সমুদ্র দুকূল ছোঁয়...

অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী
অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী

‘তুই কি আমায় স্বপ্নে দেখিস? আজকাল আমার ঘুম হয় না কেন রাতে?’
‘ওমা, এটা আবার কেমন কথা, তোর ঘুম হয় না... তার সঙ্গে আমার স্বপ্ন দেখার কী সম্পর্ক?’
‘আছে, আছে। সম্পর্ক তো একটা আছেই। কারও ঘুম না হলে বুঝতে হবে, সে অন্য কারও স্বপ্নে তখন জেগে আছে। আমার কথা না, এটা ফরাসি প্রবাদ...।’
‘ফরাসিরা ও রকমই, সবকিছুতেই একটা কার্যকারণ খুঁজে বের করবে, যার বেশির ভাগেরই কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।’
‘তার মানে, আমাকে কখনোই স্বপ্নে দেখিসনি তুই?’
‘না, তোকে দেখব কেন? স্বপ্নই যদি দেখতে হয়, ব্র্যাড পিট বা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওকে দেখব, যাঁদের বলা হয় স্বপ্নের নায়ক।’
‘হুম্।’—যুক্তিটা মেনে নিয়েছিল সজল। তারপর খুব বোকা বোকা চেহারা বানিয়ে বিষণ্ন কণ্ঠে বলেছিল, ‘তাহলে আমার নির্ঘুম রাত্রিগুলোর জন্য কোনো সান্ত্বনাই থাকল না আর।’
পিঠে একটা মৃদু কিল বসিয়ে দীপা বলেছিল, ‘পাগল।’
আজ খুব সজলকে মনে পড়ছে। বিশেষ করে সৈকতের বালুতে আঙুল ডুবিয়ে লিখে রাখা লাইন দুটি চোখে পড়ার পর সে প্রায় নিশ্চিত, সে এখানেই কোথাও আছে। হয়তো সমুদ্রসৈকতে, ঝিনুক বিকিকিনির দোকানগুলোতে, বার্মিজ মার্কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিংবা কোনো এক হোটেলের বারান্দায় সুদূরের দিকে তাকিয়ে আছে একা। একা? কেন? সজল একা এসেছে, এ রকম ভাবল কেন দীপা? মাঝখানে পেরিয়ে গেল এই এতগুলো বছর। এত দিনে নিশ্চয়ই থিতু হয়েছে, বিয়ে-সংসার...।
দুদিন আগে কক্সবাজার এসেছে দীপা আর আদনান। এবার দেশে ফেরার আগে থেকেই কক্সবাজারে দুটো দিন কাটানোর পরিকল্পনা করে রেখেছিল। আদনান একটু খোঁচা মেরে বলেছিল, ‘দেশি আবেগ তোমার আর গেল না। সারা পৃথিবীর কত সমুদ্র-শহরে ঘুরে বেড়ালে, তবু ওই লোকে গিজগিজ নোংরা বিচটার কথা ভুলতে পারো না।’
না, ভুলতে পারে না সে। মায়ামি, ফুকেট, গোয়া সৈকত অনেক গোছানো, অনেক টুরিস্ট-ফ্রেন্ডলি। সে তুলনায় এই লোকে-কিলবিল সৈকতে সব বিড়ম্বনাই আছে। অনভ্যস্ত চোখে বিসদৃশ মনে হবে সবকিছুই। তবু এই সৈকতটার মতো আপন মনে হয় না আর কোনোটাই। আদনানের কথাই হয়তো ঠিক, এটা দেশি আবেগই।
আসলে এবার কক্সবাজারে এসে নতুন একটা রিসোর্টে উঠেই মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল। রিসোর্টটির স্থাপত্য-নকশা প্রথম দৃষ্টিতেই ভরিয়ে দিয়েছিল মন। অবিকল বড় একটি ঝিনুকের আদলে তৈরি দোতলা রিসোর্টটি। আরও মুগ্ধকর এর ইন্টেরিয়র ডিজাইন। দেওয়ালের রং থেকে কক্ষের সজ্জা—সবকিছুতেই সমুদ্র-আবহ। এমন যে সারা দুনিয়া চষে বেড়ানো খুঁতখুঁতে স্বভাবের আদনান, তারও মুগ্ধতা-বিস্ময় তখন একাকার, বলেছিল, ‘বাহ্, বাঙালির রুচি তো অনেক দূর এগোল দেখছি!’
