লেখকদের নিয়ে যত ঘটনা-২৪: আল মাহমুদের সঙ্গে কবির লড়াই (অসম)

কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ঢাকা শহরে এসেছিলেন আশির দশকে রংপুর থেকে, পণ করেছিলেন লেখক হবেন। প্রখ্যাত লেখকদের অনেক মজার ঘটনার তিনি সাক্ষী। এই নিয়মিত কলামে তিনি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের মজার ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করেন। অন্য আলো ডটকমে এটি প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে।

(পূর্ব প্রকাশের পর)
এরপর ‘প্রথম আলো’ সম্পাদক মতিউর রহমান আমাকে বলেন, তোমার লেখার একটা প্রতিক্রিয়া আল মাহমুদ লিখেছেন ‘আমার দেশ’ পত্রিকায়। ভালো লিখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সোনালি কাবিন’ প্রবন্ধের মতো নয়, বরং লিরিক। পড়ো।
আমি মতিউর রহমান ভাইয়ের এই আদেশ পালন করিনি। কারণ, সামনে বইমেলা। আমার বইমেলার লেখা শেষ হয়নি। আমি মগ্ন হয়ে আছি বইয়ের পাণ্ডুলিপিতে। এখন যদি আমি আল মাহমুদের লেখা পড়ি, তাহলে আমার মনে ঝড় উঠবে। আমি আরেকটা লেখা লিখব। পরে তিনি আরেকটা লেখা লিখবেন। অন্যেরা এসে এই আলোচনায় যোগ দেবেন। আমার আর বইমেলার লেখা সম্পন্ন করা হয়ে উঠবে না। পরে পড়া যাবে বলে আমি আল মাহমুদের লেখাটা আর পড়িনি। তারপর সেই কথা আমি একেবারেই ভুলে যাই।

এ বছর ২০২২ সালে পিআইবি থেকে জাফর ওয়াজেদ ভাইয়ের সহযোগিতায় আমি আল মাহমুদের লেখাটা উদ্ধার করি। নিচে সেই লেখার পুরোটাই তুলে ধরছি। আল মাহমুদ লিখেছেন:

সোনালি কাবিনের রূপালি সমালোচনা

‘আমরা প্যারিস শহরের একটি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান বাস্তিল থেকে পাবলিক বাসে করে ফিরছিলাম। বাসটি প্রায় শূন্যই ছিল। আমরা কয়েক বাঙালি ভ্রমণকারী বাসের একদম পেছনের আসনে উপবিষ্ট ছিলাম। এ সময় অকারণ আনন্দে আমার বন্ধু ও ‘সোনালি কাবিন’–এর ইংরেজি অনুবাদক মাহবুবুল আলম আখন্দ তাঁর ‘Beyond the Blue, Beneath the Bliss’ নামের আমারই কবিতার একটি মাঝারি সাইজের অনুবাদ সংকলন থেকে ‘সোনালি কাবিন’–এর ১৪টি সনেট বেশ জোরালো উচ্চারণে পড়তে শুরু করলেন। তাঁর সঙ্গে আমরাও আবৃত্তিকারকে উৎসাহিত করার জন্য গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে তাঁর উচ্চারণভঙ্গির প্রশংসা করতে লাগলাম। আমি ‘সোনালি কাবিন’–এর স্রষ্টা হিসেবে খুশিতে এবং একধরনের লজ্জিত আনন্দে যেমন আবৃত্তি শুনছিলাম, তেমনি বাসের অন্য যাত্রীদের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, এরা বিরক্তি বোধ করছে কি না। কিন্তু বিস্মিত হয়ে দেখলাম, সবাই মাহবুবুল আলম আখন্দের অদ্ভুত ভঙ্গিতে ‘সোনালি কাবিন’–এর ইংরেজি পাঠ উৎকর্ণ হয়ে শ্রবণ করছে। আমি একটু অবাকই হলাম। আবৃত্তি শেষ হলে বাসের এক সুবেশধারী ফরাসি যাত্রী হেসে উঠে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। তাঁর মুখে অত্যন্ত বিনীত অভিব্যক্তি দেখে আমি এই ভেবে স্বস্তি বোধ করলাম যে ভদ্রলোক আমাদের অভদ্র ভাবেননি; বরং মিস্টার আলমের কাছে জানতে চাইলেন, আমরা কোন দেশের বাসিন্দা। যে কবিতা তিনি এতক্ষণ আবৃত্তি করছিলেন, তার নাম কী এবং তার কবি কে। তিনি পকেট থেকে একটি ভিজিটিং কার্ড বের করে নিজের আত্মপরিচয় দিলেন। ভদ্রলোকের নাম অ্যালেইন রোজানস্কি। তিনি পৃথিবীর বিখ্যাত কনটেম্পোরারি অ্যান্ড মডার্ন আর্টের সংগ্রহশালা জর্জ পম্পিডো সেন্টারের ডিরেক্টর জেনারেল।

