন বাদে বাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপস্থিত হলে সেটাই তার বেঁচে থাকার প্রমাণ। অনির সঙ্গে সামান্য কথাবার্তা হয়েছিল, এমন একজন আবিষ্কার করে বারো দিন অনিকে অনলাইনে দেখা যায়নি। কিন্তু সে-ই বা তার জায়গা থেকে কী করতে পারে? বড়জোর একটা স্ট্যাটাস দেয়, জানায় যে অনির অনুপস্থিতি তাকে ভাবাচ্ছে। দাবি রাখে যে অনিকে খুঁজে বের করা উচিত। জানা উচিত, অনি কি বিষণ্ন? সে কি বিপদগ্রস্ত? তাকে সাহায্য করা উচিত। বলতে বলতে সে এটাও বলে ফেলে যে, সরকারি সহায়তার দরকার, পুলিশ যেন অনিকে খুঁজে বের করে। লম্বা-চওড়া আবেগমাখানো স্ট্যাটাস দেওয়ার পরে তার বুকটা হালকা হয়। অনির হারিয়ে যাওয়া নিয়ে যে দুশ্চিন্তা বা কষ্টের চাপ তৈরি হয়েছিল, তা-ও কমে আর প্রতিবাদ করার জন্য মনটা যে আঁকুপাঁকু করছিল, সেটাও শান্ত হয়।
মিডিয়ায় এখন আর কোনো গুম-অপহরণের খবর নেই। মানে, পত্রিকার লোকেরা এখানে-ওখানে মানুষের হাওয়া হওয়াকে এতটাই সাধারণ আর সামান্য কারণে ঘটা বলে মনে করছেন যে অহেতুক রিপোর্ট ছাপিয়ে পত্রিকার কলাম খরচ করতে চাচ্ছেন না। এমনিতেও দেখা যাচ্ছে, যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো হরহামেশাই গুমের দায় টেলিপোর্ট কলের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে অবশ্য কয়েকজনের পরিবারের সদস্য মিনমিন করে বলার চেষ্টা করেছিল যে অমুক দিন তমুক সময়ে তাকে ফোন দিয়ে কি বাড়ি বয়ে এসে অমুক কাজের কথা বলে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তারপর থেকেই সে লাপাত্তা। তমুকের বাড়িতে গিয়ে পুলিশ হানা দিচ্ছে না কেন? অমুককে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে না কেন? প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের লোকদের মধ্যে যে এসব ঘটেই থাকে, পুলিশ কি তা ভুলে গেছে? পুলিশ অবশ্য এ সমস্ত কথা গা করেনি। আর এ রকম কথা বারবার বলতে থাকলে তারা মিটিমিটি হাসে। তারপর হাসি থামিয়ে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে কালো কুচকুচে কাঠের আলমারি খুলে ঝকঝকে কোনো ফোনসেট বের করে আনে। বলে, এই দেখেন, এই ফোনটা ব্যবহার করছিল, তারপর থেইকাই উধাও। ফোন আমরা জব্দ করছি কিন্তু ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাসওয়ার্ডের জন্য ম্যাসেঞ্জারে ঢোকা যাইতেছে না। আঙুল তো ফালাইয়া যায় নাই, তাইলে এখন কী কইরা জানব কই রওনা দিছে? তা ছাড়া জব্দ করা ফোনসেটের পরে আর কী প্রমাণ চান? আত্মীয়স্বজনেরা তখন বিভ্রান্তিতে পড়ে। হ্যাঁ, আপনজন, যাকে তারা খুঁজছে, ফোনটা তারই বটে। তবে ওটা কি থানার ওই কালো আলমারিতেই পড়ে থাকবে? পুলিশের কাছে ফেরত চাওয়া যায় না। প্রমাণ হিসেবে সংগ্রহ করা আলামত তারা হাতছাড়া করবেই-বা কেন! আশায় আশায় আত্মীয়রা দিনের পর দিন থানায় ধরনা দেয়। বন্ধ ফোনটা কখনো তাদের দেখার সুযোগ হয়। তারপর তাদের জুলজুল চোখের সামনে থেকে তা আবার ঢুকে যায় কালো আলমারিতে। মামলা