হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের উৎসর্গপত্র
উৎসর্গপত্রে কীই-বা এমন বলা যায়? অল্প কিছু শব্দে কতটুকুই-বা লেখা যায়? কিন্তু নন্দিত কথাকার হুমায়ূন আহমেদ গল্প বলেন উৎসর্গপত্রের সেই ছোট্ট পরিসরেও। কয়েকটিমাত্র শব্দে কখনো সেখানে তিনি মুগ্ধতার গল্প বলেছেন, কখনো বলেছেন নিখাদ ভালোবাসার কথা। তাঁর লেখার মতো হুমায়ূনের উৎসর্গপত্রের জগৎও বড়ই বিচিত্র।
১৯৭২ সাল। প্রকাশিত হলো হুমায়ূন আহমেদের প্রথম বই নন্দিত নরকে। প্রথম বইয়ের উৎসর্গবাণীতেই অবশ্য গতানুগতিকতাকে ছাড়িয়ে যাননি লেখক। শুধু লিখেছিলেন, ‘নন্দিত নরকবাসী মা-বাবা, ভাইবোনদের’। এরপর তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই পড়তে পড়তে আমরা যখন একটু একটু করে ব্যক্তি হুমায়ূন ও তাঁর পরিবারকে চিনতে শিখেছি, তখন কিছুটা হলেও উপলব্ধি করেছি এই সহজ-সাধারণ উৎসর্গপত্রের গভীরতা। হুমায়ূন আহমেদ সে সময় সদ্য পিতৃহারা পুত্র, মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতি মাথায় নিয়ে ঘুরতে থাকা এক তরুণ, লড়াকু মায়ের ছায়ায় একদল ভাইবোন নিয়ে বেড়ে ওঠা দুরন্ত এক স্বপ্নবাজ। ফলে নিজের প্রথম বইয়ের উৎসর্গে তো তিনি কাছের মানুষদের কথাই বলবেন!
কয়েক বছর পর তিনি সংসার শুরু করলেন গুলতেকিন খানের সঙ্গে। তিন কন্যা, এক পুত্র নিয়ে সাজানো সে সংসারের দিবারাত্রির কাব্য বিভিন্ন বইয়ে আমরা যেমন পড়েছি, তেমনি উৎসর্গপৃষ্ঠাতেও উঠে এসেছে তাদের পারস্পরিক বন্ধনের মায়াবী চিত্র। স্ত্রী গুলতেকিনকে উৎসর্গ করেছেন মে ফ্লাওয়ার, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, মিসির আলি অমনিবাসসহ আরও কিছু বই। রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে গুলতেকিনকে লেখা এমনই এক উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন:
‘ভালোবেসে যদি সুখ নাহি
তবে কেন মিছে এ ভালোবাসা’।
বড় মেয়ে নোভাকে হুমায়ূন পড়তে দিয়েছিলেন দারুচিনি দ্বীপ-এর প্রথম পাণ্ডুলিপি। একদল তরুণের দ্বীপভ্রমণের স্বপ্নকে কেন্দ্র করে লেখা উপন্যাসটি পড়ে নবম শ্রেণিপড়ুয়া নোভার জোর আবদার, আঠারো বছর বয়স হলে বাবা যেন তাকেও সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যেতে দেন! এই যেতে দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে মেয়ের সঙ্গে যত খুনসুটি আর অভিমান, পরম যত্নে তা তিনি তুলে ধরেছেন এ উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে।
কহেন কবি কালিদাস-এর উৎসর্গ পড়ে আমরা জানলাম, অন্য সব বাঙালি যুবকদের মতো নুহাশ হুমায়ূনও একসময় ‘হিমু’ হতে চাইতেন। অন্যপক্ষে, আমার প্রিয় ভৌতিক গল্প একসঙ্গে তিন মেয়ে নেভা, শিলা ও বিপাশাকে উৎসর্গ করে হুমায়ূন লিখেছেন, ‘এরা ভূত বিশ্বাস করে না, কিন্তু ভূতের ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে। প্রায়ই দেখা যায় তিন কন্যা ঠাসাঠাসি করে এক বিছানায় ঘুমুচ্ছে, কারণ কেউ একজন ভয় পেয়েছে।’ এভাবেই নব্বইয়ের দশকে বেড়ে ওঠা তিন বোনের নিষ্পাপ শৈশবের একটুকরো চিত্র আঁকা হয়ে যায় অল্প কয়েকটি শব্দে, মমতার গাঢ় আবেশে।
পরবর্তীকালে গুলতেকিনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর হুমায়ূনের জীবনের যে পরিবর্তন, তার স্পষ্ট ছাপ ধরা পড়েছে তাঁর বইয়ের উৎসর্গপত্রেও। এ সময় দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে তিনি উৎসর্গ করেন মধ্যাহ্ন, চলে যায় বসন্তের দিন, মানবীসহ অনেকগুলো বই। এর মধ্যে মধ্যাহ্ন-এর উৎসর্গের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে শাওনের প্রতি লেখকের ভালোবাসার গভীরতম উপলব্ধি:
‘পরম করুণাময় ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ উপহার তাকে দিয়েছেন। তার কোলভর্তি নিষাদ নামের কোমল জোছনা। আমার মতো অভাজন তাকে কী দিতে পারে? আমি দিলাম মধ্যাহ্ন। তার কোলে জোছনা, মাথার উপর মধ্যাহ্ন। খারাপ কি?’
আবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান নিষাদ ও নিনিতকে যখন তিনি বই উৎসর্গ করেছেন, সেখানে তাঁর সহজাত রসিকতা, স্নেহ প্রকাশ পাওয়ার পাশাপাশি ফুটে উঠেছে বিচিত্র এক হাহাকার। দেখা না দেখা নামের ভ্রমণকাহিনিটি উৎসর্গ করা হয়েছে পুত্র নিষাদ হুমায়ূনকে। এরপর লিখেছেন:
‘তুমি যখন বাবার লেখা এই ভ্রমণকাহিনী পড়তে শুরু করবে, তখন আমি হয়তোবা অন্য এক ভ্রমণে বের হয়েছি। অদ্ভুত সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কাউকেই জানাতে পারব না। আফসোস!’
এই হাহাকার আরও গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত মৃত কন্যা লীলাবতীকে লেখা উৎসর্গবার্তায়। দিঘির জলে কার ছায়ার উৎসর্গপত্রে ধরা আছে মায়ায় ঘেরা কিছু শব্দ, এক আবেগপ্রবণ পিতার কণ্ঠস্বর:
‘কন্যা লীলাবতীকে। এই উপন্যাসের নায়িকা লীলা। আমার মেয়ে লীলাবতীর নামে নাম। লীলাবতী কোনো দিন বড় হবে না। আমি কল্পনায় তাকে বড় করেছি। চেষ্টা করেছি ভালোবাসায় মাখামাখি একটি জীবন তাকে দিতে। মা লীলাবতী: নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।’
পরিবারের বাইরেও অনেক বন্ধু, সহকর্মী ও সহচর, এমনকি দূরের মানুষকেও বই উৎসর্গ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। সেখানে কখনো স্বীয় ভঙ্গিমায় কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন, কখনোবা বলেছেন নিজের ভালো লাগার কথা। তাঁর দ্বিতীয় বই শঙ্খনীল কারাগার-এর কথাই ধরি। এর উৎসর্গপত্রটি ছিল সাদামাটা, লিখেছিলেন দুটোমাত্র নাম:
‘আনিস সাবেত
আহমদ ছফা
শ্রদ্ধাস্পদেষু’।
ব্যস, এটুকুই। তবে বহু বছর পর এই উপন্যাসের নতুন সংস্করণে তিনি লিখলেন, প্রথম দুটো উপন্যাসই প্রকাশিত হয়েছিল বন্ধু আহমদ ছফার উৎসাহে। অবশ্য এর মধ্যেই পাঠকেরা পড়ে ফেলেছেন হুমায়ূনের আত্মস্মৃতিমূলক বইগুলো ছবি বানানোর গল্প, বলপয়েন্ট, কাঠপেন্সিল। তাই তাঁরা এ-ও জেনে গেছেন যে শঙ্খনীল কারাগার-এর উৎসর্গপত্রে উল্লেখিত ব্যক্তিদ্বয়ের একজন গায়ে আগুন দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের পক্ষে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন, আরেকজন লেখকের স্বপ্নদ্রষ্টা। আমাদের সামনে তখন সত্তরের দশকের একটি চিত্র বেশ খানিকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেখানে গভীর রাতে ঢাকার রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছেন আনিস সাবেত, আহমদ ছফা ও হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূনের ছবিপাড়ার অফিসে প্রায়ই দুপুরবেলা হাজির হতেন অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ। তাঁর সঙ্গে ভাত খেতে খেতে আড্ডা দেওয়ার সেই সব স্মৃতি স্মরণ করে এই মেঘ, রৌদ্রছায়ার উৎসর্গবাণীতে হুমায়ূনের ভাষ্য বড়ই আটপৌরে, ‘ইদানীং মাহফুজ খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দুপুরবেলা তার হাসিমুখ দেখতে পাই না। মাহফুজ কি জানে, প্রতিদিন দুপুরে আমি মনে মনে তার জন্যে অপেক্ষা করি?’ বলা দরকার, হুমায়ূনের গল্প-উপন্যাসের ভাষা যেমন আটপৌরে ও মায়াবী, একই ছাপ রয়েছে তাঁর উৎসর্গভাষ্যতেও।