আল মাহমুদ বেঁচে থাকতে তাঁকে আমার বলা উচিত ছিল যে ‘সোনালি কাবিন’ প্রসঙ্গে প্রবন্ধের মতো কথাটা আমি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। কিন্তু যখন আমি তাঁর কাছে যাব বলে ভাবলাম, তখন শুনলাম, তিনি পুরোনো কথা মনে রাখতে পারছেন না। যাব যাব করে যাওয়া হলো না। তিনি লোকান্তরিত হলেন

আলম সাহেব আমার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘হি ইজ দ্য পোয়েট, আল মাহমুদ’— এই সামান্য পরিচয় থেকে আমার যে মহা উপকার হলো শুধু তা নয়; এতে বাংলাদেশ তথা ঢাকার কবিতারও কিছুটা উপকার হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছিল। সে বিবরণ এখানে দিতে গেলে এক কলামে পোষাবে না। আর ধরানোও যাবে না। যে কারণে আমি প্রসঙ্গটির উত্থাপন করেছি, এবার সেটা বলা দরকার। গত ১১ জানুয়ারি দেশের একটি প্রখ্যাত দৈনিক পত্রিকায় জনাব আনিসুল হকের একটা লেখা পড়লাম। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো পরিচয় ঘটেনি, তবে তাঁর সুকীর্তি সম্বন্ধে আমি একেবারেই জানি না এমন নয়। তিনি গল্প, উপন্যাস, কবিতা ও নাটক-সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখে থাকেন। এর মধ্যে তাঁর ‘ব্যাচেলর’ নামের একটি চিত্রনাট্যের সিনেমা হওয়ার খবরও আমি জানি। সম্ভবত এর দর্শকও প্রচুর জুটেছে।

এহেন এক বিজ্ঞ লেখক ‘সোনালি কাবিন’–এর সনেটগুচ্ছকে প্রবন্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করবেন, এটা ৩৬ বছর যাবৎ কোনো সমালোচকের সম্ভবত মাথায় আসেনি। আমি এতে বিস্মিত হইনি। কারণ, আমাদের দেশে কাব্যের কোনো সমালোচক আছেন, তাতে আমি বিশ্বাস করি না। তা ছাড়া আমি নিজেও কাব্যের কোনো সমালোচনাতেই বিশ্বাসী নই। যেমন একালের পশ্চিমা কবিরা বলে থাকেন, কাব্যের সমালোচনা করতে হলে কবির জীবন ও কবিতাকে যুগপৎ মিশ্রিত করে উত্থাপন করে টেক্সট তৈরি করতে হবে। শুধু কবিতার সমালোচনা সম্ভব নয়। কবিকেও কবিতার পঙ্‌ক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না।

অবশ্য জনাব আনিসুল হক ‘সোনালি কাবিন’–এর ওপর বলতে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের প্রধান পুরুষের সঙ্গে তাঁদের ছত্রচ্ছায়ায় আমার অতীত অবস্থানের বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু আমার সঙ্গে কবি শামসুর রাহমানেরও তিনি আলোচনা করতে গিয়ে তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয় ও পক্ষপাতের কোনো উল্লেখ করেননি। আমি স্বৈরাচারের ছত্রচ্ছায়ায় ছিলাম, এটাই তাঁর বক্তব্যের মূল ভিত্তি। আমি অকপট স্বীকার করি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ—এই তিন রাষ্ট্রনায়কের ও রাজনৈতিক নেতার সংস্পর্শে যেতে পেরেছিলাম; কোনো ছত্রচ্ছায়ায় নয়। এটা এ দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে কোনো গভীরতর সম্পর্ক ছিল না। এতে আমি কবি হিসেবে কিছু লাভবান হয়েছি। আমাদের কবিতাও লাভবান হয়েছে তার চেয়ে বেশি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান না জন্মালে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সৈনিকবৃত্তিতে নিযুক্ত না থাকলে হাজার বছরের পরাধীন বাঙালি জাতি সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত না। আর স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতায় না এলে এ দেশের গরুর গাড়ির যুগের অবসান হতো না। আমি এ দেশের অনেক বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক নেতার সঙ্গেও কমবেশি পরিচিত। আমিই প্রথম বাংলাদেশে একটি র‍্যাডিক্যাল পত্রিকা প্রকাশ করি, স্বাধীনতার পরপরই। পত্রিকাটির নাম ছিল দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’। তখনো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে আসেননি। কিংবা যেদিন এলেন, সেদিনই পত্রিকাটি বেরিয়েছিল। পত্রিকার ব্যানার হেডলাইন ছিল, ‘আজ বঙ্গবন্ধু আসছেন’। আমি বহুবার বলেছি, আমি একজন কবিমাত্র, রাজনীতিক নই। আর কবিরা বাতাস খেয়ে বাঁচে না। আনিসুল হকের মতো লিখেটিখেই বাঁচে এবং সংবাদপত্রের মালিকদের পলিসির বাইরে একটা আকারও তাঁরা যুক্ত করতে পারেন না। কবিতা একালের দৈনিক সংবাদপত্রের মতো চার রঙের মিথ্যায় রঞ্জিত থাকে না। মানুষের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি থাকে, স্বপ্ন থাকে আর থাকে গীতিময় প্রতিবাদের ভাষা। ‘সোনালি কাবিন’ ওই ভাষাতে রচিত। প্রবন্ধ নয়, প্রকৃতপক্ষে গীতিকবিতা। আনিসুল হকের মতো বিদ্বান লোককে বোঝাতে হবে না যে সনেটের উৎপত্তিস্থল কোথায়! এবং তার নির্মাণশৈলীর পদ্ধতিগুলো কী! তবু আমার মতো অশিক্ষিত কবির সামান্য পড়াশোনায় একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে জানাতে চাই যে ইতালীয় ত্রুবাদুর বেদে–বেদেনিরা, ইউরোপে যাদের জিপসি বলা হয়, তাদের একধরনের চৌদ্দ লাইনের গীতমাত্র। এই আঙ্গিকটি ইতালীয় কবি পেত্রার্কের মনঃপূত হলে তিনি তাদের গীতের আঙ্গিকটি গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার এই আঙ্গিকটি তাঁর নিজস্ব ঢঙে আত্মস্থ করে অমর সনেট রচনা করে গেছেন। এই পেত্রার্কিয়ান সনেট স্টাইলই আমাদের বাংলা ভাষার অন্যতম স্রষ্টা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। তিনি ১৪ মাত্রার পঙ্‌ক্তি রচনা করে যে সনেট নির্মাণ করেন, তাতে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলাদেশে অনেক ‘রত্ন’ আছে। ‘হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন...’।

প্যারিস শহরে বাস সফরের রাতটি কাটিয়ে আমরা পরের দিন মঁসিয়ে অ্যালেইন রোজানস্কির আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পম্পিডো সেন্টারে পৌঁছে দেখি, সেন্টারের সব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী পুষ্প, উপহারসামগ্রীসহ আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরা আধুনিক চিত্রকলার কতক নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ দিয়ে আমাদের ধন্য করেন। আসার সময় অ্যালেইন রোজানস্কি আমাকে উদ্দেশ করে হাসলেন, ‘When I see you, I see the flag of Bangladesh fly...’ এই সূত্র ধরেই একদিন অকস্মাৎ ফ্রান্সের শিল্প-সংস্কৃতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মঁসিয়ে গি সখম্যান একসন্ধ্যায় আমার বাসায় আমাকে দেখতে আসেন। এই হলো ‘সোনালি কাবিন’, বাংলা ভাষার একজন গীতিকবির অল্প বয়সের রচনা, যা আমি অনেক দূরে ছেড়ে চলে এসেছি।’

