স্মৃতিময় সেই সব দিন

‘নৌকার প্রতিযোগিতা দারুণ আনন্দ দিত’
‘নৌকার প্রতিযোগিতা দারুণ আনন্দ দিত’

শৈশব-কৈশোরে বেড়ে উঠেছি গ্রামে। মাথার ওপরে ছিল ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো একটা বিশাল সমুদ্রের মতো আকাশ। কখনো প্রশান্ত নীল, কখনো তাতে লালচে আভা, কখনো আঁশ ছাড়িয়ে থরে থরে সাজিয়ে রাখা থোকা থোকা তুলার মতো, আবার কখনো ঘন কালো মেঘে ঢাকা থমথমে বা বজ্র-বিদ্যুতের প্রচণ্ড ধ্বনিতে অন্ধকার বিদীর্ণ করা আলোকচ্ছটা ও প্রবল বর্ষণের নিচে ভিজে একশা হওয়ার জীবন আমাকে নানা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ করেছে। আর নদীনালা, গাছগাছালি এবং বিচিত্র মানুষের সঙ্গ-সংস্পর্শ-সখ্য যাপিত জীবনকে করেছে আনন্দময়, উপভোগ্য। মতান্তর, মনান্তর, ঈর্ষাও কিছু ছিল না এমন নয়; তবে সে তো জীবনেরই অংশ।
সেই প্রথম জীবনের পুরো কেচ্ছার বয়ান না, কিছু স্মৃতিময় ঘটনা নিয়েই এই আলেখ্য।
তখনকার মানিকগঞ্জ মহকুমার নিচু অঞ্চল সিংগাইর থানার চারিগ্রামের বাসিন্দা আমরা। ঢাকা শহর থেকে মাত্র ১৭-১৮ মাইল পশ্চিম-উত্তরে এই গ্রাম। গ্রামটি বর্ধিষ্ণু, কিন্তু যাতায়াতব্যবস্থা ১৯৬০ পর্যন্ত দুর্গম, দেড় মাইল হেঁটে বা নৌকাযোগে অনেক বাঁক ঘুরে লঞ্চে ঢাকা যাওয়া যেত। কিন্তু তাতে সময় লাগত ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। আর সোজা পথে নৌকায় যেতে হলে সকালে বেরোলে সন্ধ্যায় পৌঁছা যেত। গয়নার নৌকায়ও যাওয়া যেত সারা রাত ধরে।
এই গ্রামেই আমার জন্ম ও আকৈশোর বেড়ে ওঠা। প্রাথমিক ও হাইস্কুলে পড়াশোনাও ওই গ্রামেই। আমার শিক্ষক-ভাগ্য দারুণ। সরকারি প্রাথমিক স্কুলের তিনজন শিক্ষকই ছিলেন খুব দক্ষ। হেড স্যার অঙ্কে তুখোড়, তবে বড় বেত মারতেন। আমি অঙ্কে ছিলাম কাঁচা। বেত খাওয়ার ভয়ে শঙ্কিত থাকতাম। একদিন উনি দেরি করছেন ক্লাসে আসতে। আমরা শোরগোল করে ক্লাস মাথায় তুলে ফেলেছি। তিনি ক্লাসে ঢুকেই বললেন, ‘একেবারে হাট মিলিয়ে ফেলেছিস।’ তারপরেই জানতে চাইলেন, ‘আজ কী অঙ্ক?’ আমি ক্লাস ক্যাপ্টেন—তাই আমাকে বললেন, পেছনের বেতঝোপ থেকে বেত কেটে নিয়ে আয়। সেদিন স্যারের উগ্রমূর্তি দেখে বেত আনতে গিয়ে আর ফিরে আসিনি। তবে পরদিন শাস্তি হিসেবে আধা ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, আর এক ঘা বেত খেতে হয়েছিল।
বাংলার শিক্ষক আনিস স্যার ছিলেন জীবনানন্দ-প্রেমিক। হাতে থাকত কবির কোনো না কোনো বই।
১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেই প্রথম সাধারণ নির্বাচন। দারুণ উৎসব-উদ্দীপনা মানুষের মধ্যে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম সুযোগ। