আনিসুল হকের মঙ্গলরম্য
লেখকদের নিয়ে যত ঘটনা-৪: নির্মলেন্দু গুণের আরও রসিকতা
কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ঢাকা শহরে এসেছিলেন আশির দশকে রংপুর থেকে, পণ করেছিলেন লেখক হবেন। প্রখ্যাত লেখকদের অনেক মজার ঘটনার তিনি সাক্ষী। এই নিয়মিত কলামে তিনি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের মজার ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করবেন। অন্য আলো ডটকমে এটি প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে।
নির্মলেন্দু গুণের মতো রসিক মানুষ আমি এই জীবনে খুব কম দেখেছি। তিনি তখন ‘বাংলাবাজার’ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। আমার সঙ্গে দেখা রাস্তায়। বললেন, মিঠুন, লেখা দিয়ো। আমরা কিন্তু ভালো লেখাও ছাপি।
একদিন তাঁর সঙ্গে গেছি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওখানে কবিতা পাঠের আসর। তাঁকে কবিতা পড়তে বলা হলো। তিনি বললেন, আমি আজ দুটো কবিতা পড়ব। একটা পড়ব আমি কবি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছি বলে। আরেকটা পড়ব আমাকে প্রধান অতিথি করা হয়েছে, সেই হিসেবে। প্রথমে আমি দ্বিতীয় কবিতাটা পড়ছি।
এই জিনিসটা যতবার আমার মনে হয়, ততবার আমি হাসি। দুটো কবিতা পড়ার সময় একটা আগে পড়া হলে আরেকটা পরে পড়া হবে। এর মধ্যে কোনটা দ্বিতীয়, কোনটা প্রথম, তার কি কোনো চিহ্ন আছে? এখানে আমি একটা কৌতুক বলে নিতে পারি। এক লোক তার বউকে বলে, নাশতার সঙ্গে ডিম খাব। বউ ডিম ভেজে আনলে সে বলল, আজকে আমি পোচ খেতে চেয়েছিলাম। পরের দিন বউ পোচ করে নিয়ে গেলে স্বামী বলল, আজকে আমি অমলেট খেতে চেয়েছিলাম। বউ পরের দিন বলে, আজকে ডিম কী করব। স্বামী বলে, একটা ডিম পোচ করো, একটা অমলেট। বউ তাই করে নিয়ে গেলে স্বামী বলল, হয় নাই, এই ডিমটা করা উচিত ছিল পোচ, আর এই ডিমটা অমলেট।
নির্মলেন্দু গুণের হার্ট অ্যাটাক করল। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ল্যাবএইড হাসপাতালে। খবর পেয়ে আমি ছুটে গেলাম হাসপাতালে। হাসপাতালে তাঁর কেবিনে ঢুকলাম। কবি মুহাম্মদ সামাদ এসেছেন। সামাদ ভাই বললেন, গুণদা, বাইরে তো ভিড় হয়ে গেছে। টেলিভিশনের বহু ক্যামেরা এসে গেছে।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে নির্মলেন্দু গুণ বললেন, বাইরে ভিড় হয়ে গেছে নাকি? আমি তো এদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব না। আমি তো মারা যাব না।
নির্মলেন্দু গুণ ছবি আঁকা শুরু করলেন। পাবলিক লাইব্রেরির দোতলার কনফারেন্স রুমে তাঁর ছবির প্রদর্শনী চলছে। আমি গেলাম। হাজার চারেক টাকা দিয়ে একটা ছবি কিনলাম। আরেকটা ছবি পছন্দ হলো। দাম পঁচিশ হাজার। আমি বললাম, আমি এই ছবিটাও কিনব। কারণ, আপনি তো টাকা দিয়ে আপনার গ্রামে আপনার প্রতিষ্ঠিত স্কুলের খরচ জোগাবেন।
নির্মলেন্দু গুণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিলেন কবি আবুল হাসান। দুজনে একসঙ্গে থাকতেন, ঘুরতেন। থাকার জায়গা ছিল না বলে মসজিদে ঘুমাতেন। আর পকেটে টাকা ছিল না বলে একদিন দুই বন্ধু গুলিস্তানের হোটেলে খেয়ে বিল না দিয়ে দৌড় ধরেছিলেন। গুণদা সেই কাহিনি খুব সুন্দর করে বলতে পারেন, আমরা দৌড় দিচ্ছি, এখন হোটেলের লোকজন কী বলে আমাদের পেছনে ধাওয়া করবে। ভাত খেয়ে বিল না দিয়ে পালাচ্ছে, এই কথাটা তো মুখে আসে না...।
নির্মলেন্দু গুণ বললেন, খবরদার, তুমি আমার ছবি কিনবা না। তুমি সাহায্য করার জন্য আমার ছবি কিনবা, তা হবে না। তুমি তখনই ছবি কিনতে পারবা, যখন তুমি ছবি পছন্দ করবা। ছবি পছন্দ করবা না, আমাকে সাহায্য করার জন্য ছবি কিনবা, তা হবে না।
নির্মলেন্দু গুণের এই শিল্পিতার অহংকারটাও আমার খুব পছন্দ।
তবে গুণদা নিজের গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিজের গ্রামে কবিতাকুঞ্জ বানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক কবিতা কেন্দ্র। নিজের টাকা দিয়ে। আর সহৃদয় মানুষদের দেওয়া চাঁদায়।
একদিন ফোন করলেন। মিঠুন, আমি বাড়ি বানাচ্ছি।
কই বানাচ্ছেন?
কামরাঙ্গীরচরে।
আমি বললাম, এই নামের জায়গায় বাড়ি বানানো আপনাকেই মানায়।
গুণদা বললেন, তোমার জন্য চাঁদা ধরেছি। পঁচিশ হাজার।
আমার তখন খুবই টাকার সংকট। একটা ফ্ল্যাট কিনব। হাউস বিল্ডিং থেকে লোন নিতে হবে কোটিখানেক টাকা। আমি হেসে বললাম, আপনি একদম ঠিক লোকের কাছে টাকা চেয়েছেন। যার এক কোটি টাকা লোন নিতে হয়, তার পঁচিশ হাজার টাকা দেবার ক্ষমতা আছে। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
করোনার মধ্যে তিনি তাঁর প্রতিবেশীকে সাহায্য করেছেন। ফেসবুকে ঘোষণা দিলেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁর ভক্ত-অনুরাগীরা চাঁদা দিলেন। আমিও দিলাম। গুণদার উদ্যোগ মহৎ উদ্যোগ। তিনি ফোনে আমাকে বললেন, শোনো, আমি তো এলাকায় ত্রাণ সাহায্য দিলাম। সাহায্য দেওয়ার মধ্যে বেশ একটা গৌরববোধ আছে। একটা গর্ববোধ হয়! যে দ্যাখো, আমি তোমাদের জন্য করছি...আমি বললাম, আপনি ঠিক বলেছেন। লোকে আসলে অন্যের জন্য দেয় না, নিজের জন্য দেয়...।
গুণদা যে তাঁর জীবনের কত হাসির ঘটনা বলেন।
শোনো, একবার আমাকে পুলিশ ধরেছে। ১৯৭৫ সালের পর। পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ভারতে আপনার কে কে আছে। আমি বলি, না, আমার চৌদ্দগুষ্টির মধ্যে কেউ ভারতে নাই। সবাই বাংলাদেশে।
এই সময় খবর পেয়ে আহমদ ছফা ছুটে এলেন। ছুটে এসে পুলিশকে বললেন, এই ছেলেকে কেন আটক করেছেন? বড় দেশপ্রেমিক ছেলে। এর পরিবারের সবাই ইন্ডিয়া চলে গেছে। এই ছেলের দেশপ্রেম কত বড় হলে সে ইন্ডিয়া না গিয়ে থাকতে পারে! সে ইন্ডিয়া যায় নাই!
নির্মলেন্দু গুণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিলেন কবি আবুল হাসান। দুজনে একসঙ্গে থাকতেন, ঘুরতেন। থাকার জায়গা ছিল না বলে মসজিদে ঘুমাতেন। আর পকেটে টাকা ছিল না বলে একদিন দুই বন্ধু গুলিস্তানের হোটেলে খেয়ে বিল না দিয়ে দৌড় ধরেছিলেন। গুণদা সেই কাহিনি খুব সুন্দর করে বলতে পারেন, আমরা দৌড় দিচ্ছি, এখন হোটেলের লোকজন কী বলে আমাদের পেছনে ধাওয়া করবে। ভাত খেয়ে বিল না দিয়ে পালাচ্ছে, এই কথাটা তো মুখে আসে না...।
আমাকে কষ্ট দেয় আমার মেয়ের চোখের জলের মতো—এই লাইনটা এখনো আমাকে কাঁদায়। আমি সব সহ্য করতে পারব, আমার মেয়ের চোখে জল সইতে পারব না। কবিতা কবিকে আসলেই তেমনি কষ্টই দেয়। কবি ছাড়া এই কষ্ট আর কেউ অনুভব করতে পারে কি না, আমি জানি না।
নির্মলেন্দু গুণের আত্মমর্যাদাবোধ অতি উচ্চ। একদিন আমাকে বলেছিলেন, শোনো, আমাকে আওয়ামী লীগ কবিতা পড়তে ডেকেছিল। আমি না করে দিয়েছি। আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছি, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি, ভালোবেসে যাব। তাই বলে আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকলেই আমি যাব না। আওয়ামী লীগের যেসব কাজ আমি সমর্থন করি না, তাকে আমি অনুমোদন দিতে পারি না।
গুণদাকে আমি সত্যিই অনেক ভালোবাসি। এখনো আমি এই কবিতাটা মাঝেমধ্যেই পাঠ করি।
‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই সব গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
... ...
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।’
নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতা পড়ে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। কবিতাটা হলো, ‘কবিতা আমাকে জাগিয়ে রাখে,/ ঘুমুতে দেয় না। আমাকে সে কষ্ট দেয়/ আমার মেয়ের চোখের জলের মতো।/ আমি তাকে লিখতে চাই না, কিন্তু/ সে আমাকে লেখায়। আমি চাই না/ জন্ম দিতে, আমি জানি জন্মই মৃত্যু।/ কিন্তু সে জন্মাতে চায় আমার মধ্যে...।’
আমাকে কষ্ট দেয় আমার মেয়ের চোখের জলের মতো—এই লাইনটা এখনো আমাকে কাঁদায়। আমি সব সহ্য করতে পারব, আমার মেয়ের চোখে জল সইতে পারব না। কবিতা কবিকে আসলেই তেমনি কষ্টই দেয়। কবি ছাড়া এই কষ্ট আর কেউ অনুভব করতে পারে কি না, আমি জানি না।