শুনেছি শেষটা এমন হয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ওকগাছের পাতা থেকে গড়িয়ে পড়ছে শিশির আর টুপ করে বরফ হয়ে যাচ্ছে। দিগন্তের আড়াআড়ি উঁচু টিলায় বাঁকা চাঁদে চোখ আটকে যায়। টেবিলে মাথা রেখে আর্টিকেলটা নিয়ে ভাবি আমি। ‘জানালার ওধারে সুবিশাল ফাঁকা জমি, খররৌদ্র, দহের বাতাস, উড়ন্ত পাখিরা’— শব্দগুলো লিখেছি শুধু। কিছুতে মন বসে না। হেমন্তের হিমসন্ধ্যায় স্টাডি-ল্যাবে আমি আর পিটার। দূরের টেবিলে ডিয়ানা ফন্তানা সাউথ আমেরিকার স্টোরি লিখছে। ঢালের ওপর এক ফালি মেঘ র‌্যাসপবেরির ঝোপ গলে হাঁ করে থাকে। পিটারকে বলি, ‘আমাদের দেশেও বিরাট আকাশ আছে, জানো! গুলঞ্চ আর দোনার ঝোপ দিয়ে এমনই চাঁদ আছে।’
আমার অর্থহীন বাক্যালাপে পিটার হু-হাঁ কিছুই বলে না। ‘সাউথ এশিয়ান উইম্যান সাপরেশন’ বিষয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। কিছুতেই আমি ফ্লেমিংসবেরি থেকে সকাল সাতটা পাঁচের বাসটা ধরতে পারি না। তুনেলবনাতে হন্তদন্ত এসে বাস মিস করে পুরোনো কবরখানায় ঘুরে বেড়াই। পিটার খুবই বিরক্ত। বিশেষত প্রজেক্ট সাবমিশনে গ্রুপ মিটিংগুলোতে সবাইকে থাকতে হয়। আমার কি ক্লাস্টোফোবিয়া আছে? পিটার জানতে চায়। আমি জানালা দিয়ে বাইরে দেখি, তুষারপাতের তো আরও ঢের দেরি। গাছের পাতাগুলো এখন দগদগে লাল। ঘাসের ওপর এখনো বুনো পালক, সন্ধ্যার বাতাসে গাঢ় অন্ধকার নুয়ে পড়তে এখনো তো ঢের বাকি।
ল্যাবের ভেতর একটা মৌন বাদামি আর খয়েরি লালের আঁকাবাঁকা আলমিরা। প্রতিদিন মাসরুম আর বিস্বাদ ড্রাই বিফ স্যাঁতসেঁতে লাঞ্চ বক্সে করে নিয়ে আসি। মেশিনে কয়েন ঢেলে দিই। হাত থেকে আচমকা ছলকে পড়ে কফি, পিটার মুসরেফ দেওয়ানের মতো হাসে। আমার অপটুত্বের মাধুরীতে সে বিমোহিত। আমি কেয়ার করি না। পিটারকে বলি, ‘কফি ছলকে পড়াটাও সাউথ এশিয়ান সাপরেশনের পার্ট।’
রাতের নির্জন ল্যাবে কফিটাই উত্তাপ দেয় আমাকে।
আমার আর্টিকেল ইস্পাতের অক্ষর বনে যায়। দুর্গম প্রান্তর, কেয়ারি ফুল আমাকে আটকে দেয়। ঝোড়ো হাওয়ায় টারকুইজ গ্রিন আকাশটা দেখলেই চৈত্রের সোনালুর কথা মনে আসে। যেন এক জাদুকরের একমাত্র কন্যা মিরান্ডা আমি। কী সব লিখতে বসেছি।
নিলস আমাদের কোর্স টিচার। সূর্যকান্তি মুখ তার। গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ে বলে, ‘তোমার আর্টিকেলের কিছুই হয়নি। আমি সেটিসফায়েড নই।’
‘তুমি একটু ব্রেক নাও’ বলে নিলস বই খুলে পড়ে। আমি ওর ঘরটা দেখি। পেগানের প্রাচীন গুহার মতো লরেল বৃক্ষ শাখার একটা ছবি টানানো দরজায়। আমার কনসেপ্ট অব রাইটিং নিয়ে যদি সে কিছু বলে, অপেক্ষা করি।
