সংকটময় দিনের দলিল

দিনলিপি
দিনলিপি

দিনলিপি
শামসুজ্জামান খান
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
অন্বেষা প্রকাশন
৩৫১ পৃষ্ঠা
দাম ৩৫০ টাকা
গ্রন্থের শুরুতেই ‘প্রাক-কথন’-এ লেখক শামসুজ্জামান খান জানিয়েছেন তাঁর ডায়েরি বা দিনলিপি লেখার কথা। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি তা লিখতেন। কিন্তু বর্তমান দিনলিপি তিনি লিখছেন, তাঁর ভাষ্যমতে, ঠিক তখন থেকে, বাংলাদেশে যখন থেকে শুরু হয় ‘ইতিহাসের এক জটিল মুহূর্ত’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রসত্তা অর্জিত হয়, তাকে পাল্টে দেওয়ার এক ঘোর চক্রান্ত’। আরও জানাচ্ছেন, ‘ইতিহাসের সেই কালো মুহূর্তগুলোকে আমি এই দিনলিপিতে ধরে রাখার প্রয়াস পেয়েছি।’ ফলে তাঁর এই দিনলিপি সাধারণ কিছু নয়, হয়ে উঠেছে আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের একটি নির্দিষ্ট কালপর্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনারও বিবরণধৃত দিনপঞ্জি।
তাঁর ডায়েরি শুরু হচ্ছে ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একেবারে মাঝামাঝি সময় থেকে। এটিই এ বইয়ের বড় অংশ। তারপর ১০ বছরের শূন্যতা। তার পরের অংশ শুরু হচ্ছে ১৯৯৬ সাল থেকে। ধারাবাহিকভাবে চলছে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। আরও ১০ বছরের দিনলিপি। অর্থাৎ এ বই শামসুজ্জামান খানের মোট ২০ বছরের জীবনের অনুভব, অনুভূতি, অবলোকন ও ঘটনার প্রেক্ষাপটে নিজের মন্তব্যধৃত বিবরণ-ভাষ্য, যা তুলে ধরা হয়েছে তারিখসহ ডায়েরির আকারে।
এ বইয়ের পাঠ শেষে মনে হয়েছে, এ যেন দিনলিপি নয়, একটি নির্দিষ্ট সময় বা কালপর্বে সংঘটিত বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক ঘটনাধারাভিত্তিক ক্ষুদ্র আকারের প্রবন্ধের সংকলন এটি। শামসুজ্জামানের রচনা ও পর্যবেক্ষণগত গুণে প্রতিটি তারিখের ঘটনা, সেই সঙ্গে তাঁর সংযোজিত মন্তব্য এই দিনলিপিকে তেমন মর্যাদারই অধিকারী করে তুলেছে।
দৃষ্টান্ত হিসেবে ১৯৭৬ সালের ২৬ মার্চের কিছু ঘটনার বিবরণ লেখক আমাদের সামনে যেভাবে হাজির করেছেন, তা তুলে ধরে দেখা যাক। দেশবাংলা পত্রিকায় সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সংগ্রামের সুবিধাভোগী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করায় শামসুজ্জামান খান তাঁর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন এভাবে, ‘এককালীন ছাত্রলীগ নেতার উপর্যুক্ত মতলবি বক্তব্য বিস্ময়কর। তার এ অধঃপতন আমাকে পীড়া দিয়েছে।’ একই তারিখে দৈনিক আজাদ-এর একটি মন্তব্য-ভাষ্য সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি বলছেন, ‘আজাদ পত্রিকা তার জঘন্য ভূমিকায় পুনরায় অবতীর্ণ হয়েছে। ১ মার্চ এ পত্রিকা পুনরায় বেরোনোর দিন থেকেই এর চরম প্রতিক্রিয়াশীল রূপ লক্ষ করা যাচ্ছে। এই দিনে এরা টেলিভিশনকে সমালোচনা করে একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রচারিত একটি গানের জন্য। গানটি হলো: “ওরে বাঙালি ঢাকার রাস্তা রক্তে ভাসাইলি”। আজাদ প্রথম পাতায় প্রকাশিত এক সংবাদ-ভাষ্যে বলেছে: এ গানে ১৯৫২ সালে ক্ষমতায় আসীন ছিল এমন একটি দলের প্রতি ঘৃণা প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান সরকার যেহেতু “নিরপেক্ষ”, তাই এ ধরনের “বিদ্বেষমূলক” গান প্রচারিত হওয়া উচিত নয়। হায় যুক্তি! হায় আজাদ!’
সারা বইয়ে এ জাতীয় ঘটনার ছড়াছড়ি। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক কোনো ঘটনা, ছোট আর বড়, সহজেই তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। সংক্ষিপ্তভাবে হলেও, তিনি তারিখ ধরে ধরে তা তুলে ধরেছেন, সেই সঙ্গে যুক্ত করেছেন নিজের যৌক্তিক মন্তব্য।
কী তীক্ষ্ণ তাঁর দৃষ্টি! দিনটি ১৯৯৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, দিনলিপিতে তিনি তুলে ধরেছেন নিম্নলিখিত ঘটনার বিবরণ, যেখানে বলছেন, ‘বিকেলে আইটিআই-এর সেমিনারে এসেছিলেন জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরী। তিনি বললেন, কবি শামসুর রাহমানকে হত্যা করতে গিয়ে যে দুজন ধরা পড়ে, তার একজনকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এক সামরিক কর্মকর্তা। হরকাতুল জিহাদ নামের মৌলবাদী ও তালেবানি সদস্য বলে কথিত ও ধৃত ব্যক্তি নাকি সামরিক কর্মকর্তার ভ্রাতুষ্পুত্র। অতএব আট খুন মাফ।’
বস্তুত এ বই মামুলি দিনলিপি নয়। কেবল ব্যক্তিক অনুভূতির জারকে সিক্ত করা হয়নি এর পৃষ্ঠা বা পাতাগুলো। আগেই বলেছি, আমাদের জাতীয় জীবনের একটি নির্দিষ্ট কালপর্বের জ্বলজ্বলে দলিলবিশেষ শামসুজ্জামান খানের এই বই, দিনলিপির আকারে যা তিনি তুলে দিয়েছেন আমাদের হাতে।