আল মাহমুদের লেখাটি পড়ার পর এখন মনে হলো, তিনি আমার সম্পর্কে কোনো রকমের নেতিবাচক কথা বলেননি বলেই চলে। একটু সূক্ষ্ণ পরিহাস আছে। সেটা আমি ধর্তব্যের মধ্যে আনছি না। বরং বড় কবির বড়ত্বই এই লেখায় প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে, এই লেখা তখন না পড়ে আমি ভালোই করেছিলাম। কারণ, তখন পড়লে আমি অন্তত ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সৈনিকবৃত্তিতে নিযুক্ত না থাকলে হাজার বছরের পরাধীন বাঙালি জাতি সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত না। আর স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতায় না এলে এ দেশের গরুর গাড়ির যুগের অবসান হতো না’—এই লাইনগুলোর প্রতিবাদ করতাম। এবং তা থেকে বাদানুবাদ শুরু হয়ে যেত। জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ ১৯৭১ কালুরঘাটে বেতারে পৌঁছানোর আগেই দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, রাজারবাগে, পিলখানায়, যশোরে, কুষ্টিয়ায় এবং সারা বাংলাদেশের প্রতিটা জেলায় মহকুমায়। মেজর রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রামেই যুদ্ধ শুরু করে দেন। মেজর রফিকের বই ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ পড়ে দেখা যেতে পারে। আমার এবারের বই ‘রক্তে আঁকা ভোর’–এ এসবের বিশদ বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

এরশাদ সাহেব ক্ষমতা না নিলে দেশের ভালো বই খারাপ হতো না।
তবে আমি প্রবন্ধ বলতে ঠিক গদ্যে লেখা প্রবন্ধ বোঝাতে চাইনি। প্রবন্ধের মতো কথাটা তাই ভুল বার্তা দিতে পারে। সনেট যে লিরিক, আল মাহমুদ আমাকে এ বিষয়ে যে জ্ঞান দিয়েছেন, তা আমি মাথা পেতে নেব। বড়দের শ্রদ্ধা দেখানো আমার জীবনের একটা অলঙ্ঘনীয় নীতি। আমি তা থেকে সরব না। সনেট লেখার মোটামুটি দুটি ধরন আছে, শেক্‌সপিয়ারীয় আর পেত্রার্কান... এটা তো মোটামুটি কবিতার বিদ্যালয়–পড়ুয়াদেরও জানা। লিরিক্যাল হওয়ার জন্য যেমন ছন্দ আর অনুপ্রাস দরকার হয়, তেমনি লিরিক্যালের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো লিরিক হয়ে থাকে ব্যক্তিগত। স্বগতোক্তির মতো। ব্যক্তির নিজের মনের কথা এতে ফুটে ওঠে। আমরা বলি, বাংলাদেশের কবিতা মহাকাব্যিক, পশ্চিম বঙ্গের কবিতা লিরিক্যাল। কারণ, বাংলাদেশের কবিতা দেশকাল মানুষের কথা ধারণ করতে চায়। আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’–এ কবি সমাজতন্ত্রর পক্ষে ওকালতি করেছেন। সুন্দর শব্দ, ছন্দ, উপমা দিয়ে করেছেন। লোকভাষার ব্যবহার সেসবকে অনন্য সুষমামণ্ডিত করেছে।

একটি অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) আনিসুল হক, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান ও সাজ্জাদ শরিফ (দাঁড়ানো)
ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার কাছে মনে হয়েছে, অষ্টকে একটা প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দিয়ে ষষ্ঠকে এসে তিনি উপসংহার টানছেন:
‘এ-তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী,
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়,
ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি
কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়।
কবির কামনা হয়ে আসবে কি, হে বন্য বালিকা
অভাবে অজগর জেনো তবে আমার টোটেম,
সতেজ খুনের মতো এঁকে দেবো হিঙ্গুলের টিকা
তোমার কপালে লাল, আর দীন-দরিদ্রের প্রেম।
সে-কোন গোত্রের মন্ত্রে বলো বধূ তোমাকে বরণ
করে এই ঘরে তুলি? আমার তো কপিলে বিশ্বাস,
প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ্?
মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস।
যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন
তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস।’
এগুলো অবশ্যই প্রবন্ধের মতো নয়। কিন্তু একটা মতবাদ প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ব্যাপার কবিতাগুলোয় আছে। আমি জানি, আমাদের প্রগতিশীল বন্ধুরা সে জন্যই আল মাহমুদকে পছন্দ করেন। আর আমি করি তাঁর ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতাটির জন্য:

প্রত্যাবর্তনের লজ্জা

শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি
নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ
দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
যাদের সাথে শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ
জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন, গোছাতে গোছাতেই
তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি।
আম্মা বলছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক
কত রাত তো অমনি থাকিস।
আমার ঘুম পেলো। এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি
নিহত হয়ে থাকলাম।
অথচ জাহানারা কোনদিন ট্রেন ফেল করে না। ফরহাদ
আধ ঘণ্টা আগেই স্টেশনে পৌঁছে যায়। লাইলী
মালপত্র তুলে দিয়ে আগেই চাকরকে টিকিট কিনতে পাঠায়। নাহার
কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে আনন্দে ভাত পর্যন্ত খেতে পারে না।
আর আমি এঁদের ভাই
সাত মাইল হেঁটে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে
এক অখ্যাত স্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি।
কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো।
শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে। চোখের পাতায়
শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ
লাল সূর্য উঠে আসবে। পরাজিতের মতো আমার মুখের উপর রোদ
নামলে, সামনে দেখবো পরিচিত নদী। ছড়ানোছিটানো
ঘরবাড়ি, গ্রাম। জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। তারপর
দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা।
কলার ছোট বাগান।
দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে। বৈঠকখানা থেকে আব্বা
একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন,
ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান …।
বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসে ফেলবেন।
ভালোই হলো তোর ফিরে আসা। তুই না থাকলে
ঘরবাড়ি একেবারে কেমন শূন্য হয়ে যায়। হাত মুখ
ধুয়ে আয়। নাস্তা পাঠাই।
আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে
ঘষে ঘষে
তুলে ফেলবো |
কিংবা
‘তোমার মুখ আঁকা একটি দস্তায়
লুটিয়ে দিতে পারি পিতার তরবারি
বাগান জোত জমি সহজে সস্তায়
তোমার মুখ আঁকা একটি দস্তায়;
পরীর টাকা পেলে কেউ কি পস্তায়?
কে নেবে তুলে নাও যা কিছু দরকারী,
তোমার মুখ আঁকা একটি দস্তায়
বিলিয়ে দিতে পারি একটি তরবারি।’

যা হোক, আল মাহমুদ বেঁচে থাকতে তাঁকে আমার বলা উচিত ছিল যে ‘সোনালি কাবিন’ প্রসঙ্গে প্রবন্ধের মতো কথাটা আমি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। কিন্তু যখন আমি তাঁর কাছে যাব বলে ভাবলাম, তখন শুনলাম, তিনি পুরোনো কথা মনে রাখতে পারছেন না। যাব যাব করে যাওয়া হলো না। তিনি লোকান্তরিত হলেন।

তবে আরেকটা কথা আমি শুনেছি। শোনা কথা। বিশ্বাস না করলেও চলে। আল মাহমুদ ছিলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার কমিটির প্রধান, বহুদিন। তিনি নাকি ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, আমি যতদিন এই কমিটিতে থাকব, দুজনকে পুরস্কার দেব না। আনিসুল হক আর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

আমারটা আমি বুঝি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কেন, তা আমি বুঝি না। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কবি হিসেবে আল মাহমুদকে অতি উচ্চ স্থান দিয়ে থাকেন।

সায়ীদ স্যার আর আমি দুজনেই বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলাম ২০১১ সালে। ততদিন আল মাহমুদ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গেছেন।

কবি হিসেবে আল মাহমুদ তখনও আমার প্রিয় ছিলেন, এখনো আছেন। আমি তাঁর গদ্যের বইও গভীর অনুরাগ নিয়ে পাঠ করি। তাঁর ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’, ‘জলবেশ্যা’র মতো গল্প, কিংবা তাঁর স্মৃতিকথার বইগুলো আমার মতো লিখিয়েদের জন্য অবশ্যপাঠ্য—এটা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই।

বাংলা সাহিত্যে আল মাহমুদের স্থান অক্ষয় থেকে যাবে বলেই আমার ধারণা।
(চলবে)