ফিরে আসতে আসতে ঘোড়ার লেজের লোম বিক্রি করা দোকানিকে দেখি। পাহাড়চূড়ায় আবার সেই ছয়টা পঁয়তাল্লিশে সেভেন ইলেভেন পেরিয়ে সোলনাতে ঢুঁ মারি। ক্লান্ত লাগে। গায়ে রসুনের গন্ধ ঢাকতে একগাদা পয়সন আইভি মেখেছি রাতেও। উলরিকা আমার কো-অর্ডিনেটর, গায়ে রসুনের গন্ধ পায় শুধু। সোফি বার্গম্যান, ডোরিয়া আসে। জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘হবে ডিয়ার।’ কী হবে আমার, ভাবি। নিলস নিখুঁত মাইডিয়ার প্রফেসর। দীর্ঘাকৃতির পুরুষালি চেহারা। সমস্ত গড়নে একটা ক্রিস্টাল শুভ্রতা। ভাইকিং সভ্যতার আবলুশ জলাভূমি তার চোখে। সে আমার সব লেখাজোখা ইগনোর করে। এক রাতের মধ্যেই দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনে লাল কালির কাটাকাটি সমেত পেপার ফেরত পাঠায় ডিপার্টমেন্টের পারসোনাল ড্রয়ারে।
পিটার আমার বিমর্ষতা দেখে বলে, ‘অ্যানি রাইটিং ক্যান বি কনভার্টেড ইনটু কোডস অ্যান্ড দেয়ারফোর, দ্য রেজাল্টস টুডেস ভিজ্যুয়াল মিডিয়া। সুন দেয়ার উইল বি অ্যা টাইম উই উইল ক্যাচ ইওর পোয়েটিক মেলানকলিক মাইন্ড। জানো তো, অ্যা বেস্ট গল্পকার ইনা নাইনটিন্থ টোয়েনটি ইজ ইকুয়াভালেন্ট টু অ্যা ক্রিয়েটিভ কোড ইন মর্ডান টাইমস। সো ইউ আর দি ওল্ড স্টাইল অ্যান্ড কনফিডেন্ট, আই অ্যাম দ্য নিউ স্টাইল অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চারার।’
আমার আর্টিকেলটা আগাগোড়া চেক করে পিটার। এক করালি ডাকা দুপুরে পিটার আমার চুল স্পর্শ করে। বলে, ‘কেমন গুচ্ছ কার্ল। একদম বতিচেল্লি।’ হাত ধরে পিটার, ওর কড়ে আঙুলগুলোতে নীল শিরা দেখা যায়। আমার খুব ঘুম পায়। মাইনাস টোয়েন্টি সেভেনের উইন্টারে তিমির রাত্তিরে নিদ্রার বিবরে ডুবে যাই। পিটার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘শোনো, তোমার হাত যখন কোনো গবেষণা ফেরেববাজি করে, কিছুতেই যেন না জানে তোমার মন কোনো প্রমিতি প্রস্তাব করছে।’
আমার মন খাঁখাঁ করে। মনে মনে বলি, আহ্ হেমন্তের অমল আকাশ তুমি পিটার। মাটি চাপা দেওয়া নিখিলে লাইট গ্রিন মিহি ঘাস। খররৌদ্র কালো মাটি আর আমার বিধ্বস্ত হাইপারটেনসিভ অন্ধতা পরিব্যাপ্ত গভীরতা। আহ্ প্রেম এত সুন্দর! আসলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। আর স্বপ্নে দেখি সে রাতে আমি আচমকা ইমোশনাল চৈতন্যপ্রবাহে লিখতে শুরু করেছি আর্টিকেলটা। আমাদের পাখি না-ওড়া আকাশটার কথা, বোনের মৃত্যুর কথা। বৃষ্টির ফোঁটা জমে থাকা রঙিন কচুপাতা রঙের জামাটার কথা। গল্পের মতো লিখছি। নিল্স পড়ায় ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট। অতএব এটা আমার পুরোটাই জুতসই মনে হয়। আর নিল্স লেখাটা ফাইনাল করে দেয় জার্নালে ছাপা হওয়ার জন্য। পেদ্রোস নিভিস পিটার তাকিয়ে থাকে দূরে মেঘবলয়ে। লাপিসে কনকনে বরফের পিঠে ওর ঘরটা। তার থেকে আমি মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে। ইচ্ছে করে দৌড়ে যাই, ওর ঘরের ফায়ার প্লেসের নুড়িপাথর হই। দিগন্তের আড়াআড়ি উঁচু টিলায় বরফ-সাদা আলো। চাঁদের আলোয় বরফ আরও ছলকায়। আমি পিটারের পাতলা সিফন পাতলুনটা দেখি। পিটার কফিতে চুমুক দেয়। কৃষ্ণবর্ণ রাত্রি, সমুদ্র উত্তাল। অকৃত্রিম আমি। একপেশে রোদ মিলে দলা পাকানো অন্ধকার হাওয়া আমি।
