লেখকদের নিয়ে যত ঘটনা-২০: আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কৌতুকগুলো

কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ঢাকা শহরে এসেছিলেন আশির দশকে রংপুর থেকে, পণ করেছিলেন লেখক হবেন। প্রখ্যাত লেখকদের অনেক মজার ঘটনার তিনি সাক্ষী। এই নিয়মিত কলামে তিনি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের মজার ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করবেন। অন্য আলো ডটকমে এটি প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ছবি অবলম্বনে গ্রাফিকস

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সঙ্গে থাকা মানে অনিঃশেষ আনন্দে থাকা। স্যার যখন কোনো বক্তৃতা করেন, আমি হা হয়ে শুনি। কৌতুক থাকে, রসবোধের পরিচয় থাকে, আর থাকে বৈদগ্ধ্য। স্যার একটার পর একটা কবিতা, বাংলা বা ইংরেজি কবিতা, উর্দু গজল, শায়েরি মুখস্থ বলে যেতে থাকেন। বইয়ের রেফারেন্স দিতে থাকেন। প্লেটো থেকে উদ্ধৃতি দেন, শেক্‌সপিয়ার থেকে দেন, মিল্টন থেকে দেন, ইকবাল থেকে দেন, তেমনি কোরআন শরিফ, হাদিস শরিফ থেকে দেন, গীতা কিংবা উপনিষদ থেকে দেন। ইতিহাস থেকে দেন, মনীষীদের আত্মজীবনী থেকে দেন। আমি ভাবি—তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী, আমি অবাক হয়ে শুনি।

সত্য বটে, স্যারের কতগুলো বাঁধা কৌতুক আছে। এর মধ্যে একটা হলো, পাখাবিক্রেতার কৌতুকটা। পাখাওয়ালা হাতপাখা বিক্রি করে। একটা পাখার দাম ১০ পয়সা, একটা পাখার দাম ১ টাকা। এক বাঙালি বাবু ভাবল, পাখাই তো। সস্তাটাই কিনি। ১০ পয়সা দিয়ে পাখা কিনে বাড়ি গেল। তারপর বাতাস করবার চেষ্টা করতেই পাখা গেল মট করে ভেঙে। সে সেই ভাঙা পাখা হাতে নিয়ে ফিরে এল পাখাওয়ালার কাছে। কী মিয়া, কেমন পাখা দিলা! বাতাস করার আগেই ভেঙে গেল! পাখাওয়ালা বলল, কোন পাখাটা নিছিলেন, ১০ পয়সারটা, নাকি ১ টাকারটা? ১০ পয়সারটা! পাখাওয়ালা বলল, এই পাখা দিয়া বাতাস করার তো একটা নিয়ম আছে। আপনে পাখাটা সোজা কইরা ধইরা মাথাটা এই দিক ওই দিক নাড়বেন, তাইলে আর পাখা ভাঙব না। ১০ পয়সার পাখা কিনবেন, আর সেইটা নাড়ায়া বাতাস খাইবেন, তাইলে তো পাখা ভাঙবই। ১ টাকারটা কিনতেন, ভাঙত না!

সায়ীদ স্যার এই গল্পটা বলেন। তারপর বলেন, তোমরা যখন বানাবে, ১ টাকার পাখা বানাবে, নাকি ১০ পয়সার পাখা বানাবে? আমাদের উৎকর্ষের সাধনা করতে হবে! আমরা যখন পড়ব, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বইগুলো পড়ব। আমরা যখন একটা কাজ করব, তখন সবচেয়ে সুন্দরভাবে সেটা করার চেষ্টা করব। আমরা যখন মানুষ হওয়ার সাধনা করব, তখন সবচেয়ে সুন্দর মানুষ হওয়ার সাধনা করব।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ছবি: অন্য আলো

স্যার কিন্তু তাই বলে সব সময় একই বক্তৃতা দেন না। প্রতিবার স্যারের বক্তৃতায় আমি নতুন কথা শুনেছি, নতুনতর দিশা পেয়েছি।
একটা উদাহরণ দিই। নিজের লেখা থেকে উদ্ধৃত করি:
‘শাওন সঘন’ বৃষ্টিমুখরিত ২৫ জুলাই ২০১৮-এর সকালে, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। স্যারের ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে হলে দুই ফুট বাই দুই ফুট লিফটে উঠতে হয়, সেটা আবার খানিকটা ঝাঁকুনি দেয়।

