সামাজিক মাধ্যমে লাখো অনুসারী, তবু বই বিক্রি হয় না কেন

সেলিব্রিটিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা পোস্ট করেন বা লেখেন, তার সঙ্গে বইয়ের বিষয়বস্তুর মিল থাকে না। আবার তাঁরা বইয়ের মধ্যে নতুন কিছুও দিতে পারেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা বলেন, বইয়েও তা–ই বলেন। কিন্তু যে অনুসারী একটি বিষয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পড়ে ফেলেছেন, সেই একই বিষয়ে তিনি আবার বই কিনে কেন পড়বেন?

বাংলাদেশি এক উঠতি তরুণ লেখকের ভীষণ মন খারাপ। তিনি বড় আক্ষেপ নিয়ে নিজের ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত বইটি বিক্রি হয়েছে মাত্র ২৭ কপি!

আক্ষেপটা ২৭ সংখ্যার জন্য নয়, আক্ষেপ বিশ্বাসভঙ্গের কারণে। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, তাঁর অন্তত লাখখানেক বই বিক্রি হবেই।

কেন তিনি এমন সরল বিশ্বাস মনে পুষে রেখেছিলেন?

না, তাঁর এ বিশ্বাসকে আপাত সরল মনে হলেও তা আদৌও সরল নয়, বরং যুক্তিসংগত। কারণ, তরুণ এই লেখকের (সংগত কারণে নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না) ফেসবুকে অনুসারী রয়েছে দেড় লাখের কাছাকাছি। এই বিপুলসংখ্যক অনুসারীর মাত্র ৬ শতাংশও যদি তাঁর বই কিনতেন, তাহলেই তো তাঁর বই ১০ হাজারের বেশি কপি বিক্রি হওয়ার কথা। সেখানে মাত্র ২৭!

আপনার এমন দেড় লাখ অনুসারী থাকলে আপনার বুকও ভেঙে খান খান হয়ে যেত। তবে আপনি যদি দিনদুনিয়ার একটু খবর রাখেন, তাহলে কিছুটা সান্ত্বনা পাবেন। এতটা হতাশা আপনাকে গ্রাস করবে না।

বাইরের দুনিয়ায়ও এই অনুসারী সংস্কৃতির সঙ্গে বই বিক্রির সম্পর্ক খানিকটা হতাশাজনক। বিলি আইলিস একজন প্রখ্যাত পপ তারকা। ইনস্টাগ্রামে তাঁর অনুসারী ৯ কোটি ৭০ লাখ। টুইটারে অনুসারী ৬০ লাখ। এই একসমুদ্র অনুসারীর ওপর ভরসা করে এই মার্কিন তারকা একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। বইটি কত কপি বিক্রি হয়েছে জানেন? ৬৪ হাজার কপি!

মার্কিন প্রতিষ্ঠান এনপিডি বুকস্ক্যান বলছে, সংখ্যাটা একেবারে হতাশাজনক না হলেও লেখক ও প্রকাশকের জন্য হতাশার। কারণ, লেখকের নাম বিলি আইলিস। শুধু এ নামের জন্যই তো কয়েক মিলিয়ন কপি ফুরিয়ে যাওয়ার কথা। প্রকাশক জানিয়েছেন, গত বছরের মে মাসে প্রকাশিত বইটি বাজারে আনতে খরচ হয়েছে ১০ লাখ ডলার। এখন খরচের টাকাই উঠছে না। প্রকাশক মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন।

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বার্নস অ্যান্ড নোবেলের পরিচালক শ্যানন ডেভিটো বলেছেন, কোনো বই যে পাঠক গ্রহণ করবেন, তা আগে থেকে অনুমান করা কঠিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাখো অনুসারী মানেই লাখো বই বিক্রি—এ ধারণা এখন ভুল প্রমাণিত হচ্ছে।

এই তো বছর কয়েক আগে প্রকাশকেরা লেখকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ঠিকুজি বিশ্লেষণ করে বই প্রকাশ করতে শুরু করেন। নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদক এলিজাবেথ এ হ্যারিস বলেছেন, ‘এখনো প্রকাশকেরা বই প্রকাশের আগে দেখেন, ওই লেখক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব কি না, নিয়মিত টেলিভিশন টক শোতে যান কি না, রেডিও অনুষ্ঠানে যান কি না, পত্রপত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন কি না, ফেসবুক-ইউটিউব থেকে মাঝেমধ্যে লাইভ করেন কি না, তাঁর পোস্ট শেয়ার হয় কি না ইত্যাদি। প্রকাশকদের ধারণা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাঁর অনুসারী যত বেশি, তাঁর বই তত বেশি বিক্রি হবে। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, এ ধারণা তত ফিকে হয়ে আসছে।’

