বইটা ভিন্ন আকারের। ল্যান্ডস্কেপ আকারের বলা যায়। আমি আর মেরিনা রোজ তাজুল আর আতিককে গিয়ে ধরি, বই কবে আসবে। মেরিনার সঙ্গে তখনো আমার বিয়ে হয়নি। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আমরা হাতিরপুলে ভূতের গলির ভেতর একটা ছাপাখানায় গিয়ে ধরনাও দিলাম। ফেব্রুয়ারির বিশ তারিখের দিকে ‘গদ্যকার্টুন’ বই হিসেবে বের হলো।
‘নারী’ বইটাও বের হবে। প্রথমে তাজুল হক প্রচ্ছদ ছাড়া একটা কপি আনলেন বইমেলায়। আমি হুমায়ুন আজাদকে বললাম, ‘স্যার, আপনার নারী তো কভার ছাড়া এসেছে।’ হুমায়ুন আজাদ বললেন, নারী তো মলাট ছাড়াই ভালো। আমি সেই কথা, গালগল্পের ছলে, ভোরের কাগজে লিখে দিলাম। হুমায়ুন আজাদ আমার ওপর ভীষণ রেগে গেলেন, ‘এই, তোমাকে একটা কথা বলেছি রসিকতা করে। আর তুমি সেটা কাগজে ছাপিয়ে দিয়েছ। কাজটা ঠিক করোনি।’
আমার ‘গদ্যকার্টুন’ বইটা বের হলে বিক্রি হয়ে যেতে লাগল। ৬৫ টাকা দাম। আমি রয়ালটি হিসেবে ১৮ হাজার টাকা পেলাম তাজুল আর আতিকের কাছ থেকে। এই ১৮ হাজার টাকা পকেটে রেখে আমি বাসায় গিয়ে বললাম, ‘আমি বিয়ে করব। গায়েহলুদের খরচ আমি দেব।’ সুতরাং বলা যায়, গায়ে হলুদের টাকা জোগাড় করার জন্য আমি গদ্যের বই বের করেছিলাম।
হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ বইটা খুবই হইচই ফেলে দিল। ভালো বিক্রি হতে লাগল। পরে স্যার বইটা আগামী প্রকাশনীকে দিয়ে দেন। নদী প্রকাশনীও উঠে যায়। তখন বইটা নিষিদ্ধ করা হলে আগামী প্রকাশনা সংস্থা এবং হুমায়ুন আজাদ স্যার আদালতের শরণাপন্ন হন। আদালত বইটির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন।
সেই নব্বই দশকের একটা বইমেলায় হুমায়ুন আজাদকে আক্রমণ করতে যাচ্ছেন কয়েকজন তরুণ বিদ্রোহী কবি। কারণ কী? সঠিক কারণ জানা যায়নি, এত দিন পর নির্ভুল মনেও পড়বে না। তবে কোনো তরুণ কবি হুমায়ুন আজাদকে একটা লিটল ম্যাগাজিন উপহার দিলে তিনি তা অবহেলায় বাম হাত দিয়ে নিয়ে দূরে প্রায় ছুড়ে মেরে রেখে দিয়েছিলেন বা এই রকম কোনো কিছু। বা হয়তো বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বইগুলোই এখনো পড়া হয়ে ওঠেনি, তোমাদের এই সব নগণ্য বই কেন আমি কষ্ট করে বাড়ি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাব?’ তরুণেরা খেপে গেলেন। তাঁরা দলবদ্ধ হলেন। হুমায়ুন আজাদ তোপের মুখে পড়লেন। স্যারের ছাত্রী গবেষক সাহিত্যিক আকিমুন রহমান ছুটে এলেন আমার কাছে। তাঁর চোখেমুখে রাজ্যের উদ্বেগ। তিনি আমার হাত ধরে টানতে টানতে আগামীর স্টলের দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন।
আমি যাওয়ার আগেই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়। অন্যান্য লেখকের হস্তক্ষেপে তরুণেরা নিবৃত্ত হন।
হুমায়ুন আজাদ প্রায়ই বিতর্ক ও উত্তেজনার সৃষ্টি করতেন। একবার জাতীয় কবিতা উৎসবের মঞ্চে প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে তিনি বললেন, কাজী নজরুল ইসলাম অনেকাংশে প্রতিক্রিয়াশীল। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ উঠল। প্রতিবাদী লেখকগণ হুমায়ুন আজাদকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিলেন।
আরেকবার হুমায়ুন আজাদ বললেন, চলচ্চিত্র হচ্ছে অধমর্ণ, সাহিত্য হচ্ছে উত্তমর্ণ। সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’র চেয়ে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ অনেক গুণে শ্রেষ্ঠ। (কথাটা আমি স্মৃতি থেকে বললাম। হুবহু উদ্ধৃতি দিতে পারলাম না। একটু এদিক–ওদিক হবেই।) শুনে চলচ্চিত্র আন্দোলনের কর্মীরা ভীষণ খেপে গেলেন। তাঁরা বইমেলায় হুমায়ুন আজাদকে ঘেরাও করতে গেলেন। সে সময় নাকি এগিয়ে এসেছিলেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফার হস্তক্ষেপে তরুণদের প্রতিবাদ মৌখিক পর্যায়ের বেশি আর গড়ায়নি।
হুমায়ুন আজাদ সুন্দর সুন্দর প্রবচন তৈরি করতেন। আমার খুবই ভালো লাগত সেসবের অনেকগুলো। যেমন: ‘মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে।’
হুমায়ুন আজাদের কয়েকটা প্রবচন নিচে তুলে ধরছি:
১. ‘মিনিস্টার’ শব্দের মূল অর্থ ভৃত্য। বাংলাদেশের মন্ত্রীদের দেখে শব্দটির মূল অর্থই মনে পড়ে।
২. আমাদের অঞ্চলে সৌন্দর্য অশ্লীল, অসৌন্দর্য শ্লীল। রূপসীর একটু নগ্ন বাহু দেখে ওরা হইচই করে, কিন্তু পথে পথে ভিখিরিনীর উলঙ্গ দেহ দেখে ওরা একটুও বিচলিত হয় না।
৩. শ্রদ্ধা হচ্ছে শক্তিমান কারও সাহায্যে স্বার্থোদ্ধারের বিনিময়ে পরিশোধিত পারিশ্রমিক।
৪. আগে কারও সাথে পরিচয় হলে জানতে ইচ্ছে হতো সে কী পাস? এখন কারও সাথে দেখা হলে জানতে ইচ্ছে হয়, সে কী ফেল!
৫. ব্যর্থরাই প্রকৃত মানুষ, সফলেরা শয়তান।
৬. পরমাত্মীয়ের মৃত্যুর শোকের মধ্যেও মানুষ কিছুটা সুখ বোধ করে যে সে নিজে বেঁচে আছে।
৭. জনপ্রিয়তা হচ্ছে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি। অনেকেই আজকাল জনপ্রিয়তার পথে নেমে যাচ্ছে।
৮. উন্নতি হচ্ছে ওপরের দিকে পতন। অনেকেরই আজকাল ওপরের দিকে পতন ঘটছে।
৯. প্রতিটি গ্রন্থ সভ্যতাকে নতুন আলো দেয়।
১০. বাঙলার প্রধান ও গৌণ লেখকদের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, প্রধানেরা পশ্চিম থেকে প্রচুর ঋণ করেন, আর গৌণরা আবর্তিত হন নিজেদের মৌলিক মূর্খতার মধ্যে।
১১. বাঙালি যখন সত্য কথা বলে, তখন বুঝতে হবে পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে।
১২. অধিকাংশ রূপসীর হাসির শোভা মাংসপেশির কৃতিত্ব, হৃদয়ের কৃতিত্ব নয়।
১৩. পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনো।
১৪. আবর্জনাকে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করলেও আবর্জনাই থাকে।
১৫. নিজের নিকৃষ্ট কালে চিরশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার জন্য রয়েছে বই; আর সমকালের নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার জন্যে রয়েছে টেলিভিশন ও সংবাদপত্র।
১৬. শৃঙ্খলপ্রিয় সিংহের চেয়ে স্বাধীন গাধা উত্তম।
১৭. প্রাক্তন বিদ্রোহীদের কবরে যখন স্মৃতিসৌধ মাথা তোলে, নতুন বিদ্রোহীরা তখন কারাগারে ঢোকে, ফাসিঁকাঠে ঝোলে।
১৮. একনায়কেরা এখন গণতন্ত্রের স্তব করে, পুঁজিপতিরা ব্যস্ত থাকে সমাজতন্ত্রের প্রশংসায়।
১৯. পুরস্কার অনেকটা প্রেমের মতো; দুই-একবার পাওয়া খুবই দরকার, এর বেশি পাওয়া লাম্পট্য।
হুমায়ুন আজাদের সীমাবদ্ধতা বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণ হলো, তিনি ছিলেন আধুনিক, আধুনিকোত্তর হতে পারেননি। তিনি ‘নারী’র মতো গবেষণামূলক বই লেখা সত্ত্বেও দেখতে পাই, তাঁর নারীবিষয়ক প্রবচনগুলোয় ভেতরের পুরুষ স্পষ্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর তাঁর একটা মুগ্ধতা ছিল ইউরোপ বিষয়ে। তিনি মনে করতেন, ইউরোপ হচ্ছে জ্ঞান আর সভ্যতার কেন্দ্র এবং সূতিকাগার। ইউরোপের বাইরে কোনো জ্ঞান নেই।