রিসোর্টের বারান্দায় দাঁড়ালে, এমনকি কামরার ভেতরও ঢেউয়ের গর্জন শোনা যায়। কিন্তু সমুদ্র দেখা যায় না। তাই সৈকতে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল দীপা। আদনানের আবার ছুটোছুটিতে অনীহা। সে হলিডে কাটাতে এসেছে। বিছানায় শুয়ে-বসে-আলস্যে, বারান্দায় চেয়ার টেনে কফিতে চুমুক দিয়ে সময় পার করতে চায় সে। কিন্তু দীপার জোরাজুরিতে সৈকতে আসতে হয়েছে। এসেছে বটে, বড়সড় একটা বিচ-ছাতার নিচে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে পেপারব্যাকে মুখ ডুবিয়ে আছে সে। তাতে আপত্তি নেই দীপার। খোলা হাওয়ার উল্টো দিকে দৌড়ে একাই সে ছুটে গেছে ঢেউয়ের কাছে। ঢেউয়ের ধাক্কায় তাল হারিয়ে চিৎপাত হয়ে পড়েছে হঠাৎ। নাকে-মুখে লোনা পানি ঢুকে গেলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে আবার। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়েছে। মুহূর্তের এইটুকু ভয় কেটে গেলে খুশি-আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। তখন কিছুতেই নিজের বয়সটা মনে রাখতে পারে না আর। অনেকটা সময় নিয়ে ইচ্ছেমতো লাফালাফি-দাপাদাপি করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসেছে ডাঙায়। আদনানের চেয়ারের পাশে রাখা তোয়ালেটা জড়িয়ে নেয় গায়ে।
আদনান বই থেকে মুখ তুলে বলল, ‘যাবে?’
‘না, আর একটু থাকি..., ডু ইউ ফিল বোর?’
‘ওহ নো, আই অ্যাম ওকে।’—আবার বইতে মুখ ডোবাল আদনান।
ফিরে গেলেই ভালো হতো। কিন্তু নিয়তি বলে একটা কথা আছে না, সেই নিয়তিই হয়তো যেতে দিল না দীপাকে। যখন সে ভেজা গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে খালি পায়ে হাঁটছিল সমুদ্রের তীর ঘেঁষে, তখন অলক্ষ্যে মুচকি হাসছিল নিয়তি। কিছুদূর গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল দীপা।
তীরে যেখানে ঢেউ এসে ভেঙে পড়ছে, সেখান থেকে একটু তফাতে সারি সারি ঝাউগাছের সমান্তরালে হাঁটছিল সে। কেননা, রোদটা এর মধ্যেই বেশ তেঁতে উঠেছে। রোদ-ছায়ার মাখামাখি জায়গাটাতে একটু ভেজা ভেজা বালুতে কে যেন আঙুল ডুবিয়ে কেটে কেটে লিখে রেখেছে, ‘সমুদ্র দুকূল ছোঁয়, ভালোবাসা ছোঁয় না আমাকে।’
আপাদমস্তক কেঁপে উঠেছিল দীপা। তার মানে সজল এখন এই শহরেই আছে? এমনকি এই সৈকতেই আছে কোথাও...? কয়েক মুহূর্ত আগেও ঠিক এখানেই, এই ঝাউয়ের সারির ছায়াতেই হাঁটছিল একা একা?
ফেরার পথে একটি কথাও বলে না দীপা। হঠাৎ করেই তার সব উচ্ছ্বাস কে যেন নিভিয়ে দিয়েছে এক ফুঁয়ে। আসলে মাস কয়েক আগে টরন্টোর নিজের বাড়িতে একদিন ফেসবুক চালাতে বসে কৌতূহলবশত সজল সরোয়ারের নামটা সার্চ দিয়েছিল দীপা। কাভার ছবিজুড়ে ছিল একটি সফেন সমুদ্র। ছবির ওপর লেখা ছিল এ দুটি লাইন, ‘সমুদ্র দুকূল ছোঁয়, ভালোবাসা ছোঁয় না আমাকে...।’ কোনো প্রোফাইল ছবি ছিল না। সবাই পড়তে পারে—এ রকম শুধু একটা স্ট্যাটাসই ছিল। সেখানে সজল লিখেছে, ‘গতকাল এটারনাল সানশাইন অব দ্য স্পটলেস মাইন্ড ছবিটা দেখলাম। ছবির নায়ক “লাকুনা” নামের একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে অস্ত্রোপচার করে মুছে ফেলেছে তার অতীতের ভালোবাসার সব স্মৃতি। জানি, এ রকম আসলে করা যায় না। এটা শুধু সায়েন্স ফিকশনেই সম্ভব। কিন্তু সত্যি যদি এ রকম কোনো একটা ব্যবস্থা থাকত। যদি সত্যি মন থেকে মুছে ফেলতে পারতাম আমার সব অতীত!’
