লাল মোরগের ঝুঁটি: চেনা যুদ্ধ, অচেনা দৃষ্টিকোণ

‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ চলচ্চিত্রের পোস্টার অবলম্বনে গ্রাফিকস
বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর মাসে মুক্তি পেয়েছে নূরুল আলম আতিক পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। দেখার পর এই সিনেমাটি বিশ্লেষণ করেছেন কথাসাহিত্যিক আফসানা বেগম।

প্রথম দৃশ্য দেখলেই আঁচ করা যায়, এক শিল্পিত সৃষ্টির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি—নূরুল আলম আতিক পরিচালিত ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ নিয়ে বলতে গেলে এই অনুভূতিই হবে প্রারম্ভিক। বলা বাহুল্য, শেষ দৃশ্য অবধি আরম্ভের অনুভূতিটি ছেড়ে যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধ টুকরো টুকরো সংগ্রামে বোনা বিশাল আয়তনের বিপ্লব। তাই তাকে বিচিত্র দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অবকাশ ও প্রয়োজনীয়তা আছে। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গত পঞ্চাশ বছরব্যাপী প্রচুর রচনা, সংগীত, চিত্র ও চলচ্চিত্র সৃষ্টি হয়েছে, তার নির্মাণ জরুরি ছিল। এখনো আরও অনেক সৃষ্টি জরুরি। কারণ, আরও বহু দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে দেখা বাকি আছে। সংগ্রামে ভিন্নরূপে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থিত আরও অনেকের ভিন্নধর্মী ত্যাগ ও ভোগান্তির কাহিনি তুলে ধরা একটি চলমান প্রক্রিয়া। ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ প্রধানত স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বছরে সে রকম একটি উদ্দেশ্যসাধনে আবির্ভূত হয়েছে।

কাহিনির পটভূমি সৈয়দপুর। যুদ্ধের তাগিদে সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিমান অবতরণের প্রয়োজন পড়েছিল। সৈয়দপুরের বিমানবন্দর ও রানওয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিচিত্র স্থান থেকে তুলে আনা বাঙালিদের আটকে রেখে জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করে নির্মাণ করা হয়েছিল। অনাহারে-অর্ধাহারে কেবল প্রাণের ভয়ে তারা পাকিস্তানি সেনাদের কবলে পড়ে দাস হতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলাদেশের আনাচে–কানাচে সে সময়ে অবধারিতভাবে একই ধরনের অত্যাচার বিদ্যমান ছিল। ছবির কাহিনীকার নূরুল আলম আতিক সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণের পেছনে বন্দী মানুষের আর্তনাদকে চলচ্চিত্রের মূল বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তবে বলতে গেলে সেই ঘটনাকে আশ্রয় করে তিনি সেই সময়কার একটি সাধারণ জনপদের অতিসাধারণ ও প্রান্তিক মানুষের বিপ্লবে অংশগ্রহণের প্রমাণ তুলে ধরেছেন। কাহিনি তাই দাসের জীবন বরণকারী হতভাগা মানুষে সীমাবদ্ধ না থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিচিত্র ধর্ম ও পেশার মানুষের ইতিবাচক ও নেতিবাচক অংশগ্রহণের একটি সার্বিক চিত্র হয়ে উঠেছে।

মুক্তিযুদ্ধ একটি জাতির জীবনযাপনে আমূল পরিবর্তন আনয়নকারী ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ মানে কেবল অস্ত্রধারী যোদ্ধা বা দল নয়, হাজারো বিবস্ত্র ধর্ষণের শিকার নারী নয়, যুদ্ধবিমান আর গুলি বর্ষণ নয়, তা এই চলচ্চিত্র দেখলে চেতনায় আসতে বাধ্য। প্রচলিত ধারার মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের বাইরে গিয়ে কিছু করতে চাওয়ার মানসিকতাকে তাই প্রথমেই সাধুবাদ দিতে হয়। ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ চলচ্চিত্রে যথার্থই সফলভাবে মুক্তিযুদ্ধকে আনকোরা রূপে আবিষ্কারের সুযোগ আছে।

