সেলিনা হোসেনের কথাশিল্পের বৈচিত্র্যময় ভুবন

দেশের অগ্রজ কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের ৭৫তম জন্মদিন আজ। এ উপলক্ষে প্রকাশিত হলো এই লেখা।

সেলিনা হোসেনের ছবি অবলম্বনে

সেলিনা হোসেন লেখক—পরিচয়ের এই অল্পোক্তি তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়। বৈচিত্র্যের প্রাচুর্যে তিনি ঋণী করেছেন বাংলা কথাশিল্পের জগৎ। ভাষা-ভাবনা কিংবা ইতিহাস সন্ধানে তিনি সহজাত ‘নিখুঁত’ পরিসীমায় আবদ্ধ। হৃৎকমলের সোনালি ফুলের মতো প্রণয়বীক্ষণ, সমাজ আর অনিবার্য যৌনতার অনুষঙ্গ ব্যবহারেও তিনি সুন্দর। তাঁর সর্বত্রগামী ভাবনার পরিসরে ‘পূর্ণ ছবির মগ্নতা’য় (২০০৮) যেমন রবীন্দ্রনাথ এসেছেন আমাদের পূর্ব বাংলার আত্মার আত্মীয় হয়ে, তেমনি ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ (১৯৮৩)–এ এসেছেন ডোম্বী, দেশাখ, শবরী, ভুসুকু, কাহ্ন আর কুক্কুরী পা। তিনি উর্দু কবি মির্জা গালিবের কবিপ্রতিভা নিয়ে লিখেছেন ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’ (২০১১)। গালিব—যে শুধু ভেসে ভেসে যায় বাতাসের সাথে, কথা কয় কবিতায়—সেই গালিব। সেলিনা হোসেন সাহসী, তাঁর অন্তরের গভীরতর তলদেশের গভীর ক্ষত খুলে দেখিয়েছেন তিনি। আপন কন্যার করুণ মর্মন্তুদ মৃত্যুর উপাখ্যানেও তিনি শৈল্পিক। ‘লারা’ (২০০০),  এখানে ব্যক্ত হয়েছে এক চমৎকার শূন্যতা। তাঁর শব্দরূপের কান্না সংযত বলেই যতক্ষণ লারার জীবনে প্রবাহটুকু ছিল, ততক্ষণই উপন্যাসে তিনি চঞ্চল।

সেলিনা হোসেন কালজ্ঞ সত্য দ্রষ্টা। তাই তাঁর ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ (১৯৭৬) উপন্যাসে আসে হলদী নদী, যুদ্ধদিনের বুড়ি ও রইস। ‘যাপিত জীবন’ (১৯৮১)–এ সোহরাব আলি সীমান্ত পার হয়ে এসে শোনায় দেশভাগের দুঃখ। আবার জীবন ও সংগ্রামকে তিনি স্বীয় সত্তায় ধারণ করেন বলেই ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ (১৯৮৬)–এর মতো উপন্যাসে হাঙরকে পরাভূত করে উঠে আসে জলমগ্ন মানুষের দল। কেবল শ্রেণিচেতনা নয়, ঐতিহ্য-স্মরণেও সেলিনা হোসেন আত্মগন্ধী। ‘চাঁদবেনে’ (১৯৮৬) উপাখ্যানে মঙ্গলকাব্যের সেই চাঁদ, যে লোহার বাসরঘরে আর মৃত পুত্রের শরীর দেখতে চায় না। পুরোনো পদ্মার মতো সকিনার যৌবনা শরীরে সে চায় মাটির পুরুষ। ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’য় (১৯৯২) স্বর্গীয় মিথ আসে মর্ত্যের নতুন অবয়বে। কালকেতুকে চেনা যায়। যেন আমাদের পরিচিত কোনো স্বৈরশাসক সে। আর ফুল্লরা? হায় রমণী, ব্যক্তিত্বের উত্তরণ নেই যার, পতন তারই অনিবার্য!

তাঁর উপন্যাসগুলোতে যে বিষয়টি অনন্য মনে হয় তা হলো, আখ্যানে তাঁর বয়ান শুধু একক ব্যক্তিত্বের নয়, সামষ্টিক। তাঁর পৌনঃপুনিক স্থান-কাল, ইতিহাস বা বিখ্যাত জীবনী ব্যবহারের সাহিত্যিক নির্মাণ বাংলা সাহিত্যকে যতটা ঋদ্ধ করেছে, তার চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ করেছে পাঠকের হৃদয়।

সেলিনা হোসেন কৃতজ্ঞ আত্মা। তিনি জানেন সংক্ষুব্ধ সময়ের ইতিহাসে উৎসর্গী পুরুষেরা বারবার জন্মান, যেমন জন্মেছিলেন সোমেন চন্দ, যেমন জন্মেছিলেন মুনীর চৌধুরী। সময়কে তাঁরা দিয়েছেন অকৃপণ দান। একজন কথাশিল্পী হিসেবে সেলিনা হোসেন তাঁদের ঋণশোধের প্রয়াসেই হয়তোবা লিখেছেন ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’ (১৯৮৭)।

অন্যদিকে ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ (১৯৮৩) উপন্যাসে সাঁওতাল বিদ্রোহ, রেশম চাষ কিংবা তেভাগা আন্দোলন ছাপিয়ে সর্বত্র যেন ইলা, ইলা, ইলামিত্র। ‘ভালোবাসা: প্রীতিলতা’ (১৯৯২) উপন্যাসে পাই প্রীতিলতার ভিন্ন উপস্থাপন। এখানে সেলিনা হোসেন নিজেই যেন জন্মেছেন তাঁর সময়ে, তাঁর স্বরূপে। নারীর ব্যক্তিত্ব উন্মোচনে তিনি হার্দিক। এ ক্ষেত্রে ‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’ (১৯৭৯), ‘পদশব্দ’ (১৯৮২) কিংবা ‘ক্ষরণ’ (১৯৮৮) উপাখ্যানের পটভূমিতে দেখি সেলিনা হোসেনের নারীরা একা। তাদের অন্তর্গত শূন্যতা কাব্যিকভাবে সুন্দর।

তাঁর উপন্যাসগুলোতে যে বিষয়টি অনন্য মনে হয় তা হলো, আখ্যানে তাঁর বয়ান শুধু একক ব্যক্তিত্বের নয়, সামষ্টিক। তাঁর পৌনঃপুনিক স্থান–কাল, ইতিহাস বা বিখ্যাত জীবনী ব্যবহারের সাহিত্যিক নির্মাণ বাংলা সাহিত্যকে যতটা ঋদ্ধ করেছে, তার চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ করেছে পাঠকের হৃদয়।

স্বল্প পরিসরে সেলিনা হোসেন আদতে আঁটেন না, তাঁর লেখার বিস্তৃতি এত ব্যাপক। ফলে এই লেখকের ৭৫তম জন্মদিনের ক্ষণে অকিঞ্চিৎকর এই লেখায় কেবল উপলব্ধির প্রেম তাকে উৎসর্গ করা গেল শ্রদ্ধার নৈবেদ্য। প্রিয় সেলিনা হোসেন, আপনি বেঁচে থাকুন, আমাদের অন্তরের নিবিড় কথাটুকু আপনার সোনার কলমে ফুল হয়ে ফুটুক আরও দীর্ঘ সময়।