ডিসমিস। পুলিশরা আলমারিতে তালা লাগিয়ে দিয়ে বলে, যান যান, কোনো খবর পাওয়ামাত্রই জানবেন। আমরা তলে তলে কাজ করতেছি না, তা না। আত্মীয়েরা মুখ শুকনো করে বাড়ি ফেরে। ঘর খালি হতেই পুলিশরা গরম গরম পরোটা-মিষ্টি খেয়ে টেবিলের ওপর পা তুলে দেয় ঘুম। কী মজা! সামান্য কিছুদিন আগেও গুম আর অপহরণ কেসের যন্ত্রণায় তাদের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিক দল সামলাও, সরকার সামলাও, অপহৃতের আত্মীয়স্বজনকে শান্ত করো আর আশার আলো দেখাও, আবার অপহৃত ব্যক্তিকেও অক্ষত অবস্থায় খুঁজেও বের করো...এত কিছুর পরে কোন পুলিশ পেটে দুটো ভাত দিয়ে একটা আরামের ঘুম ঘুমাতে পারত? তার ওপরে নানান সমাজসচেতন প্রতিষ্ঠানের চাপ ছিল। অপহৃত মানুষটিকে খুঁজে এনে পরিবারের হাতে তুলে দিলেই তো হলো না, অপরাধীদের শাস্তি চাই। তাদের ধরতে পারা যাচ্ছে না কেন? কেন তারা দিনের আলোয় শহরের ব্যস্ত এলাকায় ঘোরাফেরা করছে? কিন্তু সে যা-ই হোক, ম্যাসেঞ্জারে ভিডিও কলের জনপ্রিয়তার পরে এক লাফে টেলিপোর্ট কলটা চালু হওয়াতে পুলিশ, সাংবাদিক—সবার মনে স্বস্তি নেমে এসেছে। কেউ হারিয়েছে শুনলেই এখন তারা ছোট্ট হাই তুলে বলতে পারে, দেখেন গিয়া কুনখানে কার লগে কী করতেছিল, তারপর তার দিকে উইড়া গেছে আরকি।
অনির অনুপস্থিতিতে স্ট্যাটাসের পর স্ট্যাটাস চলে, মুহূর্তেই লাখো শেয়ার হয়ে যায়। কেউ বলে, তিনি যে কত ভালো মানুষ ছিলেন! আমাকে বরাবর লাইক দিতেন। আহা, আমার একটা লাইক কমে গেল। কেউ বলে, নেটওয়ার্কে যে ষাট মিলিয়ন মৃত মানুষের অ্যাকাউন্ট আছে, অনিও কি সেই দলে যোগ দিল? পরপরই মন্তব্যের ঘরে হা-হুতাশ শুরু হয়।
ছোটবেলায় কিছুদিন পরিবারের সঙ্গে থাকত অনি। বাবা-মা আর কালেভদ্রে দেখা কিছু আত্মীয়স্বজন ছিল। বাবার সঙ্গে মায়ের বনেনি, মায়ের সঙ্গে বাবার। তাঁদের প্রজন্মের জন্য এটা ছিল স্বাভাবিক। তখনকার দিনে ‘বিয়ে’ নামের সম্পর্কে মহামারি আকারে চিড় ধরেছে। বাবা-মা গেছেন যে যাঁর পথে। আর অনি খানিকটা বড় হওয়ার পরে নিজের রাস্তায়। উৎসব-উপলক্ষ ছাড়া তাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার কারণ নেই। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ফোন করাটাও অভদ্রতা। কারও ব্যক্তিগত জীবনে হুটহাট ঢুকে পড়া দরজা ভেঙে অনধিকার প্রবেশের মতো। বাবা-মা আর সন্তান, তাতে কী, প্রত্যেকে একেকজন পরিণত মানুষ বলে কথা। অনিকেও তাই কেউ ফোন করে না। কেউ জানতে পারে না অনি রাতারাতি উবে গেছে।
এমনটা কেবল এই যুগেই হচ্ছে, তা নয়। সেই উনিশ শতকের শেষের দিকেও অনেক জায়গায় হরহামেশা হতো। আমেরিকায় একবার এক নারী মারা যাওয়ার তিন বছর পরে বাড়ির দরজা ভেঙে দোলানো চেয়ারে কঙ্কালটা বসার ভঙ্গিতে আবিষ্কার করা হয়েছিল; সামনে টেলিভিশন চলছিল। ভাগ্যিস বহুদিনের বিদ্যুৎ বিল বাকি পড়েছিল, নইলে কে আসত নিঃসঙ্গ নারীর খোঁজে? অনির ভাগ্যে সেটুকুও নেই। তার সমস্ত বিল ব্যাংক থেকে সরাসরি চলে যায়, যেখানে যা যাওয়ার। বাড়তি