
হুমায়ূনের ভাষায় তারল্য আছে। আলবত আছে। কার ভাষায় থাকে না? বহুপ্রজ লেখকদের বেলায় ভাষার তারল্য এড়াতে পারা এক বিরল ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ শ্রেষ্ঠাংশে সেই বিরলের দিকে পড়বেন। মুশকিল হলো, ‘জটিল’ ভাষাও যে তরলের সারিতে নাম লেখাতে পারে, সে বোধ আমাদের লেখক-পাঠক মহলে বিশেষ প্রচারিত নেই। উপনিবেশ আমলের যে ভাষাদর্শন আর ভাষারূপ আজতক আমাদের সাহিত্যিক ভাষায় বিশেষ মহিমা পেয়ে আসছে, তাতে জটিলতার মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি আছে। হুমায়ূনের ভাষা কিন্তু আশ্চর্য রকমের সরল। সারল্যের কারণেই তাঁর রচনা বেশির ভাগ সময়ে বাছবিচারহীনভাবে তরলের অভিধা পেয়ে যায়। অবশ্য সত্যের খাতিরে বলা দরকার, হুমায়ূনের ভাষার সারল্য ব্যাপক প্রশংসাও পেয়েছে। খাঁটি সাহিত্যিক-শিল্পতাত্ত্বিক দিক থেকেই। কিন্তু তাঁর সারল্য যে একই সঙ্গে গভীরও, বলা ভালো, সরল বলেই গভীর, সে কথাটা বলা হয়নি। এ লেখায় আমরা সংক্ষেপে সেই সারল্য ও গভীরতার হদিস নেব।
হুমায়ূন সরল বাক্যে লিখতেন। ছোট বাক্যে লিখতেন। কাজটা সহজ নয়। বিনয় সরকার আমাদের জানিয়েছেন, ছোট-সরল বাক্য ‘খাঁটি’ বাংলার স্বভাব। উপনিবেশ আমলে সে স্বভাবের বিচ্যুতি ঘটেছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর গদ্যে ওই স্বভাবের পুনরুদ্ধার ঘটেছে বলেই তাঁর লেখা ‘খাঁটি’ বাংলার মর্যাদা পেয়েছিল। হুমায়ূন কথাসাহিত্যের ভাষায় সেই রীতিকেই সম্ভবপর করেছেন। মুশকিল হলো, আমরা যখন বর্ণনা তৈরি করি, তখন চিন্তার পরম্পরা রক্ষা করতে হয়। এমন কথা আমাদের প্রায়ই বলতে হয়, যেগুলো পরস্পর সাপেক্ষ। ইংরেজি-প্রভাবিত আমাদের প্রভাবশালী গদ্যধারায় জটিল বাক্যের ব্যাপক উপস্থিতির এটাই প্রধান কারণ। তাতে একই বাক্যে কার্যকারণটা একত্রে উপস্থাপন করা যায়। করা সহজ হয়। হুামায়ূন লিখেছেন গল্প। বর্ণনা করেছেন কাহিনি। অর্থাৎ তাঁকে ঘটনাক্রমের পরম্পরা রক্ষা করতে হয়েছে। আবার পাশাপাশি স্থান পাওয়া বাক্যগুলোর মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্কও অটুট রাখতে হয়েছে। গতির প্রসঙ্গটাও এর সঙ্গেই যুক্ত। তাহলে সরল বাক্য গড়নে বর্ণনার পারম্পর্য, যুক্তিক্রম আর গতি নিশ্চিত করাই হু্মায়ূনের কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সারল্য তার প্রথম ধাপ মাত্র।
বহু গল্প-উপন্যাসে হুমায়ূন লিখেছেন: এবার মূল গল্পটা বলি, বা এবার ওই গল্পটা বলে নিই। তাঁর ক্ষেত্রে এ ধরনের উল্লেখ কথার কথা নয়। কথাসাহিত্যে হুমায়ূন কাহিনি লিখতেন না, বলতেন। বলার ভঙ্গির মধ্যে আন্তরিকতা থাকে, সম্মোহন থাকে। বলার সময় কথক চরিত্রটি হাজির থাকে। কথার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অঙ্গভঙ্গি আর স্বরভঙ্গি সমানতালে কাজ করে যায়। তাতে অনুপস্থিত যে ব্যক্তির কথা বলা হচ্ছে, কিংবা আগে ঘটে যাওয়া যে ঘটনাটা বর্ণিত হচ্ছে, তার বাস্তবতা চোখের সামনে অনেক দূর পর্যন্ত মূর্ত হয়ে ওঠে। হুমায়ূনের গল্প বলার স্বরে এ উপাদানগুলো অনেক বেশি পরিমাণে হাজির থাকে। কিন্তু গল্পটা তো লিখেই বলা হচ্ছে। মুখে মুখে বলা হচ্ছে না। ফলে লেখার মধ্যে বলার ব্যাপারটা সম্ভব করে তোলা আসলে এক জটিল অনুবাদের কাজ। ব্যাপারটা আরেকটু বিশদ করা দরকার।
