সমকালীনদের চোখে বিদ্যাসাগর

বাঙালির নবজাগরণের অন্যতম কান্ডারি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আজ ২০০তম জন্মদিন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফিরে তাকানো যাক তাঁর সময়ে। সমকালীনদের চোখে কেমন ছিলেন বিদ্যাসাগর?

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

বিধবাবিবাহকে আইনসংগত করার জন্য ১৮৫৫ সালে যে আবেদনপত্র দাখিল করা হয়েছিল, তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন ৯৮৭ জন ব্যক্তি। সর্বশেষ স্বাক্ষরটি ছিল স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। আর এই আবেদনের বিরোধিতাকারী পাল্টা আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রায় ৩৬ হাজার ব্যক্তি। বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে এই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাধাকান্ত দেব। দুই আবেদনের সমর্থকদের সংখ্যার বিশাল তারতম্য দেখে সেই কালের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের একটি চিত্র পাওয়া যায়। বোঝা যায় কী প্রতিকূল পরিস্থিতিকে ডিঙিয়ে বিদ্যাসাগরকে অগ্রসর হতে হয়েছিল। শুধু বিধবাবিবাহ নয়, জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাঁকে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। তবে শুধু বিরোধিতা নয়, সংখ্যায় কম হলেও একদল সহযোগী সুহৃদও বিদ্যাসাগর পেয়েছিলেন তাঁর পাশে।

১২৭৯ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস ‘বিষবৃক্ষ’। এই উপন্যাসের নায়িকা সূর্যমুখী বলেছে, ‘ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে?’
এভাবেই ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে আঘাত হেনেছেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বিদ্যাসাগরকে ‘মূর্খ’ বলা শুধু সূর্যমুখীর বক্তব্য নয়। বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, বহুবিবাহ রোধসহ বিদ্যাসাগরের সমস্ত সামাজিক আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। কুমার বিনয়কৃষ্ণ দেবকে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘...শাস্ত্রের দোহাই দিয়া কোনপ্রকার সমাজসংস্কার যে সম্পন্ন হইতে পারে, অথবা সম্পন্ন করা উচিত, আমি এমন বিশ্বাস করি না। যখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বহুবিবাহ নিবারণের জন্য শাস্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করিয়া আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন, তখনও আমি এই আপত্তি করিয়াছিলাম এবং ...সেমত পরিবর্তন করার কোন কারণ দেখি নাই।...বাঙালি সমাজ শাস্ত্রের বশীভূত নহে—দেশাচার বা লোকাচার বশীভূত।’ বাংলা ভাষা, গদ্যরীতি ও সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদানকে তাচ্ছিল্য করে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে সামান্য অনুবাদক ও শিশুপাঠ্য রচয়িতার বেশি মর্যাদা দেননি। সাহিত্যিক মূল্য বিচারে তিনি বিদ্যাসাগরকে ঈশ্বর গুপ্তেরও নিচে স্থান দিয়েছেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

‘সীতার বনবাস’কে বলেছেন ‘কান্নার জোলাপ’। ঈশ্বর গুপ্ত ও তাঁর সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ তীব্র শ্লেষ ও রুচিহীন ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছে বিদ্যাসাগরকে। ‘সংবাদ প্রভাকর’–এর পাতায় প্রকাশিত হয়েছে নিম্নরুচির গান, ‘আমি শুনে এলেম ওদের টোলে, শুনে মন/ গেল উতুলে, রাঁড়ের বিয়ের ছাপা নাকি এসেছে। ...বুঝি বিদ্যাসাগর এতদিনে, বিধবা নারীগণে,/ একলা শোয়ার কত জ্বালা জেনেছে।’