পিটার হঠাৎ বলে, ‘মিরান্ডা, শোনো না, সিরিয়ায় রেশম ফ্যাক্টরিতে ১৯০২ সালে আমিই তো দুরধিগম্য মসলিনের জন্য জেলে আর শিকারিদের ফেনিল উচ্ছল স্রোত সাঁতরে পেরিয়েছি। তুমি আমাকে চেনো নাই। সপ্তগ্রামের বন্দরে...হরীতকী আর রেশমের ফিনফিনে তসর নিয়ে শেষে কি না এই মিসটেরিয়াস আইল্যান্ডে তোমার দেখা পেলাম।’
ঘুম ভাঙে মাঝরাতে। বুঝতে পারি না অনেকক্ষণ স্বপ্ন না সত্যি!

২.

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পিটার, আমি, বন্ধুত্ব, ইনফ্যাচুয়েশন, এনালিটিক ডেপথ, ঔপনিবেশিক প্রহসনের গল্পের দেশগুলো একদিন হারিয়ে যেতে থাকে। আমার চতুর্থ টার্মের সেমিস্টারের আর্টিকেলটাও খাবি খায়। ল্যাব থেকে বের হয়ে ব্যাগে কয়েন খুঁজি। পিটার আচমকা সোনালি উজ্জ্বল মিনা করা কয়েন ঢেলে দেয় টেবিলে। ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ে নিস্তব্ধ ল্যাবের করিডর। ওর ইস্পাতের হাতঘড়িটা চিকচিক করে। পারসিক বাদশাহর মতো লাগে ওকে। কাল রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে আমার। কাল রাতের স্বপ্ন পিটারকে কাছে নিয়ে এসেছে। ওর নীল থ্রাসের মতো ডানা মেলা শার্টের বোতামটার দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার নানা সংশয়। মাঝেমধ্যে ভাবি, পিটারের কাছে আমি কি এমন কেউ, যা আমি কখনো ছিলাম না। তবে যে জানালার ওপারে আমার কাঠালিচাঁপা শৈশব—সে তো অন্য কোনো আমি। এ সে নয়, আমি যার কথা এখন ভাবছি।
আর্টিকেলটা নিয়ে যা-তা অবস্থা দাঁড়ায়। সাউথ এশিয়ার ইনসিকিউরিটি মার্ডার রেপ, উইম্যান সাপরেশন নিয়ে সাবমিশানের ডেডলাইন মিস করি। ১০৩ জ্বরে আমি নিস্তেজ। আর্টিকেল নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখি। জ্বরের ঘোরে শুনতে পাই নিকোল বলছে, ‘নিল্স ছুটতে যাবে।’ নিকোল আমাদের বন্ধু। পরের সেমিস্টারে সে নেই। সাড়ে ১৭ দিনের দুঃসহ ক্লান্তিতে অবসন্ন দেহ মন। ইস্টারের ছুটিতে সব বন্ধ। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
পিটার আর নিকোল আমাকে নিয়ে প্ল্যান করে ফিনল্যান্ড যাওয়ার।
