শহীদুল জহিরের অপ্রকাশিত চিঠি

শহীদুল জহির
শহীদুল জহির

ভূমিকা: মোহাম্মদ আবদুর রশীদ
কালজয়ী কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির (১১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩—২৩ মার্চ ২০০৮) ছিলেন আমার প্রিয় বন্ধু। তাই আমাদের মধ্যে পত্র যোগাযোগের ঘটনা ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে পত্রস্থ হওয়া চিঠিটি শহীদুল জহির আমাকে লিখেছিলেন প্রায় ৩৩ বছর আগে। আমি তখন বুলগেরিয়াতে পিএইচডি অধ্যয়নরত আর শহীদুল জহির ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। ব্যক্তিগত নানা প্রসঙ্গ থাকলেও এই চিঠিতে আখ্যানকার শহীদুল জহিরের সত্তাও অস্পষ্ট নয়। বিশেষ করে আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তরে কাজ করে সে সম্পর্কে নির্মোহ মূল্যায়ন এই চিঠিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে বলে মনে করি। সম্প্রতি ব্যক্তিগত কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে চিঠিটি খুঁজে পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল তাঁর সঙ্গে আমার কত না স্মৃতির কথা। আগামীকাল শহীদুল জহিরের একাদশ প্রয়াণবার্ষিকীর প্রাক্কালে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো এ চিঠিটি। এখানে প্রকাশকালে চিঠিতে সমকালীন বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।

রশীদ

তোর দুটো চিঠিই আমি পেয়েছি। তোর গ্যাসট্রিকের সংবাদে চিন্তিত হয়েছি সকলে। ডোরার সঙ্গে টেলিফোনে কয়েক দিন আগে কথা হলো, সেও বলল। তোর অবস্থা এখন কেমন? হঠাৎ করে বাড়াবাড়ি হলো কী করে? তোর আর খবরাখবর কী?

এখানে আমরা মোটামুটি ভালোই আছি। আমি অসাধারণ কাজের চাপে পড়ে গেছি। কী করছি, কাকে উদ্ধার করছি বুঝি না, তবু এই শ্রম দিতেই হচ্ছে। সন্ধ্যের আগে ফিরতে পারি খুব কম দিন। জুলাইয়ের প্রথম নাগাদ এ অবস্থা চলতে থাকবে। আসলে কাকে উদ্ধার করছি সেটা বুঝি না। এটি ঠিক যে দেশ কিংবা জাতিকে উদ্ধার নিশ্চয়ই করছি না, যে আমদানিনীতি তৈরি করার জন্য এ প্রাণপাত পরিশ্রম, সেটা তাদেরই সেবায় লাগবে। তারা কারা? তারা ব্যবসায়ী নিশ্চয়ই। খুব মজার কথা শোনাই তোকে। হোটেল শেরাটনের বলরুমে আমাদের মন্ত্রণালয়ের আমদানিবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির দুটো মিটিং হলো, একটি গত ফেব্রুয়ারিতে আর একটি এপ্রিলে। মন্ত্রীদের এবং আমলাদের মুখোমুখি বসে যাঁরা অবেদন–নিবেদন পেশ করলেন, নিজেদের সুবিধা–অসুবিধার কথা বললেন এবং আগামী আমদানিনীতির জন্য এটা-ওটা সুপারিশ করলেন, তাঁদের ভেতর একদিন দেখলাম সাবেক মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ খানকে, আর একদিন দেখা গেল এম আর সিদ্দিকিকে। একই ব্যক্তি যখন কোনো দিন এপাশে বসে শোনেন অন্য কোনো দিন ওপাশে বসে বলেন। এর ভেতর নিশ্চয়ই কোনো অসংগতি নাই, থাকলে এ রকম হতো না, তাঁরাও এভাবে বসতেন না। আসলে ওপাশে বসে বলাটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেই সব লোক যাঁরা মন্ত্রী ছিলেন না কিন্তু ওপাশে ব্যবসায়ীদের দলে বসে কথা বলেন, আমরা সব সময়ই তাঁর মন্ত্রী হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখি। এদিকে দেশে আবার নির্বাচন এসে গেল, তোরা ওখানে এসব বিষয়ে কতটুকু খোঁজখবর পাস? এ নিয়ে বোধ হয় আর কারওই তেমন কিছু বলার নাই, সকলেই ক্লান্ত, নিরুৎসুক।

আর কী লিখব। তোর অধঃপতনের কথা ডোরাকে বললাম, সেই যে, এখন তুই বিবাহিত সে কথা ভাবতে তোর ভালো লাগে, সে কথা শুনে ভদ্রমহিলা হাসলেন। মনে হলো তাঁরও অবস্থা খুব ভালো নয়। আসলে তোর স্ত্রীকে আমি দুদিন ফোন করেছি। প্রথম দিন তিনি বললেন, জানেন আব্বা এসেছেন। তিনি এমনভাবে বললেন, এতটা অকৃত্রিম এবং আন্তরিক আনন্দের সঙ্গে যে আমি, পুরোনো সেই অবিশ্বাসী, এক মুহূর্তের জন্য ভুল করলাম, মনে হলো ওর বাবা বোধ হয় ফিরে এসেছেন, ভুলটা হয়ে গেল, তারপর তিনি যখন বললেন যে তাঁর আব্বা অসুস্থ বোধ করছিলেন কিন্তু আতিক দেখে বলেছে যে কোনো কিছু হয় নাই, তখন বুঝলাম কার আব্বা এটা। আসলে এবারও বোধ হয় বোঝায় ভুল থেকে গেল। এ কারণেই মনে হচ্ছে, তোর ভালো লাগাটা বোধ হয় একতরফা নয়।

গতকাল ইকরামের একটি চিঠি পেলাম। ওর একটি ছেলে ছিল, এখন একটি মেয়ে হয়েছে। মেয়ের নাম রেখেছে সে, হাসিনা।

এ পর্যন্তই। আমি ভালো। ভালোবাসা রইল।

শহীদ
২ /৫ / ১৯৮৬