সামাজিক কুপ্রথা ও অন্ধকার দূর করতে বিদ্যাসাগরের আন্তরিক চেষ্টায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল প্রভাবশালী বঙ্কিমচন্দ্র এবং জনপ্রিয় ঈশ্বর গুপ্তের রক্ষণশীল ও প্রগতিবিরোধী ভূমিকা। তাঁদের ব্যক্তিগত আক্রমণের জবাবে বিদ্যাসাগর কখনো পাল্টা আক্রমণ করেননি। তাঁর উন্নত রুচির মহত্ত্ব এখানেই। তিনি অন্ধতার বিরুদ্ধে হাতিয়ার করেছিলেন যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে। বিদ্যাসাগর যুক্তিকে চাবুকের মতো চালিয়েছেন মানুষের বিবেক বোধকে জাগ্রত করার জন্য। ভর্ৎসনার সুরে বলেছেন, ‘হা ভারতবর্ষীয় মানবগণ! ...হতভাগ্য বিধবাদিগের দুরবস্থা দর্শনে, তোমাদের চিরশুষ্ক নীরস হৃদয়ে কারুণ্যরসের সঞ্চার হওয়া কঠিন, এবং ব্যভিচার দোষের ও ভ্রূণহত্যা পাপের প্রবল স্রোতে দেশ উচ্ছলিত হইতে দেখিয়াও, মনে ঘৃণার উদয় হওয়া অসম্ভাবিত। ...হায়, কী পরিতাপের বিষয়! যে দেশের পুরুষজাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায়-অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিক রক্ষাই প্রধান ধর্ম ও পরম ধর্ম, আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলা জাতি জন্মগ্রহণ না করে।’ (‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিৎ কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’)। বঙ্কিমচন্দ্র যখন ‘দেশাচার বা লোকাচার বশীভূত’ ‘বাঙালি সমাজ’–এর গোঁড়ামির পক্ষে কলম ধরেছেন, তখন বিদ্যাসাগর ‘লৌকিক রক্ষা’র বিরোধিতা করেছেন। যুক্তিহীন বিধিনিষেধ তথা লোকাচারের প্রবল বিরোধিতা করে নবজাগরণের যুক্তিবাদী চিন্তার আলোকে বিদ্যাসাগর বলেছেন, ‘আমি লোকাচার-এর নিতান্ত দাস নহি।’

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে সুর পাল্টান বঙ্কিমচন্দ্র। ‘প্যারীচাঁদ মিত্রের রচনাবলী’র ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর। তাঁহার পূর্ব্বে কেহই এরূপ সুমধুর বাঙ্গালা গদ্য লিখিতে পারে নাই, এবং তাঁহার পরেও কেহ পারে নাই।’ আরেক লেখায় তিনি বলেছেন, ‘বিদ্যাসাগর মহাশয়ের রচিত ও গঠিত বাংলা ভাষাই আমাদের মূলধন। তাঁরই উপার্জিত সম্পত্তি নিয়ে নাড়াচাড়া করছি।’

বিদ্যাসাগর তাঁর সামাজিক আন্দোলনে কয়েকজন সহযোদ্ধা পেয়েছিলেন। তাঁদের অন্যতম অক্ষয়কুমার দত্ত। তাঁর জন্ম বিদ্যাসাগরের জন্মের বছর ১৮২০ সালে। যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা ও জাগরণের আলোকিত আদর্শের প্রেক্ষাপটে অক্ষয়কুমার ও বিদ্যাসাগরের চিন্তাধারার সাদৃশ্য অতুলনীয়। ‘বিদ্যাসাগর’ বইয়ে বিহারীলাল সরকার লিখেছেন, ‘শোভাবাজার-রাজবাটীতে অক্ষয়কুমার দত্তের সহিত বিদ্যাসাগরের আলাপ-পরিচয় হয়। তখন অক্ষয়বাবু “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা”র সম্পাদক ছিলেন। বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার উভয়েই রাজবাটীতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ইংরেজী, অঙ্ক ও সাহিত্য পড়িতে যাইতেন। তাঁহারা ছাদের উপর বসিয়া খড়ি দিয়া, অঙ্ক পাতিয়া, জ্যামিতির প্রতিজ্ঞা পূরণ করিতেন।’ তখন থেকে তাঁদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিনিময়, আলাপ-আলোচনার শুরু। এর মধ্য দিয়েই দুজনের বন্ধুত্ব এবং কিছুদিনের মধ্যেই সেই বন্ধুত্বের রূপান্তর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধায়। বাংলা ভাষা ও গদ্যের বিকাশ, শিক্ষা ও সমাজসংস্কার, সমাজে যুক্তিবাদের প্রসার ইত্যাদি ক্ষেত্রে সর্বশক্তি নিয়ে আজীবন তিনি বিদ্যাসাগরের পাশে ছিলেন।