আধুনিকদের এই সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা আছে। (আধুনিক মানে আধুনিকতাবাদী। মডার্নিস্ট।) বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকগুলোর পরের নতুন চিন্তা, বিশেষ করে উপনিবেশ-উত্তর চিন্তা হুমায়ুন আজাদদের কাছে ঠিকঠাক এসে পৌঁছায়নি বলে আমার ধারণা। তাঁরা বাংলা কবিতার তিরিশি আধুনিকতা দিয়ে মুগ্ধ ছিলেন। কারণ, তাঁদের জন্ম হয়েছে উপনিবেশের কালে। ছাত্রজীবন কেটেছে ব্রিটিশের ছকের মধ্যে। মনটা তৈরি করে দিয়েছে উপনিবেশকের জ্ঞান। পরে প্রাচ্যবাদ, উত্তর-উপনিবেশিকতা, উত্তর-আধুনিকতা, সাবল্টার্ন ইত্যাদি বিষয়ে যে প্রবল বাতাসে পুরোনো ঘরবাড়ি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, সেই বাতাসের মধ্যে পাখা মেলা তাঁদের কারও কারও আর হয়ে ওঠেনি।
আমাকে মহাদেব সাহা একদিন বললেন, ‘তুমি কি হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে কখনো রিকশায় উঠেছ? দেখবে, সে রিকশার বামদিক ছাড়া বসবে না। আর একটা গাড়ি বা বাস এলে সে কী রকম করে!’
আমি হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে যতবার রিকশায় উঠেছি, এই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। তিনি সত্যি সত্যি রিকশার বাম দিক ছাড়া বসতেন না। আর একটা গাড়িঘোড়া পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভয়ে আর্তনাদ করে উঠতেন, ‘এই রিকশাওয়ালা, বাঁয়ে সরে যাও, বাঁয়ে সরে যাও।’ পারলে তিনি রিকশা থেকে লাফ দিয়ে পড়বেন—এই রকম অবস্থা হতো।
হুমায়ুন আজাদ বইমেলার ছোট উপন্যাসগুলোর নাম দিয়েছিলেন অপন্যাস। তাঁর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু একটা সময় তাঁদের মধ্যে বেশ খাতিরই ছিল। হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয় হয়ে উঠলে হুমায়ুন আজাদ সেই জনপ্রিয়তাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতেন। আমাদের একবার বলেছিলেন, তিনি নাকি হুমায়ূন আহমেদকে বলেছেন, ‘হুমায়ূন, তুমি তো খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছ। তোমার নাটক টেলিভিশনে শুরু হলে কাজের মেয়েদের কিছুতেই আর টেলিভিশনের সামনে থেকে তোলা যায় না।’
হুমায়ুন আজাদ নিজেই উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন। তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম ‘ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল।’ এটাকে তিনি আখ্যা দিলেন বাংলা ভাষায় বিশ্বমানের উপন্যাস। বইমেলায় তিনি প্রতিদিন আসতেন। আগামীর স্টলে বসতেন। বইমেলা শেষ হলে তিনি আগামীর স্টল থেকে উঠে বাসায় যেতেন। ছাত্রছাত্রীরা, পাঠকেরা আগামীতে গেলে তাঁর দেখা পেতেন। তিনি বইয়ে স্বাক্ষর দিতেন। কোনো কোনো পাঠকের সঙ্গে তর্ক করতেন। হুমায়ূন আহমেদ তখন লিখলেন, একজন অধ্যাপক উপন্যাসকে অপন্যাস বলে তাচ্ছিল্য করতেন, এখন দেখি তিনি নিজেই অপন্যাস লিখে বইমেলায় সেসব সাজিয়ে বসে বসে বিক্রি করেন।
হুমায়ুন আজাদের ছোটদের বইগুলো অপরূপ। ‘কত নদী সরোবর’, ‘লালনীল দীপাবলি’, ‘আব্বুকে মনে পড়ে’, ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’—এগুলো পড়তে আরম্ভ করলে হৃদয় আপ্লুত হয়ে যায়। তাঁর সম্পাদিত বই ‘বাঙলা ভাষা’ দুই খণ্ডও খুব কাজের। অবশ্যই ঘরে ঘরে সংগ্রহে রাখার মতো একটা বই।
মেরিনা আর আমি বিয়ের পরও বইমেলা যেতাম। একদিন হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘তোমরা দুজন এখনো একসঙ্গে আছ?’ এরপর থেকে হুমায়ুন আজাদকে দেখলে একটু দূরে দূরে থাকতাম। তাঁর ধারালো জিবের শিকার হয়ে কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসবে!