আমরা যখন কিছু পড়ি, তখন প্রথমত চোখ সক্রিয় থাকে। পরে বিষয় অনুযায়ী আমাদের কান-চোখ ও অপরাপর ইন্দ্রিয় সক্রিয় হয়। ব্যাপারগুলো হয়তো একই সঙ্গে ঘটে। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের সক্রিয়তার পরিমাণ একই থাকে না। যেখানে বলার ভঙ্গিটা প্রধান, সেখানে বেশি সক্রিয় থাকবে কান। চোখও সক্রিয় হবে। কিন্তু চোখ বর্ণিত বিষয়ের তত্ত্ব-তালাশের চেয়ে বেশি সক্রিয় হবে সামনে বসে থাকা কথকের দিকে নজর রাখার কাজে। ‘গল্প-বলিয়ে’ লেখকদের সবার ক্ষেত্রেই এ কথা সত্য। হুমায়ূনের ক্ষেত্রে আরও বেশি সত্য এ কারণে যে হুমায়ূন লিখতেন মুখের বাংলায়। ওই যে বলেছিলাম, তিনি সরল বাক্যে লিখতেন, তার সঙ্গে এখন যোগ করা দরকার, তাঁর বর্ণনা-বিবৃতি বর্ণিত চরিত্রের মুখের ভাষার মাপে গড়া। ফলে একজন ‘গল্প-বলিয়ে’ শরৎচন্দ্রের সঙ্গে ‘গল্প-বলিয়ে’ হুামায়ূনের ফারাক খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শরৎচন্দ্র গল্প বলেছেন ‘সাহিত্যিক’ ভাষায়। ফলে চরিত্রের অব্যবহিত বাস্তবতা আর লেখকের উচ্চারণের মধ্যে পার্থক্য ছিল। হুমায়ূন এ পার্থক্য ঘুচিয়ে দিয়েছেন।
উপন্যাসের ভাষার দিক থেকে এ বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হুমায়ূনের ভাষা গভীরভাবে সংলাপময়। একেবারে বাখতিনীয় অর্থেই। এখানে কেবল চরিত্রের পারস্পরিক বাতচিতের কথা বলছি না। হু্মায়ূনের নিজের বর্ণনাও সংলাপধর্মী। অর্থাৎ তাঁর বয়ানের যে অংশকে লেখকের বর্ণনা বলে মনে হয়, তা-ও আসলে অন্যেরই কথা। চরিত্রের কথা। কথাসাহিত্যে বিশেষ মুহূর্ত বা পরিস্থিতি বা চরিত্রের পরিচয় খুব সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় তৈরি করতে পারার খ্যাতি হুমায়ূনের নামে প্রচারিত আছে। ঠিকই আছে। একটু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, এসব মুহূর্তে তিনি আসলে চরিত্রকে সংলাপরত ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন, অথবা সম্ভাব্য সংলাপের জন্য প্রস্তুত করেন। বর্ণনাটা তিনিই করছেন। কিন্তু চরিত্রের ভাব-স্বভাব আত্মসাৎ করে চরিত্রের পক্ষ হয়ে তিনি বর্ণনা করেন। তাতে চরিত্রের স্বর খুব স্পষ্টভাবে শোনা যায়। এ ব্যাপারটা ভালো বোঝা যাবে তাঁর গল্প-উপন্যাসকে নাটক বা চলচ্চিত্রে রূপ দিতে গেলে। দেখা যাবে, তাঁর বর্ণনা থেকে খুব সহজে-শব্দক্রমবিশেষ না বদলিয়েই এক-একটি সংলাপ তৈরি করে নেওয়া যাচ্ছে।
চরিত্রের সংলাপ চরিত্রের ভাব-স্বভাবসমেত আত্মসাৎ করে নেওয়ার মানেই হলো চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হওয়া। এ কাজে লেখক হিসেবে দুটি বড় গুণ হুমায়ূনের বরাবরের সঙ্গী। একটি সহানুভূতি, অন্যটি পক্ষপাতহীনতা। সহানুভূতি রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্রের লেখায় বিস্তর পরিমাণে আছে; মানিক বন্দ্যাপাধ্যায় বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসে নেই বললেই চলে। রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্রে আবার পক্ষপাত প্রবল। তাঁদের ভালো আর মন্দ যে কেবল চরিত্রের আচরণ থেকে স্থির হয় তা নয়; লেখকের অবস্থান থেকেও পরিষ্কার বোঝা যায়। অন্যদিকে হুমায়ূন বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো লেখকেরা মন্দের প্রতিও সমান সহানুভূতি দেখাতে পারেন। এতে একাত্ম হতে সুবিধা হয়। হুমায়ূন এ কারণেই তাঁর সব চরিত্রের পক্ষে সমানভাবে উপস্থিত থাকতে পারেন। বয়ানের কার্যকরতার দিক থেকে এ গুণের বিশেষ তাৎপর্য আছে। বিচিত্র চরিত্রের বিচিত্র স্বর একসঙ্গে শ্রুত হওয়ায় তাঁর লেখায় একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ সংলাপময়তা তৈরি হতে পারে। এখানে বলে রাখা দরকার, হুমায়ূন বড় পরিসরে বিপুল চরিত্র নিয়ে কাজ করেছেন কম। মধ্যাহ্ন বা জোছনা ও জননীর গল্প এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি সাধারণভাবে বেছে নিতেন ছোট পরিসরের পরিচিত অঞ্চল। ফলে তাঁর রচনায় বিপুল মানুষের স্বর শোনা যায় না। এটা তাঁর কথাসাহিত্যের সীমাবদ্ধতা বৈকি। কিন্তু যে অংশ তিনি বেছে নিতেন, তার সঙ্গে নিবিড়-নিগূঢ় পরিচয়ের লক্ষণ তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোতে পরিষ্কারভাবে টের পাওয়া যায়। সেই পরিচয়ের সুবাদেই চরিত্রগুলোকে যথাযথ পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করে, স্বরের প্রত্যক্ষতা অনাহত রেখে, উপস্থাপন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে। সারল্যের সংকট হয়নি; গভীরতায়ও টান পড়েনি।