সেন্ট মার্টিন প্রেসের নির্বাহী সম্পাদক মার্ক রেসনিক বলেছেন, ‘আমরা এক নতুন সময়ে প্রবেশ করেছি। আমাদের অনেক কিছু নতুন করে শিখতে হবে। একটি ফেসবুক পোস্ট কিংবা একটি টুইটের লাইক, কমেন্ট, শেয়ার, লাভ ইত্যাদি রিঅ্যাকশন দেখেই বলা মুশকিল, তিনি কতটা জনপ্রিয়। তার চেয়েও বলা কঠিন, এই ভার্চ্যুয়াল জনপ্রিয়তার নিরিখে তাঁর বই কত কপি বিক্রি হবে।’

জাস্টিন টিম্বারলেক অত্যন্ত জনপ্রিয় এক মার্কিন গায়ক। ইনস্টাগ্রামে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ৫ কোটি ৩০ লাখ। ২০১৮ সালে হিন্ডসাইট নামের তিনি একটি বই লিখেছিলেন। বইটি প্রকাশ করতে খরচ হয়েছে ১০ লাখ ডলার। কিন্তু বই বিক্রি? মোটেও আশানুরূপ নয়। বুকস্ক্যান বলছে, গত তিন বছরে বইটি বিক্রি হয়েছে এক লাখ কপি। প্রকাশকের আক্ষেপ, ‘পাঁচ কোটি অনুসারীর বই বিক্রি হবে কেন মাত্র এক লাখ?’

বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় গায়ক তাহসান খান। ফেসবুকে তাঁর অনুসারী ৯৭ লাখের বেশি। গত বছর বইমেলায় এই জনপ্রিয় সংগীত তারকাও একটি বই প্রকাশ করেছেন। তাঁর জনপ্রিয়তার নিরিখে সত্যি কি আশানুরূপ বই বিক্রি হয়েছে নাকি তাঁর প্রকাশকও টিম্বারলেকের প্রকাশকের মতো আক্ষেপ করছেন, এটি অবশ্য জানার উপায় নেই। কারণ, আমাদের দেশের প্রকাশকেরা বই বিক্রির সঠিক তথ্য জানাতে মোটেও আগ্রহী নন।

আবার যাঁরা পপ তারকা নন, রুপালি জগতের সঙ্গে যুক্ত নন, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক অনুসারী আছে, তাঁদের অবস্থা কী? ইলহান ওমর তেমন একজন ব্যক্তি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার একজন ডেমোক্র্যাট রাজনীতিক। টুইটারে তাঁর অনুসারী ৩০ লাখ। ইনস্টাগ্রামে ১৩ লাখ। গত বছরের মে মাসে তাঁর একটি বই প্রকাশিত হয় দিস ইস হোয়াট আমেরিকা লুকস লাইক: মাই জার্নি ফ্রম রিফিউজি টু কংগ্রেস উইমেন নামে। বইটি গত এক বছরে হার্ড কপি, অডিও বুক এবং ই-বুক মিলিয়ে বিক্রি হয়েছে মাত্র ২৬ হাজার কপি।

একজন মার্কিন সাংবাদিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব পিয়ার্স মরগান। টুইটারে তাঁর অনুসারী ৮০ লাখ ও ইনস্টাগ্রামে ১৮ লাখ। গত বছর প্রকাশিত তাঁর বই অ্যাওক আপ যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৬৫০ কপি।

এ রকম কেন ঘটে, বোঝা মুশকিল। নিউইয়র্ক টাইমস-এর বই সমালোচক ও প্রতিবেদক এলিজাবেথ এ হ্যারিস বলেন, ‘এর কারণ খুঁজে বের করার জন্য গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। তবে প্রকাশক ও বই বিপণনকারীদের ধারণা, সেলিব্রিটিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা পোস্ট করেন বা লেখেন, তার সঙ্গে বইয়ের বিষয়বস্তুর মিল থাকে না। আবার তাঁরা বইয়ের মধ্যে নতুন কিছুও দিতে পারেন না। সামাজিক মাধ্যমে যা বলেন, বইয়েও তা–ই বলেন। কিন্তু যে অনুসারী একটি বিষয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পড়ে ফেলেছেন, সেই একই বিষয়ে তিনি আবার বই কিনে কেন পড়বেন? হয় তিনি অনুসারীদের উদ্দেশে সঠিক বইটি লিখতে পারছেন না, অথবা অনুসারীরা তাঁর বইয়ের লেখার সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করতে পারছেন না।’