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্টের প্রতি মানুষের প্রবল আকর্ষণ। তিন নেতাই দারুণ জনপ্রিয়। ভোটের হাওয়া চারদিকে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে। আমি তখন আমাদের গ্রামের এস এ খান হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। একদিন স্কুলের শিক্ষকেরা খবর দিলেন শেরে বাংলা মানিকগঞ্জে আসবেন নির্বাচনের প্রচারে। ঢাকা থেকে লঞ্চযোগে তাঁর মানিকগঞ্জ যাওয়ার কথা। শিক্ষকেরা ঠিক করলেন, আমাদের গ্রামের লঞ্চঘাটে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হবে। আমরা ফুলের মালা নিয়ে দল বেঁধে লঞ্চঘাটে গেলাম। চারদিক থেকে পিলপিল করে লঞ্চঘাটে আসছিল মানুষ। সবাই উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে কখন হক সাহেবের লঞ্চ আমাদের ঘাটে ভিড়বে। লঞ্চ দূর থেকে দেখা যেতেই প্রচণ্ড স্লোগান উঠল: ‘শেরে বাংলা জিন্দাবাদ, হক সাহেব জিন্দাবাদ। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ’। অবশেষে প্রত্যাশার অবসান। লঞ্চ ঘাটে ভিড়েছে। মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনা-উল্লাস-উদ্দীপনা। সবাই হক সাহেবকে এক নজর দেখতে চায়। তাঁর কথা শুনতে চায়।
কিন্তু দেখা গেল, লঞ্চের দোতলা থেকে সামনে এগিয়ে আসছেন তাঁর কৃষক শ্রমিক দলের মানিকগঞ্জের নেতা আবদুল লতিফ বিশ্বাস। তিনি বললেন, ‘স্যারের শরীরটা ভালো না। শরীরে জ্বর। তিনি বক্তৃতা করতে পারবেন না। আপনাদের দোয়া চেয়েছেন।’ এ কথা শুনে মানুষের মধ্যে প্রথমে চাঞ্চল্য, পরে উত্তেজনা। শতকণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ‘আমরা হক সাহেবকে দেখতে চাই’। ঠিক তখনই দেখা গেল দোতলার তাঁর রুম থেকে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বিশাল বপু মানুষটি থপথপ করে বেরিয়ে আসছেন। বিশাল হাতে এক থাবায় লতিফ বিশ্বাসকে একদিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘বিশ্বাস সরো, আমার মানুষের থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবা না।’ তারপরে বললেন, ‘লতিফ বিশ্বাস ঠিকই বলেছে আমার জ্বর। প্রত্যেক লঞ্চঘাটে বক্তৃতা করে খুবই ক্লান্ত হয়ে গেছি। এখন আর বক্তৃতা করতে পারব না। আপনাদের একটা কথা জিজ্ঞাসা করি: “আপনারা আমারে কী বলে ডাকেন?”’ উচ্চরবে সহস্রকণ্ঠে ধ্বনিত হলো: ‘হক সাহেব’; তিনি তখন বললেন: ‘আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন, আমি যেন চিরদিন হক পথেই থাকি। আসসালামু আলাইকুম’। হক সাহেবের এই এক লাইনের বক্তৃতায় মানুষ উন্মত্ত হয়ে তাঁর পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে মিছিল করে ফিরে যেতে থাকল।
এই ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। জাদুকরী প্রতিভার এক রাজনীতিবিদ। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের স্কুলের পক্ষ থেকে তাঁর গলায় মালা পরিয়ে দেওয়ার। এই অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এক অসামান্য স্মৃতি হয়ে আছে।