কোনো কাজ নেই জীবনে, নেই বাড়তি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ। অথচ ম্যাসেঞ্জারে টেলিপোর্ট কল চালু হওয়ামাত্রই যুগের হাওয়া বদলে মানুষ সমানে ওড়া শুরু করল। দেখা হওয়া আর ছোঁয়াছুঁয়ি যেন আবারও আগের মতো জরুরি হয়ে উঠল। মানুষের পছন্দের ধারা বা চর্চা এভাবে যে ফিরে ফিরে যায়-আসে, সে জানা কথা। একসময় তারা চিঠি লিখে মনের কথা বলত, ডাকে ফেলে উত্তরের অপেক্ষা করত, সেখানে ঘরে ঘরে ফোন এসে তা কমিয়েছিল। অথচ স্মার্ট ফোন হাতে পেলে তারা কথার বদলে আবারও লিখে লিখে ভাব জানানো শুরু করল। শেষে টেলিপোর্ট কল চালু হওয়াতে লেখার জায়গায় আবারও ‘দুজনে মুখোমুখি’ হওয়ার দিন ফিরে এল। কে যে ‘কল’ ছুঁয়ে কোথায় চলে যাচ্ছে, কোনো হদিস নেই। এসবে কারও কিছু বলার নেই; মুক্তচিন্তা, মুক্তমতের যুগ। যুগ নিজের জীবনে নিজস্ব ভাবনা প্রয়োগের। কে কখন কার কাছে যাবে, কেন যাবে আর কতক্ষণ থাকবে—সে তার নিজস্ব ব্যাপার। কেউ কাউকে আদেশে কি আদরে কিছু করতে বাধ্য করত, কোনো সম্পর্ক কাউকে কারও সঙ্গে থাকতে বাধ্য করত, সেসব অনেক আগেকার নিয়ম। মনে মনে অতীতে পড়ে থাকা দু-চারজন মানুষ ছাড়া সেসব কেউ মনে রাখেনি।
শুরু থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে তুমুল সমালোচনা। তরুণেরা সব নষ্ট হয়ে গেল; বয়স্করাও কম হলো না। জরিপে প্রমাণ করা হলো ডিভোর্সের প্রধান তিনটি কারণের একটি ওই মাধ্যম। তুমুল সমালোচনা। কিন্তু বিয়ের সম্পর্কই যেখানে উঠে গেছে, সেখানে এখন এটা অতীতের সামান্য ঘটনা। আমেরিকানরা এ রকম নানান জরিপ শুরু করে অথচ দিন শেষে দেখা যায় তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যত মানুষ ভোট দেয়, তার চেয়ে ওই মাধ্যমে ব্যস্ত বেশি। ওদিকে চীনে মাধ্যমটি বন্ধ রাখার পরেও ব্যবহারকারী এক শ মিলিয়নের বেশি। এই অবস্থায় নতুন জিনিস না দিয়ে উপায় আছে? তাই তো টেলিপোর্ট কল এল। আহা...কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। তবে মনে মনে নয়, টেলিপোর্টে। সাক্ষাতের আনন্দ ভুলে যাওয়া মানুষকে সামাজিক হতে বাধ্য করতে ম্যাসেঞ্জারের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে দিন কয়েকেই যানবাহনের প্রয়োজন ফুরোল, পরিবহন আর আকাশপথের শিল্পে লালবাতি জ্বলল। লাখ লাখ মানুষ বেকার হলো। অস্বাভাবিক নয়; অতীতে ক্যাসেট কি কাগজ কিংবা তার লাগানো টেলিফোনের ব্যবসার প্রয়োজন ফুরোয়নি? ওদিকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে। দেশের সীমানা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। হাইকমিশনে লোকজন নাক ডেকে যেমন ঘুমোচ্ছে, তেমনি চাকরির স্থায়িত্ব নিয়েও শঙ্কিত দিন কাটাচ্ছে।