১৮৫১ সালে অক্ষয়কুমারের ‘বাহ্য বস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’ বইটি প্রকাশিত হয়। এটি সেই সময়ের নিরিখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আমি কোথায় আর তিনি কোথায়—আমি খুঁজিতেছি ঈশ্বরের সহিত আমার কী সম্বন্ধ। আর তিনি খুঁজিতেছেন বাহ্য বস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির কী সম্বন্ধ। আকাশ-পাতাল প্রভেদই বটে।’ তারপর অক্ষয় দত্ত প্রকাশ করলেন ‘চারুপাঠ’ (১৮৫৩)। এই বইয়ে প্রথম ভাগে তিনি লিখলেন, ‘...জন্তুর ন্যায় কেবল নিজের ও নিজ পরিবারের ভরণ-পোষণ করিয়া ক্ষান্ত থাকা মনুষ্যের ধর্ম্ম নয়। ...আপন জীবিকা নির্বাহের চিন্তা করা যেরূপ আবশ্যক, সময়ে সময়ে একত্র সমাগত হইয়া, স্বদেশের দুঃখ-বিমোচন ও সুখ সম্পাদনার্থ যত ও চেষ্টা করাও সেইরূপ আবশ্যক।’ এই বইগুলিকে ছাত্রদের পাঠ্য তালিকায় স্থান দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি বলেছিলেন ‘সাংখ্য-বেদান্ত ভ্রান্ত দর্শন।’ অক্ষয়কুমার ব্রাহ্ম সভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘বেদ অপৌরুষের নয় এবং সে কারণে অভ্রান্তও নয়।’

অক্ষয়কুমার দত্ত

তখন বিধবাবিবাহ আন্দোলন নিয়ে তুমুল আলোড়ন। বিদ্যাসাগরের সামনে পর্বতপ্রমাণ বিরোধিতা। বিধবাবিবাহের পক্ষে সমস্ত শাস্ত্রীয় প্রমাণ জোগাড় করে, তার ব্যাখ্যা-টীকাসহ সম্পাদনা করে তিনি ১৮৫৫ সালে লিখলেন ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিৎ কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় সে বক্তব্য প্রকাশ করেন অক্ষয় দত্ত। সে বক্তব্যের সমর্থনে অসুস্থ শরীর নিয়েও পরের সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন শক্তিশালী প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে তিনি বিদ্যাসাগরের বক্তব্য জনসাধারণের মনে কী বিপুল প্রভাব ফেলেছে, তার বিস্তারিত বিবরণসহ আরও নানা দিক বিশ্লেষণ করেন। বিদ্যাসাগরের লেখার জবাবে যেসব বিরুদ্ধ যুক্তি তখন উঠেছিল, সেসবের জবাব দিয়ে বিদ্যাসাগর ওই বছরই দ্বিতীয়বার প্রকাশ করলেন ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিৎ কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’। এই পুস্তিকার সমর্থনেও ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় পরপর কয়েকটি লেখা প্রকাশ করেন অক্ষয়কুমার। বিধবাবিবাহ আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে সে লেখাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

মাত্র ত্রিশ বছরের আয়ুষ্কালে অসামান্য কর্মযজ্ঞের স্বাক্ষর রেখে গেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। বয়সে দশ বছরের ছোট হলেও তাঁর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের অন্তরঙ্গ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। বিধবাবিবাহ আন্দোলনসহ নানাবিধ সামাজিক আন্দোলনে তিনি বিদ্যাসাগরের সহযোগী ছিলেন। কালীপ্রসন্ন প্রতিষ্ঠিত ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ ও ‘বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা’ তৎকালীন বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বিধবাবিবাহের সমর্থনে স্বাক্ষর সংগ্রহে এই পত্রিকা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল। বিধবাবিবাহ সংঘটিত করার জন্য কালীপ্রসন্ন বড় অঙ্কের আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বহুবিবাহ রোধ করতেও বিদ্যাসাগরের সংগ্রামে সহযোদ্ধা ছিলেন তিনি।

বিদ্যাসাগরের অন্যতম সহযোগী প্যারীচরণ সরকার ছিলেন মুক্তচিন্তার অধিকারী ও বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি। ‘ফার্স্ট বুক’ নামক বিখ্যাত ইংরেজি শিশুপাঠ্যের রচয়িতা। বিধবাবিবাহ প্রবর্তন, বহুবিবাহ রোধ, নারীশিক্ষা বিস্তারসহ প্রতিটি কাজে বিদ্যাসাগরের সহচর ছিলেন তিনি। বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা ছাড়াও অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছেন তিনি বিদ্যাসাগরের উদ্যোগকে সাফল্যমণ্ডিত করতে। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তিনি ইংরেজিতে ও বিদ্যাসাগর বাংলায় বিজ্ঞানসম্মত শিশুপাঠ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করবেন।