স্যারের ছোট ফ্ল্যাটের বৈঠকখানাও ছোট, কিন্তু তার আকাশটা বড়। একটা খোলা জানালার ওপারে আর কোনো ভবন নেই। এই বৃষ্টিকাতর সকালেও স্নিগ্ধ একরাশ আলো এসে পড়েছে ঘরে। স্যার জানালার দিকে মুখ করে বসেছেন। আমি আলোয় উদ্ভাসিত হাসিমাখা মুখখানিতে খানিকটা সতেজতাও দেখতে পাই। আমার ভালো লাগে।

মধ্যখানে বেশ কিছুটা সময় স্যারের স্বাস্থ্যটা খারাপ গেছে, রাস্তায় পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছিলেন, ভালো ভুগেছিলেন। এখন বেশ তরতাজা।
বললাম, ‘স্যার, আশা তো আর দেখি না। আমার মনের মধ্যে মেঘ-আমেরিকা, ব্রিটেন, ভারত-ট্রাম্প, ব্রেক্সিট, মোদি...দেশের বৈষয়িক উন্নতি দেখি। নৈতিক উন্নতি তো দেখি না।’

স্যার বললেন, ‘শোনো, সকালবেলা শোপেনহাওয়ারের ওপরে পড়ছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মনে হয়েছিল, মানুষের আর কোনো আশা নেই। কিন্তু মানুষ একটা আশ্চর্য ব্যাপার। সে ধ্বংস হতে চায় না, নিজেকে সে ধ্বংস করবে না। পুঁজিবাদ নিজেদের প্রয়োজনে প্রযুক্তি আনল, নিম্নমানের প্রযুক্তি, পরিবেশবিধ্বংসী। এখন পুঁজিবাদই তো নিজেদের প্রয়োজনে গ্রিন টেকনোলজি আনছে।

‘দেখো, এই যে প্রযুক্তি নারীদের মুক্ত করে দিল, তাদের আর ঘরে থাকতে হয় না—আগে কী ছিল, কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। এখন বিজ্ঞান তাদের মুক্তি দিয়েছে। এটা মানুষের জন্য অনেক বড় আশীর্বাদ। কারণ, নারীর মস্তিষ্ক অনেক ভারসাম্যপূর্ণ। পুরুষ তো শুধু ব্রেনের একটা অংশ ব্যবহার করেছে, হয় যুদ্ধ, নয়তো ফুটবল, নয়তো ব্যবসা; কিন্তু নারীকে চিরটা কাল চারদিক সামলাতে হয়েছে, ফলে তাদের ব্রেন সব দিকে বিকশিত হয়েছে। সেই বিপুল বুদ্ধিবৈভব এখন কাজে লাগছে, কত বড় সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে।

কিন্তু স্যার, ইতিহাসে খারাপ শাসকেরা আসে, স্টালিন বা গাদ্দাফি, তারা...
স্যার বলেন, তারা তো ইতিহাসে থাকে না।