আমাদের চিরচেনা ন্যারেটিভে মুক্তিযুদ্ধে নারীর প্রধান অবদান ধর্ষণের শিকার হওয়া বলেই বহুল প্রচারিত। কিন্তু এই চলচ্চিত্রে যে কয়টি নারীর চরিত্র দেখানো হয়েছে, তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভিন্নভাবে প্রতিরোধ করছে। মূল চরিত্র ‘পদ্ম’ যেখানে পাকিস্তানি সেনা হত্যার মূল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়, নারীর আত্মত্যাগের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের চেনা ন্যারেটিভটি তখন বদলে যায়। এ রকম তুমুল ভিন্নতা প্রদর্শনের কারণে মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য চলচ্চিত্র দেখার পরও ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ দেখার বিশেষ প্রয়োজন আছে।
‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ চলচ্চিত্রের দৃশ্য

সময়টা ১৯৭১ সালের অক্টোবর-নভেম্বর। পাকিস্তানি সেনারা গ্রাম থেকে কিছু মানুষ ধরে আনে বিমানবন্দর নির্মাণে শ্রমিকের কাজ করার জন্য। প্রতিটি মানুষের একেকটি নিজস্ব জীবন থাকে, পারিপার্শ্বিকতা থাকে, তা দেখাতে গিয়ে আবির্ভূত হয় গ্রামের অন্যান্য চরিত্র। নিম্নবর্গের এক আঞ্চলিক পরিবার, পিতা ও কন্যা আর কন্যার একটি মাত্র লম্বা জাতের লড়াকু মোরগ। মোরগের নাম বাঘা। মোরগ লড়াইয়ে আহত, রক্তাক্ত বাঘার সেবাশুশ্রূষার মধ্যে দিয়ে চলচ্চিত্রে ইতিহাসের প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। কন্যা, পদ্ম তার রক্ত মুছে দেয় আর তাকে মন্ত্র পড়ায়, প্রতিদিন সে কি শুধু মারই খাবে, কখনোই কি উলটো রুখে দাঁড়াবে না? পদ্ম চরিত্রটিই চলচ্চিত্রের চালিকা শক্তি।

সমাজের অন্ত্যজ মানুষ হয়ে সে নিতান্ত সাধারণ অবস্থান থেকে গ্রামের মানুষের উপকার করে যায়। আবার বিপদে পড়লে মারমুখী হয়ে ওঠে। তার একমাত্র ও মোক্ষম অস্ত্র থাকে একটি দা। একাধারে অসীম মনোবল আর মায়া-আবেগ নিয়ে সে গ্রামের হিন্দু পরিবারকে ভারতে যাওয়ার পথ তৈরি করে দেয়, বিপদগ্রস্ত নারীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। গ্রামের বিহারিরা হিন্দুদের বিতাড়িত কিংবা হত্যা করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। বিহারি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে কাহিনিকার সেখানে আনেন এক পরিবারকে, যার তিন সদস্য ওই জনগোষ্ঠীর আমূল আচার-ব্যবহারের প্রতিনিধি। খুন-খারাবি, হিন্দুদের সম্পদ আত্মসাতের মাধ্যমে তাদেরই একজন, শামসু-চোরা থেকে হয়ে ওঠে শামসু খান। একজন বিলাসিতায় ডুবে থাকে। একজন মাঠপর্যায়ে সন্ত্রাস পরিচালনা করে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের হৃদয়বিদারক অবস্থা উঠে এসেছে তাদের নির্যাতনে। কেউ খুন হয়, কাউকে পুড়িয়ে মারা হয়—একে তো পাকিস্তানি সেনার আতঙ্ক, তার ওপরে বিহারিদের অত্যাচার এভাবেই প্রধান হয়ে ওঠে। গ্রামময় মানুষ যখন নিষ্ঠুর অত্যাচারের শিকার, তখন হয়তো যার কাছে প্রতিরোধ আশা করা যায়, যিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে তুলনা করে পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করেন, রেডিওতে দিনরাত খবর শুনে রাজনীতির গতিবিধি বোঝেন, সেই মানুষটিই ভয়ানক নির্যাতন দেখতে দেখতে মানসিক রোগীতে পরিণত হন। হতাশাময় এক পরিস্থিতিতে একমাত্র কার্যকর প্রতিবাদটি আসে দা-সর্বস্ব তরুণী পদ্মের দিক থেকে। অত্যাচারিত মানুষকে লুকিয়ে সাহায্য করা তার যেমন প্রতিরোধ ছিল, তেমনি প্রকাশ্যে দা দিয়ে কুপিয়ে পাকিস্তানি সেনার স্থানীয় প্রধানকে মেরে ফেলতেও সে পিছ–পা হয় না। সেনার হত্যার ওই দৃশ্যের মাধ্যমে চলচ্চিত্র এমন এক রেশ রেখে সমাপ্ত হয়, যেন শত্রুর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বিজয়ের পদধ্বনি শোনা গেল।

‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ মূলত লাল মোরগের ডাক বা আহ্বান। লড়াকু মোরগটি এখানে বাংলাদেশের প্রতিবাদী মানুষের রূপক, সে আহত হয় ঠিকই, কিন্তু শেষ অবধি হার মানে না। চলচ্চিত্রটিতে অসংখ্য রূপক দৃশ্য ব্যবহৃত হয়েছে। এই দৃশ্যগুলোই সাধারণ মানুষের সাদামাটা জীবনকে অদ্ভুত এক শিল্প হিসেবে উপস্থাপন করেছে। জীবন যেমন কখনো বাস্তব, আবার কখনো নাটকীয়ভাবে মানুষের সামনে আসে, চলচ্চিত্রের চরিত্র আর কাহিনিও তেমন হুট করে বাস্তব গলে নাটকীয় মোড় নেয়, তবে যত্নের নির্মাণে শিল্পের মোড়কে তা এতটুকু বেমানান লাগে না।

চলচ্চিত্রের কাহিনির পর প্রথমেই যার প্রশংসা করা যায়, তা হলো, সেট নির্বাচন বা নির্মাণ। ওই অঞ্চলের গ্রামীণ পরিবেশের হিন্দুর বাড়ি এখানে হুবহু এসেছে। কোথাও কোনো বাড়াবাড়ি নেই, আড়ম্বর কি মেকি ভাবও নেই। উঠানে পাতা চৌকি থেকে শুরু করে উঠানের একদিকের চুলা পর্যন্ত, সবই যেন চলচ্চিত্রের দৃশ্য তৈরির আগেও ওখানেই ছিল, ঠিক ওভাবে। ঘরের ভেতরে দৃশ্য হলেও তার দেয়াল, আসবাব যেন পঞ্চাশ বছর আগেরকারই। আর সেই আসবাবের ওপরের চাদর-ঢাকনা বা চরিত্রের পোশাক সবই অবিকল সেই সময়কার। বিশেষ করে সাদা-কালোতে নির্মিত বলে সর্বব্যাপী হাহাকারটি প্রতি পরতে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। সাদা-কালো দৃশ্য কোনো না কোনোভাবে অস্থির বর্তমান ও অনির্ণেয় ভবিষ্যতের কথা বলে। রংহীন চেহারা-ছবি তাই কাহিনি ও পটভূমির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলচ্চিত্রটিকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গেছে। অন্যদিকে চলচ্চিত্রকার চাইলে দৃশ্যগুলো ধারেকাছে কোথাও শুটিং করে ছেড়ে দিতে পারতেন, কিন্তু সম্ভবত সততা তাঁকে তা করতে দেয়নি। গভীর রাতের দৃশ্যে রাস্তার ধারের গাছের ছবি সিল্যুয়েটের মতো ফ্রেমে এসেছে, সে গাছ খোদ সৈয়দপুর অঞ্চলেরই, তার সারা গায়ে ছোটো পাতার অর্কিড ঠাসা। প্রতিটি দৃশ্য ধারণের ক্ষেত্রে এমন একাগ্রতা ও সততা বহুদিন চোখে পড়েনি।

‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ চলচ্চিত্রের দৃশ্য

ক্যামেরার ফ্রেম ও দৃশের গতি ছিল দারুণ আকর্ষণীয়। দর্শক হিসেবে কোথাও জোর করে কিছু খুঁজতে হয়নি, আবার বোঝার আগে দৃশ্য হারিয়েও যায়নি। সংলাপবিহীন দৃশ্যেও ক্যামেরা চমৎকার স্বাভাবিক গতিতে এগিয়েছে যাতে চোখের সহনীয় মাত্রায় কোথাও কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। কোনো কোনো দৃশ্যে ক্যামেরা ভূমিতে না রেখে অনেকটা উপরে ধরাতে একই সময়ে কয়েকটি চরিত্রের অবস্থান ও নড়াচড়া এত চমৎকারভাবে নজরে এসেছে, যা দারুণ উপভোগ্য।

একসঙ্গে অনেকটা দেখানোর একই পদ্ধতি দৃশ্য নির্মাণেও ব্যবহার করা হয়েছে। একই সঙ্গে দুটো দৃশ্য সমান্তরালে দর্শকদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন মেয়ের ওপরে নির্যাতন ও বাবার মানসিক সমস্যার সূত্রপাত। ভাঙা রেডিওর ভেতরের কলকব্জায় উঁকি দিচ্ছেন বাবা, কিন্তু শব্দে মেয়ের অসহায় কণ্ঠস্বর; দৃশ্যে বাবা রেললাইনে কান পেতে আছেন, শব্দে মেয়ের আর্তনাদ, এভাবেই দর্শককে একই সঙ্গে দুটো ঘটনা সমান্তরালে বুঝতে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সরাসরি ধর্ষণের দৃশ্য ছাড়াও ধর্ষণ-কাণ্ড, নৃশংস হত্যার দৃশ্য ছাড়াও হত্যাকাণ্ড চমৎকার ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। নারীর ওপরে যে ধর্ষণ ছাড়া অন্যান্য নির্যাতনও প্রবলভাবে হয়েছে, তা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত প্রায় কোনো চলচ্চিত্রেই আসেনি। নারীকে বেত্রাঘাত বা জোর করে অবিরাম লাফানোর শাস্তির দৃশ্য তাই বলতে গেলে অভিনব এবং সে সময়কার বাস্তবতার সঙ্গে মিলেও যায়।

আমাদের চিরচেনা ন্যারেটিভে মুক্তিযুদ্ধে নারীর প্রধান অবদান ধর্ষণের শিকার হওয়া বলেই বহুল প্রচারিত। কিন্তু এই চলচ্চিত্রে যে কয়টি নারীর চরিত্র দেখানো হয়েছে, তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভিন্নভাবে প্রতিরোধ করছে। মূল চরিত্র ‘পদ্ম’ যেখানে পাকিস্তানি সেনা হত্যার মূল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়, নারীর আত্মত্যাগের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের চেনা ন্যারেটিভটি তখন বদলে যায়। এ রকম তুমুল ভিন্নতা প্রদর্শনের কারণে মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য চলচ্চিত্র দেখার পরও ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ দেখার বিশেষ প্রয়োজন আছে।

চলচ্চিত্রের পেছনের কলাকুশলীদের পরিশ্রম স্পষ্ট হয়ে ফোটে শেষ অবধি অভিনেতাদের কারণে। এ ক্ষেত্রে এই চলচ্চিত্র একটি সফল ও সম্পূর্ণ টিমওয়ার্ক—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অভিনেতারা প্রত্যেকে কাজের ব্যাপারে অত্যন্ত নিবেদিত ছিলেন। টিমের অংশ হিসেবে তাই দিন শেষে তাঁদের সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দিতে হয়। তবে সত্যি কথা বলতে কী, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ চলচ্চিত্র যে দৃশ্যমান ও দৃশ্যের অন্তরাল মিলিয়ে একটি দলীয় উপস্থাপনা, তা দর্শক অনুভব করতে পারবেন।

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিচিত্র ছোটবড় সংগ্রাম ও হত্যা-গণহত্যা সংঘঠিত হয়েছে। দূর–দূরান্তের সেসব সংগ্রামের খবর কজনেই–বা রাখেন! তাই তো মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে শিক্ষিত মানুষের মিছিল-সংগ্রাম আর নারী ধর্ষণের আখ্যান। এই চলচ্চিত্র প্রমাণ করেছে যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভোগান্তি ও বিপ্লব নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে। এ রকম সৃষ্টির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অপ্রচলিত ইতিহাস সামনে আসবে, যা আমাদের চেতনায় নতুন মোড় যোগ করবে, কে জানে হয়তো যুদ্ধটা নতুন এক রূপে ধরা দিয়ে আমাদের মনমানসিকতা দেবে বদলে! কাহিনি হিসেবে তাই সৈয়দপুরের বিমানবন্দর নির্মাণের পেছনে দাসপ্রথা ও পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হিন্দু বা অন্য জনগোষ্ঠীর ওপরে বিহারিদের অত্যাচার অত্যন্ত আকর্ষণীয়। চলচ্চিত্রটিকে শুধু বিমানবন্দর নির্মাণ ও দাসত্বের কাহিনিতে সীমাবদ্ধ রাখলে হয়তো–বা তা ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই’ ধরনের কাহিনি হতে পারত, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার দিকে দৃষ্টি দিয়ে অত্যন্ত মানবিক ও চমকপ্রদ এক কল্পকাহিনি হয়ে উঠেছে, যা ওই সময়ের সার্বিক চিত্র। আবার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কাহিনির কথা ভাবলে, খোদ সৈয়দপুরেই বিহারিরা পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিলে গোলাহাট হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, যেখানে চার শরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। এ রকম হত্যাকাণ্ড বা নির্যাতন যত স্থানে হয়েছে, তার অনেকগুলোই হয়তো চলচ্চিত্র বা অন্য কোনো শিল্পের বিষয়বস্তু হওয়ার উপযুক্ত। সেভাবে ভাবতে গেলে ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ চলচ্চিত্রে ভবিষ্যতের বহু চলচ্চিত্রের বীজ নিহিত আছে। সেদিক দিয়ে এই ছবিটি একটি সফল প্রযোজনা। এমন সৃষ্টিরই কী প্রয়োজন, যা থেকে নতুন কিছু সৃষ্টি হয় না?

ইতিহাস–আশ্রয়ী শিল্প নির্মাণ কঠিন কাজ। বিশেষ করে খুঁটিনাটি অসংখ্য বিষয়ের প্রতি একসঙ্গে নজর রাখতে হয়। সে হিসেবে তুচ্ছ কোনো ভ্রান্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে থাকলে থাকতেও পারে। দর্শক হিসেবে ব্যক্তিগত মতের জায়গা থেকে এটুকু বলতে পারি, সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণের সময়ে যেহেতু তিন-চার শ মানুষকে বন্দিত্ব ও দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছিল বলে জানা যায়, সেখানে চলচ্চিত্রে তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম। কোনো দৃশ্যে আরও বেশি বন্দী প্রদর্শনের মাধ্যমে বিষয়টি আরও গ্রহণযোগ্য হতে পারত। তা ছাড়া যদিও তাদের দুর্ভোগ হিসেবে আহত হওয়া বা খাদ্যের অভাবে শুকনো ছাতু হাপুসহুপুস করে খেতে গিয়ে গলায় আটকে যন্ত্রণার দৃশ্য দেখানো হয়েছে, সেখানে তাদের আরও কিছু দুর্ভোগ বা হত্যার আবহ হয়তো চলচ্চিত্রের কাহিনি-কেন্দ্রের প্রয়োজন হিসেবে আসতে পারত।

‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ চলচ্চিত্রের দৃশ্য

‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ সবকিছুর পরও দর্শক হিসেবে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। বদলে যাক মুক্তিযুদ্ধকে কেবল এক সম্মুখযুদ্ধ ভাবার মানসিকতা। বিস্তৃত একটি যুদ্ধের ভেতরে অসংখ্য ছোটো ছোটো যুদ্ধ লুকিয়ে থাকে। ধর্ম, আদর্শ, লিঙ্গ, বয়স—এ সবকিছু সেসব ছোটো ছোটো যুদ্ধকে ইন্ধন জোগায়। নতুন নতুন সৃষ্টির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম ফুটে উঠুক। কারণ যুদ্ধটা করেছিল মূলত দেশের সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণি। দুঃখজনকভাবে পঞ্চাশ বছরে সেই যুদ্ধে বিজয়ের ফল সুবিধাভোগী শ্রেণির ঝুলিতে চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ রকম কাজের মাধ্যমে এই বৈপরীত্যের অবসান হোক। ইদানীং কিছু চলচ্চিত্র দেখলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘বিপথে যাবার কাল’ অতিক্রান্ত হয়েছে বলে ধারণা হয়। ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ সেই ধারণাকে বিশ্বাসে পরিণত করার এক শক্তিশালী প্রচেষ্টা।