মদনমোহন তর্কালঙ্কার

বাংলা শিশুপাঠ্য গ্রন্থের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় সৃষ্টি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’। বিধবাবিবাহ আন্দোলনে বিদ্যাসাগরের এই অন্যতম সহযোদ্ধা ছিলেন প্রতিভাবান সাহিত্যিক, সমাজসংস্কারক ও নারীশিক্ষার প্রসারে নিবেদিতপ্রাণ। সংস্কৃত কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে ১৮২৯ সালে তাঁদের পরিচয়। দুজনেরই ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনে সংস্কৃত কলেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সংস্কৃত কলেজ ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘বিদ্যাসাগর’ ও মদনমোহন চট্টোপাধ্যায়কে ‘তর্কালঙ্কার’ উপাধি দেয়, পরবর্তী সময়ে যা হয়ে ওঠে তাঁদের মুখ্য পরিচয়। একের পর এক সরকারি চাকরি গ্রহণ করে ব্যক্তিজীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন মদনমোহন। বিদ্যাসাগরও এ ক্ষেত্রে তাঁকে সাহায্য করেন। তাঁরা দুজনে মিলে সংস্কৃত প্রেস স্থাপন করেন। এই প্রেসের হিসাবসংক্রান্ত বিষয়, প্রকাশিত গ্রন্থস্বত্ব ও পারিবারিক কারণে একসময় বিদ্যাসাগরের সঙ্গে মদনমোহনের মনোমালিন্য তৈরি হয়। কিন্তু কেউই অন্যের প্রতি কখনো শ্রদ্ধা হারাননি। মৃত্যুশয্যায় অসহায় স্ত্রী-পুত্রকে মদনমোহন বলেছিলেন, ‘প্রাণসম ঈশ্বর তোমায় সেই নিরাশ্রয় অবস্থায় আশ্রয় দিবে। তাঁহার জীবদ্দশায় তুমি ও আমার প্রাণসমা কন্যাগণ কোন কষ্ট পাইবে না।’ তাঁর এই আস্থার প্রতিদান বিদ্যাসাগর দিয়েছিলেন। মদনমোহনের স্ত্রী-কন্যা, মা, বোন সবাই বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে আমৃত্যু সাহায্য পেয়েছিলেন।

অত্যন্ত প্রভাবশালী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের বাড়িতে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। পাঁচ ঘণ্টার সেই সাক্ষাতে তিনিই ছিলেন বক্তা, বিদ্যাসাগর মূলত শ্রোতা। ভক্তিরসে নিমজ্জমান ভাববাদী রামকৃষ্ণ ধোঁয়াশাপূর্ণ কথা বলেছেন একের পর এক। যুক্তিবাদী বিদ্যাসাগর কোনো বিরক্তি প্রকাশ করেননি। রামকৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর কথা বিদ্যাসাগরের মনে কোনো দাগ কাটেনি। তিনি ঈশ্বর বা ধর্মে বিশ্বাসী হবেন না। শিষ্য মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে তিনি বলেছিলেন ‘বিদ্যাসাগরের পাণ্ডিত্য আছে, দয়া আছে, কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি নেই।’

উনিশ শতকীয় নবজাগরণের অন্যতম স্তম্ভ ইয়ংবেঙ্গল। ধূমকেতুর মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী শিক্ষক ডিরোজিও একদল যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক ছাত্র তৈরি করেছিলেন যারা প্রচলিত বিশ্বাস ও সংস্কারকে টলিয়ে দেওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। ‘ইয়ংবেঙ্গল’ নামে পরিচিত এই যুবকেরা ছিলেন বিদ্যাসাগরের অন্যতম ভরসাস্থল। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ সিকদার, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, হরচন্দ্র ঘোষ, শিবচন্দ্র দেব, রামতনু লাহিড়ীর মতো ইয়ংবেঙ্গলরা বিধবাবিবাহ আন্দোলন ও স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। উগ্র পাশ্চাত্য আধুনিকতার কারণে সমাজ তাঁদের গ্রহণ করতে চায়নি। ধনী সমাজপতিদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া প্রাচীন পণ্ডিত সমাজের মোকাবিলা করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বিদ্যাসাগরের মতো বটবৃক্ষতুল্য ব্যক্তিত্বের আশ্রয়ে ইয়ংবেঙ্গল জ্বলে উঠেছিল। রাজা জমিদারদের কাছে, সরকারি প্রশাসনের কাছে বিদ্যাসাগর ছিলেন সমীহজাগানিয়া ব্যক্তিত্ব। অকাট্য যুক্তি ও শাস্ত্রীয় পাণ্ডিত্য দিয়ে তিনি নির্বাক করে দিয়েছিলেন গোঁড়া ও যুক্তিবিমুখ পণ্ডিতদের। ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। এই বিয়ে আয়োজনে ইয়ংবেঙ্গলরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।