একদিন বইমেলা থেকে ফিরে সাংবাদিক বড় ভাই পুলক গুপ্তের বাসায় নেমন্তন্নে নৈশভোজে ব্যস্ত আছি। সে সময় খবর এল, বইমেলা থেকে ফেরার পথে হুমায়ুন আজাদ আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
খুব মন খারাপ করলাম। খুব ভয়ও পেলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাহসিকতার পরিচয় দিল। পুরো ক্যাম্পাস প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠল। টেলিভিশনগুলো হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে বিশেষ রকম অনুষ্ঠান প্রচার করতে লাগল। সংবাদপত্র তাঁকে নিয়ে নানা আয়োজন প্রকাশ করল।
আক্রমণের পরদিন মেরিনাকে বললাম, ‘আজ আর বইমেলায় যাব না।’
মেরিনা বললেন, ‘আজই তুমি বইমেলায় যাবে। কী হবে? মেরে ফেলবে? মেরে ফেললে মরে যাবে।’
আমিও বুক বাঁধলাম। এখনই বইমেলায় যেতে হবে এবং বেশি করে যেতে হবে।
আক্রান্ত হওয়ার পর হুমায়ুন আজাদ ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু তারপর জার্মানিতে গিয়ে তিনি মারাই গেলেন।
হুমায়ুন আজাদ সব কটি পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হলেন কয়েকবার।
তিনি নিজের জীবন দিলেন নিজের মত প্রকাশ করার জন্য। তাঁর অনেক কথা আমার নিজেরই পছন্দ হতো না। কার সব কথাই বা আমাদের সবার পছন্দ হবে? তবে লেখার জবাব হতে হবে লেখা দিয়ে। তরবারি দিয়ে নয়।
হুমায়ুন আজাদ রিকশায় উঠতেও খুব ভয় পেতেন। সে হিসেবে তাঁকে ভীতুই বলতে হবে।
কিন্তু তাঁকে মারা যেতে হলো আততায়ীর আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায়। তিনি মারা গেলেন সাহসী মানুষ হিসেবে।
কী রকম নরম ছিল কঠিন খোলসের ভেতর তাঁর মনটি যে তিনি এই রকম কবিতা লিখতে পারেন:
‘ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।
ভালো থেকো চর, ছোট কুঁড়েঘর, ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।
ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাঁশি।
ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাঁও,ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।’
বইমেলা আজও হয়। আগামীর স্টল থাকে। তার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয়, এখনই হুমায়ুন আজাদ ডাক দেবেন, ‘এই আনিস, এই আনিস, এদিকে এসো। তুমি তো দেখছি অপন্যাস লিখতে লিখতে পতনের সবচেয়ে উঁচু সিঁড়িটিতে পৌঁছে গেছ!’
১৯৮৮ সালের বন্যায় আমরা কবিতা পরিষদের পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে নৌকায় করে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সাভার ধামরাই এলাকার পুরোটা পানির নিচে। আমরা ডুবে যাওয়া বাড়িঘরগুলোয় নৌকা নিয়ে গিয়ে চাল-ডাল ইত্যাদির প্যাকেট বিলি করে এসেছিলাম। হুমায়ুন আজাদ ছিলেন। তার পরনে ছিল জিনসের প্যান্ট, গায়ে টি–শার্ট। আমি বললাম, ‘স্যার, সাঁতার জানেন? নৌকা ডুবে গেলে আপনার জিনসের প্যান্ট ভিজে ভারি হয়ে হাঁটুতে বসে যাবে। আপনি একদণ্ডও ভাসতে পারবেন না। মারা যাবেন।’
হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘আমি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য এসেছি। এই জন্য যদি মরতে হয়, মরতে হবে।’
হুমায়ুন আজাদ কবিতায় লিখেছিলেন:
‘আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাব
ছোট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাব চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে
একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে।
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাব
দোয়েলের শিসের জন্যে
শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাব কারও চোখের মণিতে
গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে
একফোঁটা রৌদ্রের জন্যে।
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাব
এককণা জ্যোৎস্নার জন্যে
একটুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাব টাওয়ারের একুশতলায়
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
এক ফোঁটা সবুজের জন্যে।
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাব
খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে
খুব ছোট দুঃখের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাব কারও ঘুমের ভেতরে
একটি ছোট দীর্ঘশ্বাসের জন্যে
একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে।
হুমায়ুন আজাদ ‘ছোট্ট কিছু’র যে তালিকা দিয়েছেন, সেসবের কোনোটাই ছোট নয়। এককণা জ্যোৎস্না, এক টুকরো মেঘ অনেক বড় ব্যাপার।
হুমায়ুন আজাদ সম্ভবত বড় কিছুর জন্যই মারা গিয়েছিলেন।