কিন্তু তাদের খারাপ প্রভাবের দায় তো ইতিহাসকে বইতে হয়...
স্যার বললেন, হয়, কিন্তু মানুষের প্রবণতা হলো আবার আলোর দিকে যাওয়া। সে পরাজয় মেনে নেয় না। ভেতর থেকেই প্রতিরোধ গড়ে...’ (প্রথম আলো, ২৫ জুলাই ২০১৮)
২০১৫ সালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের জন্মদিনে তাঁর একটা ছোট সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। এখানে তা থেকে খানিকটা তুলে ধরি:
আনিসুল হক: স্যার, গতকালই ৭৬ বছর পার করে ৭৭-এ পা দিয়েছেন আপনি। দীর্ঘ জীবন পাওয়াও একটা সার্থকতা। এই চিন্তার প্রেক্ষাপটে আপনি কি কিছু বলবেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: এই মুহূর্তে সিসেরোর একটা লেখা মনে পড়ছে। সিসেরো বলেছেন, বেঁচে থাকাটাও একটা সার্থকতা। তিনি বলেছেন, বৃদ্ধ হওয়াটাও একটা যোগ্যতা। আমি মনে করি, এই কথার মধ্যে সত্যতা আছে। বৃদ্ধ হতে গিয়ে মানুষ যে বহু রকমের তথ্য, জ্ঞান ও বিজ্ঞতা অর্জন করে, সেটা অল্প বয়সে কিছুতেই সম্ভব নয়। এটা হলো একটা কথা। আরেকটা কথা হলো, সারা জীবন মানুষ যা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, বার্ধক্য তো তা-ই। একবার এক ছাত্র আমাকে বলেছিল, ‘স্যার, আপনি তো প্রবীণ।’ আমি তাকে বলেছিলাম, দেখো, তুমিও বেঁচে আছ, আমিও বেঁচে আছি। সেদিনই নির্ধারিত হবে কে প্রবীণ, যেদিন আমাদের মধ্য থেকে একজন মারা যাবে। সেটা যে আমিই হব, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং, তুমি যা হতে চাইছ বা হওয়ার স্বপ্ন দেখছ, সেটা হতে পারাটাই সার্থকতা। অর্থাৎ বৃদ্ধ হতে পারাটাও একটা সার্থকতা বটে।

আনিসুল হক: প্রবীণ হলে অতীতের গল্প করতে খুব ভালো লাগে। আমাদের সময়ে আমরা এটা করতাম ওটা করতাম, যৌবনে আমরা এই করেছি সেই করেছি, অথবা আমার যৌবনকালটাই ছিল একমাত্র যৌবন...ইত্যাদি। এ রকম কি আপনারও মনে হয়?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: না। এক মুহূর্তের জন্যও আমার এ রকম মনে হয়নি। কারণ, তুমি যে রকম প্রতিটি লেখার আগে একটা পাতার মতো কাঁপতে থাকো, ঠিক তেমনি যদি নিত্যনতুন ঘটনা তোমার জীবনে ঘটতে থাকে এবং প্রতিদিন সকালে উঠে যদি তুমি নতুন পৃথিবীর মুখোমুখি হতে থাকো, তাহলে এই পৃথিবীই তোমার কাছে চিররহস্যময়, চিরবিস্ময়কর এবং নতুন। সুতরাং যে মানুষ নতুন হচ্ছে, নতুন প্রজন্মের মতোই উৎসাহ-আগ্রহ ও বিস্ময় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তার কাছে তো অতীত বলে কিছু নেই।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ছবি: অন্য আলো

বর্তমানকে মোকাবিলা করতেই তো তার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে অতীতের গল্প করবে কখন? অতীতের গল্প সে-ই করবে, যার জীবন থেমে গেছে। পালামৌ লেখার সময় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমি যখন পালামৌ গিয়াছিলাম, ফিরিয়া আসিলে পর সকলেই আমাকে পালামৌ সম্পর্কে লিখিতে বলিল। আমি তাহাদের কথা শুনিয়া হাসিলাম। এখন কেহ আমাকে লিখিতে বলে না। কিন্তু আমি লিখিতে বসিয়াছি। কারণ, কথা বলা এই বয়সের রোগ। কেহ বলুক না বলুক, বৃদ্ধ গল্প বলে।’ গল্প কেন বলে? তিনি যখন পালামৌ গিয়েছিলেন, তখন তো সেটা লেখেননি। কারণ, তখন তো তিনি জীবনের এক পালামৌ থেকে আরেক পালামৌ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যেদিন আর পালামৌ নেই, সেদিনই পালামৌ অসম্ভব সুন্দর। আমাদের মধ্যে যারা জীবনকে ছেড়ে দিয়েছি, তারাই বৃদ্ধ।

আনিসুল হক: আপনি একবার বলেছিলেন, আপনার মধ্যে যৌবন বারবার ফিরে আসে। যখন আপনি কণ্ঠস্বর বের করলেন, তখন একবার যৌবন ফিরে এল, যখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র করলেন, যৌবন ফিরে এল, আবার আপনি যে সময় পরিবেশ আন্দোলন করলেন, সে সময়ও একবার যৌবন ফিরে এল আপনার। তো এখন আপনার যৌবন ফিরে আসার উপলক্ষটা কী?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: গতকাল এক বক্তৃতায় বলেছিলাম, একসময় যখন আমি যে কাজই করতাম, সেই কাজটা পাগলের মতো করতাম—একেবারে চাঁদে পাওয়া মানুষের মতো। এক কাজ নিয়েই পড়ে থাকতাম। কিন্তু একই সঙ্গে এখন আমি সাত রকমের কাজ করতে পারি। এটা বয়স ও অভিজ্ঞতার ব্যাপার। এই সাত রকম কাজের মধ্যে যে বৈচিত্র্যের আনন্দ, সেটা আমার অল্প বয়সের মধ্যে ছিল না। তখন যেটার মধ্যে প্রথিত হয়ে যেতাম, সেটার মধ্যেই আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকতাম। এখন যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে লেখা আমাকে পেয়ে বসেছে।

স্যারের কথায় প্রচুর উদ্ধৃতি পাই, এগুলো কিন্তু স্যার বই দেখে বা নোট দেখে বলেন না, মুখস্থ বলেন। গড়গড়িয়ে বলেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি এবং পড়াশোনার পরিধি আমাকে বিস্ময়াভিভূত করে।

আগের পর্বে বলেছিলাম, টাকাপয়সা অর্জন বা বৈষয়িক সাফল্যকে স্যার খুবই তুচ্ছ জ্ঞান করেন। এটা স্যার কেন করেন, আমি বুঝি। আপনি যদি ভালো ব্যবসায়ী হন, ভালো শল্যচিকিৎসক হন, আপনি যদি এক হাজার কোটি টাকার মালিক হন, তাহলে আপনি কেন কবিতা বা শিল্পসৃষ্টি করবার জন্য প্রাণপাত করবেন? যিনি কবি, তাঁর প্রথম ভালোবাসা হতে হবে কবিতা। জীবনানন্দ দাশ যেমন শিক্ষক হিসেবেও সফল ছিলেন না, তিনি নাকি ক্লাসে অবিরল লেকচার দিতে পারতেন না; তাঁর হাতের তালু ঘামত, গলা শুকিয়ে আসত। দারিদ্র্য তাঁর সঙ্গী হয়েছিল, বেকারত্ব তাঁকে কষ্ট দিয়েছিল। কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করেছে, জীবনানন্দের চরিত্রের মুখের কথা তাঁর নিজেরই কথা আসলে।

‘কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সব সময়েই শিল্পসৃষ্টি করবার আগ্রহ, তৃষ্ণা, পৃথিবীর সমস্ত সুখ দুঃখ, লালসা, কলরব, আড়ম্বরের ভেতর কল্পনা ও স্বপ্নচিন্তার দুশ্ছেদ্য অঙ্কুরের বোঝা বুকে বহন করে বেড়াবার জন্মগত পাপ। কারুকর্মীর এই জন্মগত অভিশাপ আমার সামাজিক সফলতা নষ্ট করে দিয়েছে। আমার সংসারকে ভরে দিয়েছে ছাই-কালি-ধূলির শূন্যতায়। যে উদ্যম ও আকাঙ্ক্ষার নিঃসংকোচ সাংসারিকতা ও স্বাভাবিকতা স্বরাজপার্টি গঠন করতে পারত, কিংবা কংগ্রেস, অথবা একটা মোটর কার, কিংবা একটা নামজাদা বই বা চায়ের দোকান, অথবা একজন অক্লান্ত কর্মী চেয়ারম্যানকে তৈরি করতে পারে, অসীম অধ্যবসায়ী উকিলকে, কিংবা সচ্চরিত্র হেডমাস্টারকে, মুচিকে, মিস্ত্রিকে সেই আকাঙ্ক্ষা উদ্যম নেই আমার।’

