লেখার প্রয়োজনে টানবাজারে গিয়েছিলাম

>

টানবাজার পতিতালয়ে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা হয়েছিল টোপ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসউদ আহমাদ

ইমদাদুল হক মিলন
ইমদাদুল হক মিলন

মাসউদ আহমাদ: টোপ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। এটি লেখার কত দিন আগে আপনি এর কাহিনি নিয়ে ভেবেছিলেন? আর লিখলেন কত দিন ধরে?

ইমদাদুল হক মিলন: ১৯৮৫ সালে ঘটনাটা ঘটেছিল, শবমেহের নামে গ্রামের বারো-তেরো বছরের অতি দরিদ্র একটি মেয়েকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল একজন দালাল মহিলা। সেই মেয়েটি প্রথমে বুঝতে পারেনি। সে সরল বিশ্বাসে ঢাকায় এসেছিল, তাকে মানুষের বাড়িতে কাজের আশা দিয়ে শহরে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে মেয়েটিকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। মেয়েটি যখন এটা জানতে পারে সে প্রতিবাদ করে, সে কিছুতেই পতিতা হবে না। তাকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। একটা পর্যায়ে মেয়েটি মুমূর্ষু হয়ে পড়ে। সেখানে সাংবাদিকেরা আসে। সংবাদপত্রে খবরটি ছাপা হয়। পরে পুলিশ মেয়েটিকে উদ্ধার করে এবং হাসপাতালে সে মারা যায়। খবরটি পড়ে আমার মনে হয়, আমি এই ঘটনা নিয়ে উপন্যাস লিখব। এমন একটা বাচ্চা মেয়ে, সে তার জীবন দিয়ে দিল, কিন্তু পতিতাবৃত্তিতে গেল না। সে বছরই বিচিত্রার ঈদসংখ্যায় উপন্যাসটি লিখি, পরের বছর অনিন্দ্য প্রকাশনী থেকে বই আকারে বের হয়। লিখতে সময় লেগেছিল পনেরো-বিশ দিন।

মাসউদ: এই উপন্যাসে পারুলই প্রধান চরিত্র, কিন্তু পাড়ার সর্দারনি রহিমা ও জরিনা এবং খালাকে পুরো উপন্যাসে পাই। পারুলের পরিবার ও তার এলাকার প্রকৃতি, খাঁবাড়ির মানুষÑপারুলকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতেই এত চরিত্র আনতে হয়েছে?

মিলন: যেকোনো একটি চরিত্রকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে হলে তার চারপাশের চরিত্রগুলোও কিন্তু প্রয়োজনীয়। সেটা করা না গেলে চরিত্রটা ভালোমতো বের করে আনা যায় না। হ্যাঁ, পারুলকে ফুটিয়ে তোলার জন্যই পরিপার্শ্ব নির্মাণ করতে হয়েছে।

মাসউদ: পুরো উপন্যাসে আঞ্চলিক ভাষার বিপুল ব্যবহার পাওয়া যায়। এই ভাষা কি বিক্রমপুর অঞ্চলের?

মিলন: এটা বিক্রমপুরের ভাষা। আমি গল্প-উপন্যাসে যখনই আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করি, বিক্রমপুরের ভাষাই ব্যবহার করি। কারণ, আমি নিজে ওই এলাকার মানুষ, সেখানকার ভাষাটা ভালো জানি।

মাসউদ: আঞ্চলিক ভাষা কোনো জনপদের মানুষের প্রকাশভঙ্গির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে। এটা গুরুত্বপূর্ণও। কিন্তু এতে পাঠকের পাঠের গতি ও আনন্দ কি ব্যাহত হতে পারে?

মিলন: বাংলা ভাষার অনেক উপন্যাসে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার আছে। তারাশঙ্কর করেছেন, বিভূতিভূষণ, মানিক বা সতীনাথ ভাদুড়ী বা আমাদের হাসান আজিজুল হক যে আগুনপাখি লিখেছেন, তা-ও আঞ্চলিক ভাষায়। কালাকাল উপন্যাসটি আমি লিখেছি বিক্রমপুরের ভাষায়। আমার মনে হয় না এতে পাঠের আনন্দ বা মনোযোগ ব্যাহত হয়। গ্রামের কোনো মানুষ কথা বললে সে তার ভাষাতেই বলবে, আমাদের মতো শুদ্ধ বাংলায় নয়। একজন লেখক সেই ভাষাটিই ব্যবহার করবেন, যদি তিনি সেই চরিত্র নিয়ে লেখেন। নিম্নবর্গের একজন গ্রামের মানুষের মুখে বিশুদ্ধ ভাষা আমি দিতে পারি না।

মাসউদ: পারুলকে দুহাজার টাকায় বিক্রি করে দেয় জরিনা। পাড়ার পতিতা ও খদ্দেরের সংলাপ লিখতে গিয়ে আপনি ব্র্যাকেটে লিখেছেন ‘মুদ্রণযোগ্য নয়’...

মিলন: কোথাও কোথাও লিখেছি। লেখার কারণ হচ্ছে ওই সব জায়গায় যেসব শব্দ ও স্ল্যাং ব্যবহার করা হয়, তা আসলেই মুদ্রণযোগ্য নয়। আমি বাক্যের মাঝখানে এটা লিখেছি, যাতে সচেতন পাঠক পড়লে বুঝতে পারেন কোন শব্দটি বলা হচ্ছে।

মাসউদ: শুনেছি, উপন্যাস লেখার জন্য আপনি টানবাজারে গিয়েছিলেন সরেজমিন দেখতে, অভিজ্ঞতা নিতে?

মিলন: শবমেহেরের ঘটনার পর পত্রিকায় খুব লেখালেখি হয়। তো, যখন সিদ্ধান্ত নিই যে এ নিয়ে উপন্যাস লিখব, শবমেহের যে ঘরটিতে ছিল, আমি উপন্যাস লেখার প্রয়োজনে টানবাজারের সেই বিল্ডিংয়ে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন তখনকার তুখোড় তরুণ সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু। তিনি এখন একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান। পুলিশ আমাদের সহযোগিতা করেছিল।

মাসউদ: সিনেমায় নতুন নায়িকা এলে যেমন নাম বদলাতে হয়, সর্দারনিও নাম বদলে দেয় পারুলেরÑমিনু?

মিলন: এটা পতিতালয়ের ব্যবসায়িক পলিসি, নতুন নাম দিলে হয়তো খদ্দের আকৃষ্ট হবে। সেই বিবেচনায় তারা সেটি করে। মূল পরিচয়টি তারা চাপা দিতে চায়।

মাসউদ: টোপ শেষ পর্যন্ত মানবিক গল্প হয়ে ওঠে। পারুল কোনোভাবেই খদ্দের নেয় না এবং তাকে অকথ্য নির্যাতন সইতে হয়। সে মারা যেতে পারে এই ভয়ে সর্দারনি তাকে ট্রেনে তুলে দেয়, তখন পাড়ার মেয়েরা পারুলের কামিজের ভেতরে সাধ্যমতো টাকাপয়সা গুঁজে দেয়...

মিলন: পারুলের একটা পণ ছিল, কিছুতেই সে পতিতা হবে না। অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেও সে অটল থাকে। উপন্যাসের এই জায়গাটি লেখার সময় আমার আনন্দ-বেদনা দুটোই হয়েছিল। মানুষ যে স্তরেরই হোক তার ভেতরে মানবিকতা থাকবেই। মানুষের বিপদে মানুষ পাশে দাঁড়াবেই। পতিতালয়ের মেয়েরাও কোনো না কোনোভাবে পারুলের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তারা উচ্চকিত প্রতিবাদ করতে পারেনি। সরাসরি না থেকেও পারুলকে সহযোগিতা করে তারা পাশে থাকতে চেয়েছে। প্রতিটি মানুষই কোনো এক পর্যায়ে এসে মানবিক হয়ে ওঠে। সেই বিষয়টিই এখানে ফুটে এসেছে।

মাসউদ: উপন্যাসে কলসি ও ব্যাঙের স্বপ্নটা পারুল বারবার দেখে এবং শেষবার পাঠক বুঝে ফেলে, শিকার হওয়া ব্যাঙটি মারা গেছে। ব্যাঙটি কি পারুল নিজেই?

মিলন: হ্যাঁ। উপন্যাসটির নাম দিতে পারতাম ‘শবমেহের’। কিন্তু ‘টোপ’ নামটিই যথাযথ মনে হয়েছে। পতিতালয়ে মেয়েদের টাকার বিনিময়ে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটাকে আমি প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করেছি।