এসব সমস্যার কারণে প্রকাশকেরা এখন বই প্রকাশের আগেই লেখকদের সঙ্গে এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হন যে লেখক এ বই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী কী কর্মসূচি গ্রহণ করবেন। র‌্যান্ডম হাউস চিলড্রেন বুকসের প্রেসিডেন্ট ও প্রকাশক বারবারা মার্কাস বলেন, ‘আমরা এখন বই প্রকাশের চুক্তি করার আগে লেখককে জিজ্ঞাসা করি, আপনি বইটির খবর আপনার অনুসারীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য কী কী কাজ করবেন? এই বইকে ঘিরে আপনার পরিকল্পনা কী?’

এ ছাড়া সব অনুসারীই অনুসারী নয়। এটিও একটি সমস্যা। অনুসারীর সংখ্যা দেখে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। কারণ, অনেক ভুয়া অনুসারী থাকে। এ বিষয়ে ব্রডসাইড বুকসের সম্পাদকীয় বিভাগের পরিচালক এরিক নেলসনের কথা স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘আমি এমন কয়েকজনকে চিনি, যাঁরা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় নন, প্রায় আট বছর আগে এ মাধ্যমকে “বিদায়” বলেছেন, কিন্তু তাঁদের অ্যাকাউন্টে এখনো লাখ লাখ অনুসারী রয়ে গেছে। এটা খুবই বিস্ময়কর যে এত মানুষ কেন এখনো তাঁদের অনুসরণ করছে?’

এখন এই অনুসারীর সংখ্যা দেখে কোনো প্রকাশক যদি ওই ব্যক্তির বই প্রকাশ করেন, তাহলে তিনি নিশ্চিত বিপদের মধ্যে পড়বেন এবং সেটাই স্বাভাবিক।

ইদানীং নতুন এক ট্রেন্ড শুরু হয়েছে, যার নাম টিকটক। ‍হু হু করে অনুসারী বাড়ছে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কিন্তু এই অনুসারী দেখে বই প্রকাশের মতো ঝুঁকি নিতে সতর্ক করেছেন হ্যাচেট বুকসের প্রকাশক ম্যারি অ্যান নেপলস। তাঁর কথা, ‘আমার কাছে একজন টিকটক সেলিব্রিটি এসেছিলেন বই প্রকাশের অনুরোধ নিয়ে। ‍টিকটকে তাঁর বিশাল অনুসারী গোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু আমি তাঁকে বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছি। একে তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনুসারীকে বিশ্বাস করা যায় না, তার ওপর তিনি টাকাও চাইছেন বেশি।’

তবে একটি-দুটি ব্যতিক্রম ঘটনাও দেখা যায়। কখনো কখনো হঠাৎ দু-একজন সেলিব্রিটির বই ভালোই বিক্রি হয়। যেমন নিকোল লিপেরা নামের একজন মনোবিজ্ঞানী আছেন। ইনস্টাগ্রামে তাঁর অনুসারী ৪৪ লাখ। তাঁর বই হাউ টু ডু ওয়ার্ক মাত্র কয়েক দিনে বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার কপি।

কাজেই অনুসারীদের একেবারেই ভূমিকা নেই, তা বলা যাচ্ছে না। তানিয়া ম্যাককিনন নামের এক মার্কিন সাহিত্য এজেন্ট বলেছেন, ‘বই বিক্রিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোনোই ভূমিকা নেই, কথাটি সঠিক নয়। অবশ্যই ভূমিকা আছে। তবে কোন সেলিব্রিটির অনুসারীরা কোন বইয়ের ক্ষেত্রে কীভাবে সাড়া দেবেন (বই কেনার ব্যাপারে), তা এখনো অজানা। এ সমস্যার সমাধানে প্রকাশকদের আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে।’

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, বুক বিজনেস ম্যাগাজিন ও সাবস্ট্যাক ডটকম