হুমায়ূন গল্প বলতেন, কিন্তু গল্প থেকে কী বুঝে নিতে হবে তা বলতেন না। তিনি বিশ্লেষণপ্রবণ লেখক নন। এমনকি চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা বা সংকটের লম্বা পরিচয়ও তিনি নিজ দায়িত্বে দিতে চাইতেন না। কাজ করেছেন প্রধানত মানবিক-মনস্তাত্ত্বিক সংকট নিয়ে। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, তাঁর লেখার বিষয় প্রধানত ঢাকার মধ্যবিত্ত এবং ঢাকা-অভিমুখী গ্রাম-বাংলার মধ্যবিত্ত জীবন। শেষের দিকের অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ কয়েকটি লেখা বাদ দিলে হুমায়ূন মূলত মধ্যবিত্ত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই নিজেকে নীরত রেখেছেন। আবিষ্কার করতে চেয়েছেন আটপৌরে জীবনের সৌন্দর্য, সংকট ও সম্ভাবনা। শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে যেসব বিষয় আগে থেকেই বৃহৎ-মহৎ বলে স্বীকৃত, সেগুলোর প্রতি তিনি আকৃষ্ট হননি। একদিক থেকে তাঁর এ বৈশিষ্ট্য বিভূতিভূষণের মতো। পার্থক্য এই যে, হুমায়ূন কাজ করেছেন নগরবাসী মধ্যবিত্ত মুসলমান জনগোষ্ঠী নিয়ে। তিনি নিজে এই গোত্রেরই মানুষ। বলা যায়, তিনি নিজের গল্পটাই বলতে চেয়েছেন। এই গল্পটা তাঁর নিজেকেই আবিষ্কার করতে হয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্যের ধারায় এ ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপনিবেশবাহিত আধুনিকতা, কলকাতার প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য-ঘরানার চাপ আর আরোপিত তত্ত্ব ও সাহিত্যিক কৌশলের প্রভাবে ঢাকার সাহিত্যে নিজের জীবনের গল্পকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবাটা খুব সহজ হয় না। আমাদের সাহিত্যে নিম্নবত্ত, গ্রামীণ জীবন আর শ্রেণি-রাজনীতির প্রাধান্যের মূল কারণ সম্ভবত এটাই। হুমায়ূন অন্য পথে হেঁটে স্বচ্ছ ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সারল্যের অন্যতম কারণ তাঁর বিষয়বস্তুর পরিচিত জগৎ। পাঠকের পরিচিত বলয়ের মধ্যেই তিনি কথাসাহিত্যের বিষয় আবিষ্কার করেছেন। সেই গল্পটাই বলেছেন। সেই জীবনটাই দেখিয়েছেন।
দেখানোটা হুমায়ূনের সাহিত্যকর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশিষ্টতা। তাঁর সাহিত্যকর্ম মূল্যায়নধর্মী নয়, সিদ্ধান্তধর্মী নয়। গল্প বলে যে জনগোষ্ঠীর ছবি তিনি এঁকেছেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় অতি নিবিড়। সেখানে পেশাগত বৈচিত্র্য আছে, ধনী-গরিবের ব্যবধান আছে, বয়স-লিঙ্গ-ধর্ম-বর্ণের ফারাক আছে। সমস্ত বৈচিত্র্যকে স্বতন্ত্র মূল্য দিয়ে তিনি মোক্ষম সব ছবি তৈরি করে দেন। চরিত্র ও ঘটনাকে পরস্পর-সংলাপে শামিল করান। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা চাপিয়ে দেন না। পাঠকের জন্য পর্যাপ্ত পরিসর অবশিষ্ট থাকে।
হুমায়ূনের কথাসাহিত্য খুব গভীর অর্থে ‘লিবারাল’। সহানুভূশীল, কিন্তু নিরাসক্ত। তাঁর রচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাঠের জন্য দরকার অন্যতম নান্দনিক বোধ। দরকার সারল্যের মধ্যে গভীরতা আবিষ্কারের সামর্থ্য।