মাসখানেক পরে অনির অনুপস্থিতি তার বোন কোনির কাছে প্রকট হয়, তার নিজের জন্মদিনে। অনির ফোনে টেলিপোর্ট কল করে বারবার ব্যর্থ হয় সে। কখনোই দেখা-সাক্ষাৎ হয় না এমন সম্পর্ক তো নয় তাদের! বছরে দুজনের দুটো জন্মদিনে নিদেনপক্ষে মুখ দেখাদেখি আর গিফট চালাচালি চলে। পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে অনির খবর নেই জেনে সে আতঙ্কিত হয়। ভুল ডিজিটে আঙুল পড়ে শত্রুপক্ষের কাছে পৌঁছে খুন হওয়া কিংবা মধ্যরাতে সাহারা মরুভূমি কি তুষারঝড়ের মাঝপথে অ্যান্টার্কটিকে উপস্থিত হওয়া বিচিত্র নয়। ভুলেভালে বহু মানুষ মারা পড়েছে, এ কথা সবার জানা। খামোখা সামাজিক হেনস্তার ঘটনাও ইদানীং কম ঘটেনি। কোনির পরিচিত এক লোক গভীর রাতে এক মেয়েকে ফোন করে ফেলেছিল। মেয়েটাও তন্দ্রা কাটিয়ে কল রিসিভ করে ফেলেছে। তারপর যা হওয়ার, পাশে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটার বডিবিল্ডার পার্টনার লোকটাকে আচ্ছামতো পিটিয়ে বাড়ি থেকে খেদিয়েছে। কনকনে শীতে ভোরের আলো ফোটার ভয়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল কেবল আন্ডারওয়্যারে উপস্থিত হওয়া অতিথিকে। ওদিকে কোনির এক বন্ধু অতিরিক্ত মানুষে ঠাসা লিফটের মধ্যে কল রিসিভ করে বিশালদেহী স্থূল এক মহিলাকে এনে উপস্থিত করেছিল। আর যায় কোথায়, তেরো তলা থেকে লিফট খসে সোজা পড়েছিল মাটিতে। তেরোজন মানুষের হাতে-পায়ে এমন প্যাঁচ লেগে গিয়েছিল যে ছোটানোর পরে দেখা গেল, অন্তত পাঁচজনের জন্য আজীবনের পঙ্গুত্ব লেখা হয়ে গেছে। শোনা ঘটনাগুলো দিনভর মাথায় আনাগোনা করে কোনিকে ব্যস্ত আর চিন্তিত রাখে। শেষে পুলিশের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। দরজা ভেঙে অনির বেডরুম থেকে যথারীতি বন্ধ হয়ে থাকা ফোনটা আবিষ্কার করে তারা। বুঝতে আর বাকি থাকে না যে টেলিপোর্টের ক্যারিশমাই অনির উধাও হওয়ার কারণ। উল্টো দিক থেকে কলটা রিসিভ করার পরে কেটে দিলেই অনি ফিরে আসত। কিন্তু ফোন বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে অনির আসার পথ বন্ধ হয়ে গেছে, সেটা নিশ্চিত। ফোনের চার্জ বন্ধ হয়ে চলতে থাকা কলটা কেটে গেছে। টানা দশ দিন চলার প্রতিশ্রুতি দেওয়া ব্যাটারি একসময় হার মেনেছে। সোলার পাওয়ার কাজে লাগিয়ে চলা ফোনটা মাটির নিচে মাইনাস—তৃতীয় তলার ঘরে আলোর অভাবে একসময় মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে। পুলিশের লোকেরা দায়িত্বহীন নয়, ফোনে চার্জ দিয়ে শেষ কল নির্ভুলভাবে খুঁজে বের করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। কোনিও বসে থাকে না। পরিচিত উপরওয়ালাদের প্রভাব খাটিয়ে যতটুকু সম্ভব করতে থাকে। দুর্ধর্ষ এক রাজনীতিকের আদেশে অনির বাসার দরজা বা ফ্রিজের হাতল কিংবা আলমারির ঝুলতে থাকা চাবি থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করা হয়। আঙুলের নকশাটা হুবহু তুলে নিয়ে রাবারের কৃত্রিম আঙুল বানাতে সময় লাগে না বেশি। তারপর আর কিসের অপেক্ষা, ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাসওয়ার্ড দিয়ে সোজা ম্যাসেঞ্জারে। হ্যাঁ, শেষ কলটা অনিই করেছে, করেছে ইরিনা নামের একজনের কাছে। পুলিশ সেই কলের কোনো লোকেশন বের করতে পারে না। হাজারবার কল করেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় শেষ কলের সময়ে অনিকে খুশি খুশি দেখায়, আবেগে উপচে পড়া টলটলে চোখজোড়া কোনির চোখ এড়ায় না। হয়তো খুব ছোটকালে শরীরে শরীরঘেঁষা কোনো আদরের মুহূর্তে মায়ের সামনে অনির এমন জ্বলজ্বলে চোখ দেখেছিল সে। স্কুলে বা রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে বাচ্চাদের গায়ে হাত রেখে আদর নিষিদ্ধ হওয়ার বহু আগের কথা সেটা। অনি কি টেলিপোর্টের মাধ্যমে কাউকে ছুঁয়ে দেওয়ার কথা ভাবছিল? রিওয়াইন্ড করে তিন শ পার্সেন্ট জুম করা অনির চোখগুলো দেখতে থাকে কোনি। গায়েব হওয়ার আগমুহূর্তে রাজ্যের গোপন আকাঙ্ক্ষা যেন বুনে দেওয়া হয়েছে ছোট্ট পুকুর দুটোতে। বহুকাল পরে ঢালু গাল বেয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু কোনির রেকসিনের জ্যাকেটে পড়ে গড়িয়ে যায়।
ক্ষমতাবান কাউকে ঠিকঠাক ধরতে পেরেছিল কোনি। তার তদারকিতে স্যাটেলাইটের মেমোরি থেকে ইরিনার সঙ্গে অনির আবেগপ্রবণ সম্পর্কটা সামনে আসে। বিস্মিত হয় কোনি তার আপন ভাই কি না এই যুগে দাঁড়িয়ে প্রেমের সম্পর্কের মতো একটা বস্তাপচা বিষয়ের দিকে ঝুঁকেছিল! যা হোক, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ইরিনার কোনো হদিস পাওয়া যায় না। তবে পুলিশের তৎপরতায় বহুদিন পরে একটা গুম কেসের সুরাহা হবে ভেবে মিডিয়া নড়েচড়ে বসে। সাদাচোখে কিডন্যাপই। প্রেমের সাক্ষাৎ হলে এভাবে না বলেকয়ে উধাও হওয়ার কথা নয়। কোনি বাজি রেখে বলতে পারে যে তার ভাই, অনি আর যা-ই হোক, বিনা নোটিশে হুট করে মিলিয়ে যাওয়ার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন নয়। কোনির দাবি কিডন্যাপার হলো ইরিনা। কিডন্যাপের বিষয়টা নিশ্চিত হওয়া যায় যখন অনির বোন হিসেবে কোনির পরিচয় সামনে আসে; কোনিকে লক্ষ্য করে কিডন্যাপারের দাবিদাওয়া আসতে শুরু করে। কোনি যখন তাদের সঙ্গে দামদর করছে আর পুলিশ যখন হন্যে হয়ে ইরিনাকে খুঁজছে, তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে দিশাহারা মেয়েটি থানায় হাজির। চারদিক থেকে তিরের মতো ছুটে আসা অভিযোগের মাঝখানে ইরিনা কোনো রকমে নিজের কললিস্ট দেখাতে সক্ষম হয়। অনির শেষ টেলিপোর্ট কলের তিন ঘণ্টা আগেও ইরিনার সঙ্গে কথা বলেছিল সে। কথা ছিল ঘণ্টা তিনেক পরেই ইরিনার কাছে উড়ে যাবে। অনিকে প্রথম ছুঁয়ে দেবে ভেবে উত্তেজিত ইরিনা অপেক্ষায় ছিল। কয়েক দিন অপেক্ষা করেছে। ক্রমাগত ব্যস্ত পেয়েছে অনির টেলিপোর্ট আর ঘর বন্ধ করে কেঁদেছে। বলতে বলতে ইরিনা সত্যিই কেঁদে ফেলে। আবেগ-অনুভূতির পরাজয় আর কাঠখোট্টা যুক্তির উত্থানের সময়টাতে ভালোবাসার মানুষের জন্য ইরিনাকে এতটা ভেঙে পড়তে দেখে উপস্থিত মানুষগুলো বিস্মিত হয়। আরও চমকদার হয় একটি বিষয়, ইরিনার যে নম্বরে বরাবর অডিও কল করত অনি, শেষের টেলিপোর্ট কলটা সেই নম্বরে নয়। লিস্টে কেবল নামটাই ইরিনার। ঘরভর্তি মানুষ একযোগে ভাবতে থাকে ইরিনার নামে নিজের ফোনে অন্যের নম্বর কেন সেভ করেছিল অনি?