নরসবোরি থেকে বাস ছাড়ে। বাইরে কনকনে ঠান্ডা। পিঠ স্পর্শ করে পিটার। প্রসাধনে স্নিগ্ধ আমি, সোনালি বোতাম ছলকায় মখমল জামার ওপর। ৭৭ নম্বর বাস ছাড়ে। আঁটসাঁট স্কার্টে নিকোল আমি আর নিকোলের বয়ফ্রেন্ড আন্দ্রে। আমার কিছুতেই শরীর সারে না। পুরোনো ক্যাথিড্রালে বসে থাকি। অনেক দিন জ্বরের কারণে শরীর খুবই দুর্বল। পিটার যেন দূরের দ্বীপ। স্বপ্নে পিটার কত কাছে আমার। আমার নান হতে ইচ্ছে করে। কী সুন্দর সাদা ভাঁজ করা গোটানো শার্টিন পরে তারা। গির্জার ঘণ্টাধ্বনি বেজে চলেছে অবিরাম। কী মোহনীয় বন্দর! আহ্ এখানেই সারা জীবন যদি কেটে যেত। এই ছাইরঙা আকাশ প্রেইরি তটরেখা এত ভালো লাগে। পারস্য গালিচার মতো সাদা নিবিড় বৃত্তাকার জলাশয় অচেনা শহরতলি। পুরোনো সাবওয়ে স্টেশন। তাজা অলিভ ঘাস। স্প্লিনডিড।
পিটার চোখ পিটপিট করে আমাকে দেখে। ফান করে। বলে, ‘এখানে ডিপ্রেশন আসার কারণ কী বলো তো? মাইনাস থার্টিতেও তো বুকে প্রেমের আগুন আমার হা হা...।’
পিটার গল্পে মশগুল। বলে, ‘রোমে সেবার পিয়েতা দেখেছিলাম, জানো! বিরল ঝোপের পিছে বসে ক্যানারি আইল্যান্ডে কমলার মতো বিদেশি লিপসে চুমু খেয়েছি কত। কী নিদারুণ সে স্থবির ভেনাস সব। সবই শ্রমের মজুরি, বুঝলে। একদিন সেই ক্যানারি আইল্যান্ড হয়ে আমার টিমের ডিজাইন করা বোট আটলান্টিক ওশেনে পার্টিসিপেইট করেছে। হিমস্রব নর্থ আটলান্টিকের আন্ডার ওয়াটার নেভিগেশন জরিপ করেছি ইঞ্চি বাই ইঞ্চি।’
ওর প্রেমের গল্প কিছুতে শেষ হয় না। নিকোল বলে, ‘আমি জানি পিটার এখন কী বলবে। কিছুদিন আগে এক ইরানি মেয়ে তাকে উন্মাদ বানিয়েছিল। সো প্রিটি। ওর নেক ইজ সো ট্রান্সপারেন্ট। লাইক কনগলেস। পানি খেলে ইউ ক্যান সি ফর ইনসাইড হার স্কিন। সে ছিল আমার অ্যাসোসিয়েট অ্যাট ওয়ার্ক। অপরূপ সরল সে। অ্যাটস্যাটরা...’
আমার বিমর্ষ লাগে। আমার সম্বল শুধু স্মৃতি। নিদারুণ মৃত্যুর স্মৃতি।
মধ্যরাতে পাতলা ছিন্ন মার্কিন কাপড়ে মুড়ে থাকা মৃত পা দুটি আমার চোখের সামনে সারাক্ষণ ভাসে। সাদা জামা, সবুজ ফুল আঁকা। কোমল সরু লতার ডিজাইন। কুঁজোয় ঠান্ডা জল দিয়ে ওর মুখটা ধোঁয়া। বারান্দার নরম মাদুরে বিছানো দেহ। আহ্ এই দৃশ্য দেখেছিলাম অবাক চোখে আমরা। রৌদ্র হাওয়া দাপাদাপি করা সেই করালি ডাকা ফাল্গুন দুপুর থেকে আমি আজ কত দূরে। দমকা হাওয়ায় ভেজা হলুদ মাটিতে নুয়ে পড়ছে গাছের কাণ্ড-পাতা।
আর এখন যখন ফাল্গুন আকাশে চাঁদ থাকে, আশ্চর্য খণ্ড সাদা মেঘ ভাসে। মেঘের ভেতরে কোন গ্রীষ্মে এত লু হাওয়া বয়! বৃষ্টিতে জলকাদা মাখামাখি হলে, আপার কবরে জল জমে ঘুটঘুটে কালো কাদায় বড়বেশি প্যাচপ্যাচে হবে বলে আমরা সারা রাত বৃষ্টি পাহারা দিয়েছিলাম সেবার।
বৃষ্টি বেশি হলে জলে যেমন স্রোত হয়, স্রোতটা রুপালি নদীর মতো বুকে বিঁধে। আমার বুকে সেই অদৃশ্য জলের স্রোত আজ। পিটার বলে, ‘এমন বিষাদ ছড়ালে...।’
পিটার শ্যামলকান্তি যুবক। বড় প্রেমময়।
বলে, ‘এক চকিত মুহূর্তে আমি তোমার যে মুখশ্রী দেখেছিলাম তা তুমি আর কি ফিরে পাবে না?’