আগেই বলেছি, আমাদের অঞ্চল ছিল জলাভূমি, নিম্নাঞ্চল। বর্ষাকালে চার-পাঁচ মাস প্রচুর পানিতে আমরা ঘেরাও হয়ে থাকতাম। ফলে নদী আর নৌকাই ছিল জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্ষাকালেই মানিকগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নৌকা করে আমরা বেড়াতে যেতাম। এই নৌকাভ্রমণে আমার খাদ্য-সুখের সঙ্গে আর এক নিয়মিত সঙ্গী হতো বিখ্যাত সব বাংলা উপন্যাস। এই নৌকাতেই যাত্রাপুর, দাদরোখি বা বাড়াইভিকরা আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার পথেই শুয়ে-বসে পড়েছি বুদ্ধদেব বসুর তিথিডোর, অমিয়ভূষণ মজুমদারের গড়শ্রীখণ্ড, তারাশঙ্করের গণদেবতা, ধাত্রীদেবতা, অমরেন্দ্র ঘোষের চরকাশেম ইত্যাদি দারুণ সব বই। সেই সব দিনের কথা মনে পড়ে বড়ই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি মাঝেমধ্যে।
গ্রামে ঈদের দিনের জামাকাপড়, খাওয়াদাওয়ার আনন্দ-উৎসব ছাড়াও আর একটি আনন্দ উপকরণের সুযোগ হয়েছিল গত শতকের পঞ্চাশের দশকের সূচনায়। আমাদের পাশের বাড়ির মামাদের বাড়িতে তখন সবে কলের গান (গ্রামোফোন) এসেছে। আজব বাক্সের ভেতর থেকে গান বেরিয়ে আসছে—সে এক অবাক কাণ্ড। রবীন্দ্র, নজরুলের গান, কে মল্লিকের গান, আব্বাস উদ্দীনের পল্লিগীতি, আর যতদূর মনে পড়ে জগন্ময় মিত্রের গান শোনা গেছে। আব্বাস উদ্দীনের পল্লিগীতি আর নজরুলের ইসলামি গানের প্রতি মুরব্বিদের আকর্ষণ। আর আমরা শুনতে চাই রূপকথার কাহিনির একটা রেকর্ড। সেটা শোনার জন্য আমাদের প্রবল আগ্রহ। রূপকথার গল্পটা এখন পুরো মনে নেই। এক রাজকুমারীকে আটকে রেখেছিল এক রাক্ষস। তার ভাইয়েরা এসে বীর বিক্রমে উদ্ধার করে তাকে। আমরা প্রবল উৎকণ্ঠায় উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতাম, কখন ভাইদের কণ্ঠে শোনা যাবে সেই সংলাপ: কোথায় কোথায় পালাবে রাক্ষসী, কোথায় তোর জাদুবিদ্যা। এই বলেই তরবারির আঘাতে প্রচণ্ড আর্তনাদ করে রাক্ষসীর মৃত্যুকাতরতা শুনে বিপুল উল্লাস-উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে যেয়ে আমরা হাততালি দিয়ে উঠতাম।
বর্ষাকালে ঈদ হলে আর এক ধরনের আনন্দ-উপভোগের সুযোগ ঘটত। নৌকাবাইচ হতো চারিগ্রামের নূরুনিগঙ্গায় অথবা পাশের গ্রাম পারিলের খালে। ছইওয়ালা নৌকার ওপরে বসে চিনাবাদাম চিবুতে চিবুতে নদীতে ভেসে নানা ধরন, সাইজ ও রঙের নৌকার প্রতিযোগিতা দারুণ আনন্দ দিত। দৌড়ের নৌকার ঢাকঢোল, কাঁসর ঘণ্টা, কখনো বা আলী আলী রণহুংকার বা রাধাকৃষ্ণের প্রেমগীতি এবং কখনো আবার বিপক্ষ দলের উদ্দেশ্যে ব্যঙ্গাত্মক গানের সুরে কলহাস্যমুখরিত হয়ে উঠত পরিবেশ। নৌকাবাইচের এই আড়ংয়ের উৎসবটি ছিল বড়ই মনোরম ও চিত্তসুখকর। এই নৌকাবাইচের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল শ্রীকৃষ্ণের মতো ঘোর কৃষ্ণবর্ণের একহারা গড়নের শালপ্রাংশু অবয়বের ইয়াছিন হাজমের অতিদর্শনীয় বাইচের নৌকা। নৌকার গলুইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে ইয়াছিনের বাবরি ঝুলিয়ে বাহারি নাচ আর কিছু খিস্তিখেউড়ের ভিয়ান দেওয়া গীতে মন ভরে যেত।
মধুময় সেই দিনগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেল!