দশ দিগন্ত
লেখকদের দ্বন্দ্ব–বিবাদ
কবি-সাহিত্যিকদের কলহের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। লেখকদের বিবাদের যেসব হদিস পাওয়া যায়, তার বেশির ভাগ তিক্ত সমালোচনা ও চিঠি-চালাচালিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে ঘটনা গড়িয়েছে আরও বহু দূর। মুষ্টিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এমনকি দাঁত–ভাঙাভাঙি পর্যন্ত! কবি–লেখকদের দ্বন্দ্ব নিয়ে বিশ্বজোড়া সাহিত্য সমালোচকদের আগ্রহ প্রবল। লেখকেরা নিজেদের পত্রাবলি ও দিনলিপিতে ক্রোধ, শ্লেষ ও হিংসার মিশেলে হরহামেশা লিখেছেন অন্য লেখক সম্বন্ধে। আর এসব চিঠিতে ফুটে ওঠা বাগ্বিতণ্ডার শব্দচয়ন এবং ভাব ও রস অনেক ক্ষেত্রে গল্প-উপন্যাসের মতো রোমাঞ্চকর। এখানে উঠে এসেছে কিছু বরেণ্য কবি-সাহিত্যিকের ঐতিহাসিক বিবাদ ও বিরোধের গল্প।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বনাম গারট্রুড স্টেইন
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে মানুষ হিসেবে ছিলেন চৌকস, খ্যাতির প্রতি তাঁর ছিল দুর্দমনীয় ঝোঁক। সময়ের পরিক্রমায় বেশ কিছু বন্ধুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভীষণ তিক্ত হয়ে পড়ে। গারট্রুড স্টেইন এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তিনি ছিলেন হেমিংওয়ের গুরুপ্রতিম একজন। তবে তাঁদের বিরোধ কবে, কীভাবে শুরু হয়েছিল, তা স্পষ্ট নয়। ১৯৩৩ সালে স্টেইন তাঁর একটি বইয়ে লেখেন, হেমিংওয়ে দুর্বল প্রকৃতির এবং একজন অঘটনঘটনপটিয়সী। শুধু তা–ই নয়, হেমিংওয়েকে লিখতে শেখানোর কৃতিত্বও দাবি করেন তিনি। এরপর যা ঘটার, তা–ই ঘটল। ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে গারট্রুডকে গালমন্দ করে অনেকগুলো চিঠি লেখেন হেমিংওয়ে। এমনকি এজরা পাউন্ডকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেন, ‘আবর্জনা পড়তে চাইলে আগস্ট আটলান্টিক মান্থলিতে জি স্টেইনের লেখা পড়ুন।’
হেমিংওয়ে ও স্টেইনের ব্যক্তিত্বে আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল। তাই তাঁদের মধ্যকার বিরোধে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।
জন কিটস বনাম লর্ড বায়রন
১৮১৯ সালে জন কিটস তাঁর ভাইকে লেখেন, তাঁর ও লর্ড বায়রনের ফারাক বিস্তর। বায়রন যা দেখেন, তা-ই লেখেন। অন্যদিকে কিটস কলমে তুলে ধরেন তাঁর কল্পনার রাজ্যটিকে। ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক এই কবির ধারণা, তাঁর কাজটি বায়রনের তুলনায় কঠিন।
জন কিটস ও লর্ড বায়রন দুজনই উনিশ শতকের ব্রিটেনের রোমান্টিক কাব্য-আন্দোলনের কবি। তাঁদের মধ্যকার তিক্ততার মূল কারণ ঈর্ষা। দুজনই অপছন্দ করতেন অপরজনের কবিতা। মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা কিটস ভাবতেন, বায়রনের সাফল্যের ভিত তাঁর অভিজাত পরিবার। একবার বায়রনের কবিতার প্রশংসা পড়ে তিনি বলেন, ছয় ফুট লম্বা আর লর্ড হওয়ার সুবিধা দেখো! কিটসের কবিতা প্রায়ই বায়রনসহ তখনকার সাহিত্য সমালোচকদের কাছে বিপুল সমালোচিত হতো। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান কিটস। তাঁর এক বন্ধুর দাবি, বায়রনের তিক্ত সমালোচনামূলক একটি লেখাই কিটসের মৃত্যু ত্বরান্বিত করেছে। কিন্তু বায়রনও কি ছেড়ে দেওয়ার পাত্র? এ দাবির প্রতিক্রিয়ায় কোনো রকম ভদ্রতার তোয়াক্কা না করে নিজের লেখা কবিতা ‘ডন জুয়ান’–এ বিদ্রূপের সুরে তিনি লেখেন, কেবল একজন সমালোচকের কারণে মৃত্যু হয়েছিল কিটসের।
চার্লস ডিকেন্স বনাম হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন
সাহিত্যের এই দুই মহারথীর দেখা হয়েছিল মাত্র একবার। হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন ছিলেন চার্লস ডিকেন্সের একনিষ্ঠ ভক্ত। একবার ডিকেন্সের প্রশংসায় তিনি বলেন, ডিকেন্স যতটা প্রতিভাবান, ঠিক ততটাই হৃদয়বান, তাঁর মতো বন্ধুসুলভ মানুষ পাওয়া দুষ্কর। তবে ডিকেন্সের অনুভূতি ছিল পুরোপুরি উল্টো। ১৮৫৭ সালে ডিকেন্সের বাড়িতে অতিথি হিসেবে বেড়াতে যান অ্যান্ডারসন। তিনি পৌঁছানোর আগেই ডিকেন্স এক বন্ধুকে বলেন, লোকটা ড্যানিশ ছাড়া অন্য কোনো ভাষা তো জানেই না, ড্যানিশটাও ঠিকমতো জানে না। এক সপ্তাহ থাকার পরিকল্পনা করলেও ডিকেন্সের বাড়িতে মাত্র পাঁচ দিন অবস্থান করেন অ্যান্ডারসন। সেই পাঁচ দিনই ডিকেন্সের কাছে খুব দীর্ঘ মনে হয়েছিল। অতিথি বিদায় নেওয়ার পর ঠিক এই কথাই লিখে ঘরটিতে টাঙিয়ে রাখেন ডিকেন্স!
চার্লস ডিকেন্সের এই মনোভাব হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের প্রতি তাঁর অন্তর্গত বিরোধিতাকেই যেন প্রকাশ্যে নিয়ে আসে।
আলবের কাম্যু বনাম জাঁ পল সার্ত্রে
কাম্যু ও সার্ত্রের প্রথম দেখা ১৯৪৩ সালে। ফ্রান্সে তাঁরা একই সময়ে বসবাস করলেও তাঁদের দুজনের রুচি–পছন্দ ছিল দুই মেরুর। যেমন সার্ত্রে সবচেয়ে স্বস্তি বোধ করতেন পারির অনালোকিত কাফেতে, আর কাম্যুর ভালো লাগত আলজেরিয়ার ঝকঝকে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। অস্তিত্ববাদ নিয়ে আলোচনায় আলবের কাম্যু ও জাঁ পল সার্ত্রের নাম এক পঙ্ক্তিতে উঠে এলেও এ বিষয়ে তাঁদের চিন্তাভাবনা ছিল দুই রকম। সার্ত্রে ছিলেন অস্তিত্ববাদী। অন্যদিকে ১৯৪৫ সালে কাম্যু সরাসরি বলেন, ‘আমি অস্বিত্ববাদী নই। সার্ত্রের নামের সঙ্গে আমার নাম কেন জুড়ে দেওয়া হয়, তা আমার মাথায় আসে না।’ বিশ শতকের প্রবল প্রতাপশালী এই দুই লেখক প্রথম দিকে ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরে মতবিভেদের কারণে তাতে ভাটা পড়ে। কিন্তু বিরোধ থাকলেও দুজনই একে অপরের প্রজ্ঞা ও ভাবনার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারতেন।