তিনি লিখেছিলেন, ‘তারা গুলি চালায় মাথায়, কিন্তু তারা জানে না, বিপ্লব বাস করে হৃদয়ে’। মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায় তাঁর এই পঙ্ক্তি। মিছিলে-স্লোগানে উচ্চারিত হতে থাকে এই ধ্বনি। মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে, ‘বিপ্লব বাস করে হৃদয়ে’।
অসামান্য এই পঙ্ক্তিই কাল হলো মিয়ানমারের কবি কেথ থির। একই সঙ্গে তাঁকে এনে দিল অমরত্ব। সেদিন ছিল ৮ মে। রোববার। কেথ থি নিজ বাড়িতেই ছিলেন। তাঁর বাড়ি সাগাইং এলাকার শোয়েবোতে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কয়েক সদস্য আচমকা হাজির হলো কেথ থির বাড়িতে। তারা তাঁকে বলল, ‘যেতে হবে আমাদের সঙ্গে।’ কেথ অবাক, ‘কোথায় যাব?’ উত্তর দেয়নি সৈন্যরা। টেনেহিঁচড়ে তুলে নিয়ে গেছে কবিকে। পরদিন কেথের স্ত্রী একটি হাসপাতালে তাঁকে পেয়েছেন বটে, তবে জীবিত নয়। কেথকে শুধু মেরেই ফেলা হয়নি, কেটে নেওয়া হয়েছে তাঁর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ!
কবি–সাহিত্যিক বা তারকা থেকে শুরু করে সম্প্রতি যাঁরাই মিয়ানমারের সেনা সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলেছেন, তাঁদের ওপরই চড়াও হয়েছে সেনাবাহিনী। কারণ কী? যুক্তরাজ্য নিবাসী বার্মিজ কবি, অনুবাদক ও সমকালীন বার্মিজ কবিতার সংকলক কো কো খেট বলেন, ‘যেকোনো অন্যায়–অবিচারের বিরুদ্ধে কবিতা ক্যারিশমার মতো কাজ করে। সাহসকে উসকে দেয় বারুদের মতো।’
পেন ইন্টারন্যাশনাল নামের লেখকদের সংগঠন বলছে, মিয়ানমারে এ পর্যন্ত ৩২ কবি–লেখককে আটক করা হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, গত ৩ মার্চ জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে সরাসরি গুলি চালিয়েছে সেনাবাহিনী। এতে নিহত হয়েছেন কে জা উইন ও মাইত মাইত জিন নামের দুই কবি। এ ছাড়া, ১৪ মে ইউ সাং উইন নামের এক কবিকে অজ্ঞাতনামা এক দুষ্কৃতিকারী পেট্রল ঢেলে দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। ইউ সাং উইন চতুর্থ কবি, যিনি এই জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে নিহত হয়েছেন।
মিয়ানমারের রাজনীতির সঙ্গে এর কাব্য–ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের কবিরা কবিতা লিখেছেন। একইভাবে আগের সেনাশাসনের বিরুদ্ধেও তাঁরা কবিতা লিখেছেন। সেনা সরকার বহু কবিকে কারারুদ্ধ করে রেখেছিল। সে সময় মিয়ানমারের কবিরা চায়ের দোকানে বিভিন্ন সাংকেতিক ভাষায় কথা বলতেন, যাতে ছদ্মবেশী সৈন্যরা তাঁদের আলোচনা বুঝতে না পারে।
দশ বছরের সেনাশাসনের পর ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের মাধ্যমে অং সাং সুচির ন্যাশনাল লিগ অব ডেমোক্রেসি যখন ক্ষমতায় এল, তখন সেই নির্বাচনে ১১ জন কবিও জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ফিরে আসি কেথ থির কথায়। মিয়ানমারের এই বিপ্লবী কবি পেশায় ছিলেন প্রকৌশলী। শুধু কবিতা লিখবেন বলে ২০১২ সালে প্রকৌশলীর চাকরি ছেড়ে দেন। অতঃপর সংসারের চাকা সচল রাখতে শুরু করেন কেক আর আইসক্রিম বিক্রির ব্যবসা। কেথ বেড়ে উঠেছিলেন মিয়ানমারের ছোট্ট শহর মনিয়াতে।
এ কবি কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন শৈশবেই। তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেন, কেথ থির কবিতা ছিল অন্যদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। অনন্য, অসাধারণ। কারণ, তিনি কবিতা লিখতেন হৃদয় দিয়ে। এখন অনেক কবির সঙ্গেই আর দেখা হয় না। কথা হয় না। এমনকি টেলিফোনেও তাঁরা কোনো রাজনৈতিক কথা বলেন না। আটক হওয়ার ভয়ে অনেক কবিই লুকিয়ে আছেন।
এই বন্ধু আরও বলেন, কেথ থি ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি লুকিয়ে ছিলেন না। বিক্ষোভে ছিলেন সরব। তিনি কখনো পিছু হটতেন না।
কো কো খেট বলেন, কেথ থি একমাত্র কবি, যিনি ২০১৭ সালে গু ধার পাইন গণহত্যার বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছিলেন। ওই সময় মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষীরা শতাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছিল।
সম্প্রতি শুরু হওয়া বিক্ষোভে কেথ থি প্রধানত ফেসবুকেই কবিতা লিখতেন। তাঁর কবিতা শত শতবার শেয়ার হতো। মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যেত। তিনি সরাসরি বিক্ষোভ মিছিলেও যোগ দিতেন। ২৭ মার্চের এক জনসভায় তিনি বলেন, ‘এই বিক্ষোভে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য।’
কে জা উইনের কথা বলা যাক এবার। তিনিও বিপ্লবের বলি। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা মনিওয়া শহরের কাছে লেতপাদুংয়ে। চীন ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী যৌথভাবে একটি কারখানা তৈরি করতে গিয়ে কেড়ে নিয়েছে কে জা উইনদের জমি। তারপর থেকে তিনি ভূমি অধিকার নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। ২০১৫ সালে শিক্ষা সংস্কারের দাবিতে এক বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। সেই মিছিল থেকে সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায় এই সন্ন্যাসী কবিকে। প্রায় এক বছর কারাগারে বন্দী করে রাখে। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর মাই রিপ্লাই টু রোমান নামে একটি বই প্রকাশ করেন তিনি। বইটি তাঁকে প্রভূত খ্যাতি এনে দেয়।
নিহত হওয়ার আগে কে জা উইন ফেসবুকে কবিতা লিখতেন। সর্বশেষ লিখেছিলেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার দ্বিমত থাকতে পারে, তারপরও তোমার জন্য আমি আমার জীবন দিয়ে দেব।’
মিয়ানমারে চলমান বিক্ষোভে চার কবিসহ এ পর্যন্ত ৭৯০ মানুষকে মেরে ফেলেছে সেনাবাহিনী। আটক করেছে হাজার হাজার মানুষ। তবু থেমে নেই বিক্ষোভ। ক্ষুব্ধ মানুেষর হাতে শোভা পাচ্ছে প্ল্যাকার্ড। প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘তোমরা আমাদের মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে চাইছ, অথচ তোমরা জানো না, আমরা হচ্ছি বীজ।’
অমর এই পঙ্ক্তির রচয়িতা কেথ থি।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান,নিউইয়র্ক টাইমস