শেষ কথাটা হলো না সিরাজী ভাই

আজ প্রয়াত হয়েছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো এই লেখা।

কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী

২০১৯ সালে যখন অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলাম, তখনই বাংলাএকাডেমির মহাপরিচালকের আসনে এলেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। সিরাজী ভাইয়ের আগমনে চিন্তার পরিসর একেবারে উন্মুক্ত হয়ে গেল। প্রাথমিক আলোচনায়ই বলে দিলেন, ‘সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় রেখে যতটা সম্ভব মাত্রা যোগ করুন। আপনার যা ইচ্ছা, নির্দ্বিধায় বলুন, কথা হোক। তারপর সম্ভাবনা যাচাই করে সামনে এগিয়ে যাওয়া যাবে। বইমেলার মতো জাতীয় আয়োজনে একজন স্থপতির অন্তর্ভুক্তি কতটা জরুরি এবং গুরত্বপূর্ণ, নিয়মিতই সবাইকে ব্যাখ্যা করলেন। আমি পেলাম প্রবল উৎসাহ।

স্বায়ত্তশাসিত হলেও সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রধানের এই ভূমিকা ভীষণ আশাবাদী করে। বইমেলার সদস্যসচিব জালাল ভাইও শক্তি পেলেন এগিয়ে যাওয়ার। এভাবেই সিরাজী ভাইয়ের অভিভাবকত্বে ২০১৯ থেকে অমর একুশে বইমেলার আয়োজনে একধরনের রূপান্তরপ্রক্রিয়া শুরু হয়, যার ফলাফল কিছুটা হলেও দৃশ্যমান হয়েছে পরবর্তীকালে। প্রশংসাও পেয়েছে।

এবারের মেলার নানান চ্যালেঞ্জ নিয়ে শেষ যেদিন কথা হয়, বললেন, ‘এটা দুঃসময়। আপনার নতুন বুদ্ধিগুলো সব জমা করে রাখুন, সব এক–এক করে কাজে লাগবে সামনে। আগে সময়টা পার হই। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, কথা হবে আবার।’

এই বিষয়ই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ও আবেগের। চলমান দৃষ্টিভঙ্গি, অভ্যাসের ধারা মেনে নিয়ে ‘হুজুর হুজুর’ তোষামোদি মনোভাব নিয়ে আর যা–ই হোক, রূপান্তরপ্রক্রিয়া সম্ভব নয়। আবেগ বললাম এই জন্য যে এ দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক উদ্‌যাপনের অন্যতম জাতীয় আয়োজন অমর একুশে বইমেলার সঙ্গে আমাদের চিন্তা, চৈতন্যচর্চার অনেক কিছুই জড়িত। সেটাকে আরও বিস্তৃতভাবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্মুক্ত করা, উদ্যোগে সাড়া দেওয়া, দৃঢ় মানসিকতা ছাড়া অসম্ভব। যে সময় নানাভাবে সংকুচিত হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সেই সময় সৃজনশীল পেশাজীবীদের সম্মান দিয়ে নতুন চিন্তা ও কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়ার মতো জরুরি দায়িত্ব নিয়েছিলেন সিরাজী ভাই। খুব কম সময় পেয়েছেন তিনি, আমি শুধু আমার সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতার কথাগুলোই বললাম। তাঁর মৃত্যু সংবাদটা পাওয়ার পর ভীষণ বিষণ্নতা গ্রাস করল। নিত্যনতুন আইডিয়া, ধারণা যা–ই বলি, সেটা আমার প্রাণের বিষয়। বেঁচে থাকার রসদ। গৎবাঁধা কোনোকিছু দেখলেই মনে হয় পাল্টে ফেলি, নতুন কিছু করি। লজ্জা–দ্বিধা ফেলে বলি অনেককেই। সাড়া দেয় কয়জন? বইমেলা নিয়ে যখন যা কিছু মাথায় এসেছে, সিরাজী ভাইয়ের দরজা সব সময় খোলা। শুনেছেন মনোযোগ দিয়ে। তারপর দিয়েছেন পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা।

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় স্থাপনা ধারণা প্রদর্শনীর উদ্বোধনে হাবীবুল্লাহ সিরাজী, এনামুল করিম নির্ঝরসহ অন্যরা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এই কয়েক বছর অমর একুশে বইমেলার আয়োজনে সংযুক্ত হয়ে আমি এবং আমার সহকর্মীরা যেটুকু প্রশংসা পেয়েছি, তার মূল ভূমিকায় ছিলেন সিরাজী ভাই। তিনি ঠিক সময়ে দরজাটা খুলে না দিলে সম্ভাবনার পরিসরে ঢোকাই হতো না ঠিকমতো। আমরাও থাকব না একসময়, কিন্তু এই আয়োজন এরপর ধাপে ধাপে যেদিকে যাবে, তার রূপান্তরপ্রক্রিয়ার চাবিটা শুরুতে সিরাজী ভাই ঘুরিয়ে দিয়ে গেলেন সময়মতো। যেভাবে এগোচ্ছিল, আন্তমাধ্যম পেশাজীবীদের নৈপুণ্যচর্চার বাৎসরিক উদ্‌যাপন উৎসব হয়ে উঠত হয়তো–বা।

এবারের মেলার নানান চ্যালেঞ্জ নিয়ে শেষ যেদিন কথা হয়, বললেন, ‘এটা দুঃসময়। আপনার নতুন বুদ্ধিগুলো সব জমা করে রাখুন, সব এক এক করে কাজে লাগবে সামনে। আগে সময়টা পার হই। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, কথা হবে আবার।’ আপনি তার আগেই চলে গেলেন সিরাজী ভাই। আপনার অন্তিম যাত্রা মসৃণ হোক। আত্মা শান্তি পাক।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]