চারুকলার ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র সজলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল যখন, সে মেডিকেল কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়ে। সেই পরিচয় কখন বন্ধুত্ব পর্যন্ত গড়িয়েছিল, আপনি থেকে তুইতে নেমে গিয়েছিল সম্বোধন, সে কথা আর আলাদা করে মনেই পড়ে না। শুধু মনে পড়ে, সজল ন্যাশনালে পুরস্কার পেয়েছিল ‘তুমি’ নামের একটি ছবি এঁকে। সেই ‘তুমি’তে অনেক আড়াল সত্ত্বেও আলাদা হয়ে উঠেছিল দীপার প্রতিকৃতিটাই।
‘তুই আমার ছবি আঁকলি কেন?’—কপট রাগ দেখিয়ে বলেছিল দীপা।
‘তোর ছবি অঁকিনি তো, আমার ভালোবাসা এঁকেছি।’—কী প্রেমমগ্ন স্বরে এ কথা উচ্চারণ করেছিল সজল। জীবনে অনেক কিছুই পেয়েছে দীপা, কিন্তু এ রকম গভীর আবেগের অনুভব তো আর পেল না!
কোনো কমিটমেন্ট ছিল না সম্পর্কের মধ্যে। কিন্তু দীপা বুঝতে পারত, সজল ভালোবেসেছে তাকে। দীপাও কি বাসেনি? আজ এ প্রশ্ন নিজের ভেতর থেকেই যেন হাহাকারের মতো উঠে আসে। বেসেছিল। কিন্তু চারুকলার সেই সৃষ্টিপাগল ছেলেটাকে সংসারের রূঢ় বাস্তবতার মধ্যে টেনে আনার ভরসা পায়নি। এ রকম ভাবনার মধ্যে স্বার্থপরতাও কি ছিল না? ছিল, নিশ্চয়ই ছিল। হয়তো পরিবারের অমত ছিল মেডিকেল কলেজের মেধাবী ছাত্রীটির সঙ্গে এ রকম বাউন্ডুলে স্বভাবের একটি ছেলের জীবন জুড়ে দিতে। কিন্তু নিজে কি সে বেঁকে বসতে পারত না? কেন বিদেশি জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিতে পারেনি? নির্ভরতা... একজন নির্ভরযোগ্য পুরুষকে জীবনের সঙ্গী হিসেবে চেয়েছিল বলে?

দুই.
