রণদাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য

রণদা প্রসাদ সাহা স্মারকগ্রন্থ
আনিসুজ্জামান, প্রতিভা মুৎসুদ্দি ও অন্যান্য (সম্পাদিত)
সাহিত্য প্রকাশ
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
দাম: ১৫০০ টাকা

প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী

অবিভক্ত বাংলায় হাজী মুহম্মদ মুহসীনের মতো বহু দানবীর জন্ম নিয়ে বঙ্গভূমিকে করেছেন ধন্য। যাঁরা বাংলার অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষদের শিক্ষা ও চিকিৎসার উন্নয়নে মুক্তহস্তে অর্থ দান করেছেন কিংবা প্রতিষ্ঠা করেছেন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান তেমনি একজন হলেন রণদা প্রসাদ সাহা। আর পি সাহা নামের আড়ালে কর্মযজ্ঞময় মানুষটি যতটা মুঠোভরে অর্জন করেছেন, ততটাই আবার মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি তাঁর জন্ম, জীবন ও কর্মভিত্তিক ইংরেজি এবং বাংলায় প্রায় ৭০টি প্রবন্ধ, পাঁচটি কবিতাসংবলিত প্রকাশিত হলো রণদা প্রসাদ সাহা স্মারকগ্রন্থ। গ্রন্থটিতে দেশের বহু বরেণ্য সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, সাংবাদিক, রণদার নিকট আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে নিয়ে সুন্দর-সাবলীল ভাষায় স্মৃতিচারণা করেছেন।
আজ থেকে প্রায় ১১৭ বছর আগে ব্রিটিশ আমলে দেবেন্দ্রনাথ পোদ্দার ও কুমুদিনী দেবীর দ্বিতীয় পুত্র রণদা সাভারের মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে ওঠেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তৃতীয় শ্রেণী পাস। মাত্র সাত বছর বয়সে মাতৃবিয়োগ হলে বাবার অভাব-অনটনের জন্য জীবন-জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমান কলকাতায়। কিশোর রণদা সেখানে ফেরিওয়ালা, রিকশাচালক, দিনমজুর ও কুলিগিরি করে কর্মজীবন শুরু করেন। ইতিমধ্যে প্রথম মহাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে রণদা ১৯ বছর বয়সে যোগ দেন মিত্রবাহিনীর ‘বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর’-এ। সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে রণদা ইরাকের মেসোপটেমিয়াতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অগ্নিকাণ্ডকবলিত একটি ফিল্ড হাসপাতালের যুদ্ধাহত সৈনিকদের রক্ষা করেন। ইরাক থেকে কলকাতায় ফেরার পর তাঁর এই বীরত্ব ও মানবসেবার জন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে আসেন অভিনন্দনের ডালি। ১৯১৬ সালে রণদা বাঙালি পল্টনে যোগ দেওয়ার পর আকস্মিকভাবে পরিচিত হলেন দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। খুব অল্প সময়েই তাঁরা হয়ে যান ঘনিষ্ঠ। রণদা ভারতবর্ষে আধুনিক সেনাবাহিনীতে বাঙালি জাতির প্রথম প্রজন্মের সদস্য। যুদ্ধ-ফেরত রণদা রেল বিভাগে টিকিট কালেক্টর পদে চাকরি নেন। ১৯৩২ সালে চাকরি থেকে অবসরগ্রহণের পর পেনশনের অর্থ দিয়ে কলকাতায় কয়লা ও লবণের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্রমেই তিনি ব্যবসার পরিধি বিস্তৃত করেন।
রণদার বিভিন্ন বয়সের ছবি, পারিবারিক ছবি ও বংশতালিকা গ্রন্থটিকে আরও চিত্তাকর্ষক করে তুলেছে। রণদা হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মনুষ্যত্বের পূজারি ছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ ও সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি মোহন লাল ছিলেন রণদার আদর্শ পুরুষ। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের অবরোধবাসিনীদের আলোকিত করার জন্য এই যুগোত্তীর্ণ পুরুষ সাধ্যমত প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত থেকেছেন। ১৯৩৮ সালে কুমুদিনী হাসপাতাল ও একটি বালিকা বিদ্যালয়ের (যা বর্তমানে ভারতেশ্বরী হোমস) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে তাঁর জনকল্যাণমূলক কাজের সূত্রপাত। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের (১৯৪৩) সময় তিনি সারা দেশে প্রায় ৩০০টির মতো লঙ্গরখানা খুলে কয়েক মাস নিজ অর্থে বুভুক্ষু মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এ জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব প্রদান করে। রণদা স্কুল, কলেজ, চিকিৎসালয় এবং হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ছাড়াও জনস্বার্থে কমিউনিটি সেন্টার, পাবলিক হল, নাট্যমঞ্চ ইত্যাদি নির্মাণ করেন। তিনি টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজ (১৯৪৩) এবং মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ (১৯৪৬) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালে সব ব্যবসা, কলকারখানা, সম্পত্তি এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার জন্য ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’ গঠন করেন। কিন্তু দেশভাগের পর ট্রাস্টের কার্যক্রম দুভাগ হয়ে যায়। বাংলাদেশে ট্রাস্টের আওতায় বর্তমানে কুমুদিনী হাসপাতাল, নার্সিং বিদ্যালয়, মহিলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়, ভিলেজ আউটরিচ প্রোগ্রাম, ভারতেশ্বরী হোমস, ট্রেড ট্রেনিং বিদ্যালয়, কুমুদিনী হ্যান্ডিক্রাফটস, জুট বেলিং ও ওয়্যার হাউস, বেঙ্গল রিভার সার্ভিস, ফার্মাসিউটিক্যালস ও বিভিন্ন ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে ট্রাস্টের প্রধান কার্যালয় নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত।
রণদা সাংস্কৃতি অনুরাগিও ছিলেন। সৈনিক অবস্থায় করাচিতে তাঁর নাট্যজীবন শুরু। আলমগীর (১৯৬৯) নাটকের মূল চরিত্রে অভিনয় করে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁর সম্মানার্থে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
রণদা প্রসাদ সাহা সর্বজনে আর পি সাহা নামেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর কাছে জাতির অশেষ ঋণ। মানবহিতৈষণার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। এই দানবীর মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ৭ মে পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাসহ নিখোঁজ হন। এই বইয়ের একটি লেখায় আরমা দত্ত যথার্থই বলেছেন—‘জয়তু জনহিতব্রতী রণদা প্রসাদ সাহা!/শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?/আমার প্রণাম রইল তোমাদেরই, চরণে!’