(‘কারুবাসনা’—জীবনানন্দ দাশ)
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বড় লেখক এবং ভীষণ ভালো ছাত্র, প্রবেশিকা ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পাওয়া, প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিতের ছাত্র, বিএসসি পাস করতে পারলেন না এবং দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে অতি অল্প বয়সে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। কারণ, তিনি শিল্পসৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, শিল্পের মধ্যে সমাহিত হয়েছিলেন, কারুবাসনা তাঁকে নষ্ট করেছিল।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বৈষয়িক প্রতিপত্তিকে যদি শিক্ষকতার চেয়ে ঊণতর জ্ঞান না করতেন, তাহলে তিনি আর যা-ই হোন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ হতে পারতেন না। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো বিশাল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেও তিনি খুবই সাধারণ জীবন যাপন করেন। স্যারের ফ্ল্যাটটা খুব ছোট, এটা আমি আগেই বলেছি। এত সাদাসিধে জীবন যাপন করতে আমি কম মানুষকেই দেখেছি। ভীষণ রুচিশীল এবং সৌন্দর্যপ্রেমিক মানুষ তিনি। পাঞ্জাবিতে মাড় থাকতে হবে, ইস্ত্রি করা ধোপদুরস্ত হতে হবে তাঁর পোশাক।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও আনিসুল হক
ছবি: সংগৃহীত

স্যারের ফ্ল্যাটটার আগে স্যারের একটা বাড়ি ছিল। উত্তরার রাজউকের প্লটে তিনি বাড়ি করেছিলেন। সেই বাড়ি নিয়ে তাঁর খুব সুন্দর একটা লেখা আছে। কতটা অবৈষয়িক হলে সেই বাড়ি তিনি বিক্রি করে দেন বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকবেন বলে! বিক্রি করে দিয়ে সেই টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনতে যাবেন, কিন্তু তখন ঢাকার শেয়ার মার্কেটে রমরমা শুরু হয়ে গেছে। স্যার আমাদের বললেন, শোনো, আমি কিছুদিনের মধ্যেই ধনবান হয়ে যাচ্ছি। কিছুদিনের মধ্যেই স্যার সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন। শেয়ার মার্কেটে লগ্নি করা টাকা পানি হয়ে গেল। স্যার হাতিরপুলের কাছে ইস্টার্ন প্লাজার পেছনে একটা গলির ভেতরে ভাড়া বাসায় উঠলেন।

ম্যাগসাইসাই পুরস্কারের টাকাটা না পেলে স্যার এই ফ্ল্যাটও কিনতে পারতেন না, এখন যেটায় তিনি থাকেন। এসব নিয়ে স্যারের কোনো দুঃখ নেই। এসব নিয়ে স্যারকে কখনো কিছু বলতেও শুনি না।

আব্দুন নূর তুষারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্যার বলেছেন, ‘হাজার হাজার টাকাওয়ালা লোক পৃথিবীতে জন্মেছে, এসেছে, গেছে। তাদের কাউকে কি মানুষ মনে রেখেছে? একজন সামান্য অনাহারী কবি ধুঁকতে ধুঁকতে যক্ষ্মায় ক্ষয়ে মরে গেছে, কিন্তু মানবজাতির জন্য পাঁচটি সুন্দর লাইন লিখে রেখে গেছে—পৃথিবীর মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে। কিটস বা সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো কত কবি বা দার্শনিক বা সংগীত স্রষ্টা আর বিজ্ঞানীদের মানুষ মনে রেখেছে। কিন্তু কোনো টাকাওয়ালাকে কি স্মরণে রেখেছে?’ (গল্পসল্প, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সময় প্রকাশনী)

এই লেখার নাম দিয়েছি সায়ীদ স্যারের কৌতুকগুলো। একটা কৌতুক না বলে লেখাটা শেষ করা যাচ্ছে না। গল্পসল্প বই থেকেই আরেকটা কৌতুক। বায়োলজির শিক্ষক ছাত্রকে একটা পাখির পা দেখিয়ে বললেন, বলো তো এই পাখিটার নাম কী? ছাত্র পারল না। স্যার রেগে গিয়ে বললেন, এতটুকুও জানো না। তোমার নাম কী? ছাত্র তখন শিক্ষককে বলল, স্যার আমার পা দেখে আপনি বলে দিন যে আমার নাম কী!’
(চলবে)