মানুষের মনে মনে প্রশ্ন ঘোরে ফেরে। উত্তর মেলে না। ইরিনা জড়িত নাকি নির্দোষ? কোনো সমাধান আসে না। তবে সবই সময়ের ব্যাপার মাত্র। এক বর্গইঞ্চি জায়গাও তো নেই সিসিটিভি যাকে নিজের আওতায় নেয়নি। ক্লিপ ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে খোলাসা হয় রহস্য। কিডন্যাপের জন্য এখন আর লোকালয়ের মধ্যে আস্ত মানুষটাকে তুলে নেওয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে হয় না। জীবন সহজ হয়েছে সবার জন্যই। ক্লিপে স্পষ্ট দেখা যায় অফিসের টেবিলে অনির না থাকার সুযোগে ফেলে রাখা ফোনে কেউ একজন খোঁচাখুঁচি করছে। ফোনের কল লিস্ট থেকে কাকে অনি সবচেয়ে বেশি ফোন করে তা বের করতে সময় লাগে না। তারপর ইরিনার নম্বরের জায়গায় অন্য নম্বর ঢুকিয়ে দেওয়ার পালা। সব মিলিয়ে কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা। সত্যি, তিন ঘণ্টা এইটুকু কাজ করার জন্য অনেক বেশি সময়। নিজচোখে দেখার পরে কোনির নিজের কাছে বোকা বোকা লাগে। অনির জন্য অসহায় লাগে। রাস্তায় বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় সে। সবে অন্ধকার হয়েছে। বৃষ্টি হয়ে যাওয়া পিচের রাস্তায় আশপাশের আলোর তির্যক ছায়া দেখা যায়। কখনো ওখানে ছায়াগুলো ভেঙে শত শত গাড়ি চলত, বাসের গায়ে ঠাস ঠাস চাপড় শোনা যেত, অস্থির মানুষেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে আটকে থেকে নিজেকে বাদ দিয়ে বাকি সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলত। মানুষের কোলাহলে কান রাখা দায় ছিল তখন। এখন কেবল আবেগ কেড়ে নেওয়া যায়নি, এমন কেউ হঠাৎ বাতাস কেটে গাড়ি ছোটায়। মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে তেমনই বাতাস চিরে কোনি একটা চিৎকার দেয়।
শীতল এক ঘরে তার চেয়েও শীতল মেঝের ওপরে উপুড় হয়ে অনি শুয়ে থাকে। হাত-পা তারজাতীয় কিছু দিয়ে বাঁধা। মেঝের সঙ্গে সেঁটে থাকতে থাকতে বুক আর পেট ঠান্ডা হতে হতে অনুভূতিবিহীন। ঘরটা হয়তো অনেক নিচে। মাইনাস সাত কি আট তলা হতে পারে। ঘুরঘটি অন্ধকার। তাই ঘরে আর কেউ বা কিছু থাকলেও নেই, না থাকলেও নেই। কেউ আসবে, কেউ উদ্ধার করবে অপেক্ষার ভারে শরীরে ঝিঁঝি ধরে। কখনো কাঁপুনি দেয় শীত। অথচ তার ভেতরেও কেন যেন কারও স্পর্শের কথা ভাবলে অদ্ভুত উষ্ণতা শরীরটাকে ঘায়েল করে ফেলে। কে সে ইরিনা? নাকি বহু বছর আগে কাঁধ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মা কিংবা কোনির হাত? কেবলই মনে হয় প্রতিটা স্পর্শের সুর এক। দীর্ঘকাল স্পর্শসুখবঞ্চিত শরীর যেন প্রতিটা ছোঁয়া একইভাবে চায়। বহুদিন পরে শরীর দিয়ে তীব্রভাবে কাউকে অনুভব করতে ইচ্ছে করে। প্রতীক্ষাটা মধুর লাগে। টেলিপোর্টের মতো আকাশ ফুঁড়ে যেন কেউ আসবে, ঘোর অন্ধকার থেকে বাঁচাবে আর খুব করে ছুঁয়ে দেবে।