৩.
নিকোল, পিটার আর আমি সেই গোটা বসন্তকাল বালিপথে অলস দ্বীপে অনুপম উদ্ভিদের মতো বসে থেকেছি। সাইপ্রেসের সারি বেয়ে সূর্যের শেষ রশ্মি গায়ে মেখে নেওয়ার জন্য আমরা কী উন্মাতাল হয়েছিলাম! চেরিগোটে নের্ভালের গল্প নিয়ে থিয়েটার দেখিছি কত। সিঁথেরার পথের ছবি আঁকত পিটার গির্জার প্রার্থনা শুনতে শুনতে। আরও আশ্চর্য হয়েছি স্কুগসিরকোগার্টেনে প্রোটেস্ট্যান্ট কবরখানা দেখে। দিগন্ত অবধি অচেনা সমুদ্রবন্দরে, কনকনে ঠান্ডায় পপলারের ছায়ায় সূর্যের উত্তাপের প্রতীক্ষায় থেকেছি। ভিসতুলার পাশে যেন ম্রিয়মাণ জলের ফোঁটা আমরা। সেঁটে ছিলাম, কোনো দিন ভাবিনি আমাদের আর দেখা হবে না। মলিয়ের ডন জুয়ান দেখতে গিয়ে আমরা কুঞ্জভোরে গীত গেয়েছি কত। সেখানে নিকোল করেছিল এলভিরা চরিত্র। দেখা হয়নি আর নিকোলের সঙ্গে।
এরপর পাতাল রেলে, ইট খসা কার্নিসে হেলান দিয়ে যখন হ্যান্ড গ্লাভস খুঁজছিলাম। হঠাৎ দেখি দূরে পাখিকে খাওয়াচ্ছে পিটার। বিপন্ন অদ্ভুত সমর্পিত ওর পাখিপ্রেম। আকস্মিক দেখা হয় একদিন অপেরায়। মনে পড়ে, ওফেলিয়া বলে চিৎকার করত পিটার আর নিকোল হেসে গড়িয়ে পড়ত।
আর বৃষ্টি বেশি হলে জলের বাড়তি স্রোতটা ছলকে পড়ে বুকের মধ্যে আমার।
নয় হাজার ৫৫৫ বছর আগের স্পারফি হানি বৃক্ষশাখায় সূর্য ডুবে যাচ্ছিল, টকটকে লাল। নিরক্ষীয় অরণ্যের শূন্যতা বুকে।
মনে মনে বলেছিলাম, অদ্ভুত তুমি পিটার। তুমি যে বলতে ধু ধু মার্সল্যান্ডে নিয়ে আমাকে, ‘আশ্চর্য জুনিপার ফুটেছে দ্যাখো।’ গথিক গির্জায় রশ্মি জ্বলে, রাত্রি ফের। একই কবরখানায় আবার দেখা হয়। সুবিস্তীর্ণ ডন জুয়ানের নৌকাডুবিতে যেমন। শিলাময় আগ্নেয় পুরুষ যেন পিটার। মনে মনে বলি, শুকুন্তলার থিয়েটারে আরও একবার উদাসীন হও না পিটার। তারপর যেদিন থার্টি ফার্স্টে সলসেনে দেখা হয়, সাবলীল কোমল সে চেয়ে থাকে। তারপর আবার অনেক দিন পর পিটারকে দেখেছিলাম অন্য এক নদীর তীরে। অটামের জুনিপার লাল ফুল ঝরছিল যখন। যথেষ্ট সময় ছিল না। শুধু ভাবছিলাম, অন্য কোথাও অনেক দিন আগে কী সব ঘটেছিল...!