সন্ধ্যার আগে একাই বেরিয়েছে দীপা। ঝিনুকের দোকান, বার্মিজ মার্কেটগুলোয় ঘুরে ঘুরে এটা-ওটা কিনে ভর্তি করেছে দুহাত। কিন্তু তার দৃষ্টিতে জেগে আছে অনুসন্ধান, যদি কোথাও দেখা হয়ে যায় লোকটার সঙ্গে। উৎকর্ণ হয়ে থেকেছে হঠাৎ একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে বলে। পায় না, কোথাও দেখা মেলে না তার।
সন্ধ্যাটা বিষণ্ন কেটে যায়। রাতে বিছানায় আদনান তার দেহ-তল্লাশিতে নেমে পড়লে, সাড়া দিতে পারে না।
অনিচ্ছুক এক দেহমিলন শেষে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে চিত হয়ে শুয়ে থাকে দীপা। সবকিছু বিস্বাদ লাগে। পাশে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে আদনান। এখন তার নাক ডাকার শব্দ একধরনের বিবমিষা জাগিয়ে তোলে শরীর-মনে।
ঠিক এ সময়টাতেই দূর থেকে মিষ্টি একটা সুর শুনতে পায়। মুখে শিস দিয়ে গানের সুর বাজাচ্ছে কেউ। চমকে ওঠে। এই শিস তো তার চেনা! বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। ঘুম-ফ্রক পরেই বেরিয়ে আসে বাইরে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ঠিক কোন দিক থেকে ভেসে আসছে সুরটি। হোটেলের গাড়ি-রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধ আলো। কিছুদূরে একটা ঝোপের মতো, ওপাশে ছোট্ট একটা পুকুর। ওখানে দাঁড়িয়ে কি কেউ বাজাচ্ছে শিস? সেই অজ্ঞাত-অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুটা সময় কেটে যায় দীপার।
সুর থেমে যায়। আরও কিছুটা সময় কাটে তার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। চারপাশে তখন অখণ্ড নীরবতা। সত্যি কি সে শুনেছিল কোনো সুর? সবটাই মনের ভুল নয়তো? কেমন এক ধন্দে পড়ে যায় সে। কক্ষে ফিরে সোজা বাথরুমে ঢোকে। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকে। অবিরল জলধারায় যেন ধুয়ে ফেলতে চায় সব ক্লেদ ও ক্লান্তি।
দীর্ঘ স্নানে শরীর জুড়ানোর পর ঘুমে জড়িয়ে আসে দুই চোখ। কিন্তু বিছানায় শরীর এলিয়ে দেওয়ার পর ঘুম উধাও। সারা রাত এপাশ-ওপাশ করে। সেই অদ্ভুত কথাটা মনে পড়ে যায়, সজল বলেছিল, কারও ঘুম না হওয়ার মানে নাকি অন্য কারও স্বপ্নে জেগে আছে সে। জানে, এ কথার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কিন্তু আজ কেন যে বড় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, কারও স্বপ্নের মধ্যে সে জেগে আছে!

তিন.
সকালে ব্রেকফাস্টের পর তাগাদা দেয় আদনান, ‘জলদি সব গোছগাছ করে নাও, দীপু...।’
সব আর কী, দুজনের দুটো ব্যাগে কাপড়চোপড় ঝটপট গুছিয়ে নেয় সে।
রিসোর্টের বিলপত্র মিটিয়ে যখন গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসেছে আদনান, তখন কী ভেবে আবার রিসেপশনে ফিরে আসে দীপা।
রিসেপশনের মেয়েটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বলল, ‘কিছু মনে করবেন না, রাতে হোটেলের বাউন্ডারিতে বাইরের লোক তো ঢুকতে পারে না, তাই না?’
‘না ম্যাডাম, কেন বলুন তো?’
‘কাল রাতে পুকুরঘাটের দিকটায় দাঁড়িয়ে কেউ শিস বাজাচ্ছিল...।’
এবার হাসে রিসেপশনিস্ট মেয়েটি, ‘সজল স্যার... মানে আমাদের এমডি স্যারের বন্ধু। উনি রাতে প্রায়ই ওই দিকটায় গিয়ে বসেন। আপন মনে শিস বাজান, পাগল টাইপের মানুষ...।’
‘পাগল’ শব্দটা শুনতে ভালো লাগে না দীপার। সে একটু কঠিন গলায় উল্টো প্রশ্ন করে, ‘পাগল?’
একটু থতমত খাওয়া গলায় মেয়েটি বলল, ‘জি না, আর্টিস্ট মানুষ। আমাদের এই রিসোর্টের বিল্ডিংয়ের ডিজাইন, ইনটেরিয়র—সবই তো ওনার করা।’
‘তাই? উনি কি আছেন?’
‘ছিলেন, ৩০২ নম্বর রুমে ছিলেন। আজ ভোরে চলে গেলেন।’
৩০২! ঠিক তাদের পাশের রুমটাতেই ছিল সজল! এত কাছে, তবু দেখা হলো না একবার?
গাড়িতে বসে বিরক্ত আদনান বারবার হর্ন বাজাচ্ছে। দীপা ছুটে গিয়ে উঠে বসে তার পাশে।
গাড়ি ছোটে। দুপাশের পাহাড়, বৃক্ষের সবুজ ছাড়িয়ে ছুটে চলে। এসব দৃশ্য আর চোখেই পড়ে না। এত কাছে ছিল, তবু কেন একবার দেখা হলো না—এই প্রশ্নে হু হু করে ওঠে মন।