মাইকেল মধুসূধন দত্ত

বাংলার নবজাগরণের প্রত্যক্ষ ফসল হিসেবে গদ্যে যে ভূমিকা পালন করেছেন বিদ্যাসাগর পদ্যে সেই ভূমিকা পালন করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মাইকেলের প্রায় অর্ধশতাব্দীর জীবনে বিদ্যাসাগরের চেয়ে বড় কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন না।

১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘পদ্মাবতী’ নাটক ও ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য। দুটিতেই অমিত্রাক্ষর ছন্দের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ঘটান মাইকেল। শুরুতে বিদ্যাসাগর অমিত্রাক্ষর ছন্দকে পছন্দ করেননি। পরে তিনি মত পরিবর্তন করেন এবং প্রশংসা করেন। এতে প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত হয়ে রাজনারায়ণ বসুকে চিঠি লেখেন মাইকেল। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রকাশিত হওয়ার পর খ্যাতির চূড়ায় আরোহণ করলেন মাইকেল। কলকাতায় স্ত্রী-সন্তানকে রেখে বিলেত যাত্রা করলেন। এরপর তাঁর গন্তব্য ভার্সাই। কপর্দকশূন্য স্ত্রী-সন্তান ভার্সাইতে গেলেন। নিদারুণ অনটন, অসম্মান, পাওনাদারের তাগাদা আর জেলে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন মাইকেল।

বিদ্যাসাগরকে চিঠি লিখে জানানোমাত্র তিনি প্রয়োজনীয় অর্থ পাঠিয়ে দিলেন। বহুবার তাঁকে আর্থিক দুর্দশা থেকে রক্ষা করেছেন বিদ্যাসাগর। পাঁচ বছর পর বিলেত থেকে কলকাতায় ফিরে মাইকেল আইন ব্যবসা শুরু করলেন বিদ্যাসাগরের সাহায্যে। প্রচুর উপার্জন করলেন। কিন্তু অমিতব্যয়ী ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনের কারণে নিঃস্ব হয়ে পড়লেন। হতাশ হয়ে বিদ্যাসাগর একটি চিঠিতে তাঁকে লিখলেন, ‘তোমার আর ভরসা নাই। আমি কি আর কেহই তোমাকে রক্ষা করিতে পারিবে না। তালি দিয়া আর চলিবে না।’ শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যের অসামান্য প্রতিভা মাইকেলের পাশে দাঁড়িয়েছেন বারবার। বিদ্যাসাগরের চরিত্র সম্পর্কে মাইকেলের মূল্যায়ন অবিস্মরণীয়, ‘প্রাচীন ঋষিদের মতো প্রতিভা ও জ্ঞান, ইংরেজদের মতো প্রাণশক্তি আর বাঙালি মায়ের হৃদয়।’ মাইকেলই তাঁকে প্রথম বলেছিলেন ‘করুণাসাগর’।

যাঁরা মাইকেলের জীবদ্দশায় কোনো সাহায্য করেননি তাঁরা তাঁর মৃত্যুর পর দরদি হয়ে উঠলেন। মাইকেলের মৃত্যুর পর সিটি কলেজের অধ্যক্ষের উদ্যোগে তাঁর অস্থি ও পাঁজর সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের কাছে সাহায্য চাইতে গেলে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া যাহার জান রাখিতে পারি নাই, তাহার হাড় রাখিবার জন্য আমি ব্যস্ত নই। তোমাদের নূতন উৎসাহ ও আগ্রহ আছে, তোমরা কর।’ অতুলনীয় সুহৃদ বিদ্যাসাগরকে ঘিরেই রচিত হয়েছিল মাইকেলের অমর পঙ্‌ক্তি, ‘বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।/ করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,/ দীন যে, দীনের বন্ধু! উজ্জ্বল জগতে/ হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।’

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন। এখানে যেন তাঁহার স্বজাতি সোদর কেহ ছিল না। এ দেশে তিনি তাঁহার সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন।’ সমকালীন বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের অম্ল-মধুর সম্পর্কের রসায়ন বিশ্লেষণ করলে রবীন্দ্রনাথের কথার সারবত্তা প্রমাণিত হয়। ‘অজেয় পৌরুষ’ ও ‘অক্ষয় মনুষ্যত্ব’ নিয়ে বিদ্যাসাগর সমকালীনদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]