উৎসর্গপৃষ্ঠায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশেও এ লেখক ছিলেন অকপট। লিলুয়া বাতাস-এর উৎসর্গপত্রটি দেখা যাক আবার। তিনি লিখছেন, ‘দীর্ঘদিন কেউ আমার পাশে থাকে না, একসময় দূরে সরে যায়। হঠাৎ হঠাৎ এক-আধজন পাওয়া যায় যারা ঝুলেই থাকে, যেমন অভিনেতা ফারুক।’
একইভাবে চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতার কথাও বহুবার উঠে এসেছে তাঁর উৎসর্গলেখায়। ডাক্তার জাহিদকে ধন্যবাদ দিয়েছেন ঘ্রাণশক্তি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, কার্ডিওলজিস্ট শহীদ হোসেন খোকনকে বলেছেন ‘স্বস্তিকারকেষু’।
হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর সহচরদের লেখায় বারবার উঠে এসেছে অন্যকে মুগ্ধ করতে, চমকে দিতে কী দারুণ আগ্রহী ছিলেন তিনি! আর নিজেও যে মুগ্ধতা ধারণ করতেন, তার প্রমাণ মেলে তাঁর বইয়ের উৎসর্গপত্রে। তিথির নীল তোয়ালে বইটি অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফাকে উৎসর্গ করে লিখেছেন, ‘আমার জানতে ইচ্ছে করে, একজন মানুষ এত ভাল অভিনয় কীভাবে করেন’। মুগ্ধতা ব্যক্ত করে বই উৎসর্গ করেছেন আবুল খায়ের, হুমায়ূন ফরীদি, জুয়েল আইচ, জাহিদ হাসান, বিপাশা হায়াত, সাকিব আল হাসানসহ অনেককে।
জাহানারা ইমাম, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার—এমন অনেক গুণীজনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বেশ কিছু বইয়ের উৎসর্গে। তবে শ্রদ্ধা প্রকাশের ভেতরেও ছিল হুমায়ূনীয় স্বভাবসুলভ রসিকতা। মুনতাসীর মামুনকে বৃহন্নলা উপন্যাসটি উৎসর্গ করে তিনি লেখেন, ‘যিনি মনে করেন আমার মিসির আলিবিষয়ক রচনাগুলির টিকে থাকার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে। অন্য রচনাগুলির তাও নেই।’
শুধু সরস রসিকতা নয়, হুমায়ূনের কিছু কিছু উৎসর্গপত্র ভীষণ রকম অদ্ভুতও। প্রণব ভট্টকে উৎসর্গ পাতায় জায়গা দিয়ে লিখলেন, ‘তাঁর পুরোটাই কলিজা।’ অনিমেষ আইচকে দিলেন ‘মিসির আলি সন্ধানেষু’র খেতাব। আবার হিমু মিসির আলি যুগলবন্দী বইয়ের উৎসর্গের জায়গায় অবলীলায় লিখে দিলেন এই বাক্যও:
‘আমার কিছু পাঠক আছেন যারা হিমু এবং মিসির আলি দুজনকেই পছন্দ করেন না। হিমু মিসির আলি যুগলবন্দি বইটি তাদের জন্যে।’
নন্দিত হুমায়ূনের কী বিচিত্র সব কাণ্ড! কখনো কখনো উৎসর্গবাণীতে কারও নাম পর্যন্ত লিখতে চাননি তিনি। হরতন ইশকাপন-এ প্রথম লিখলেন, ‘উৎসর্গ পাতায় কারোর নাম লিখতে ইচ্ছা করছে না। যত বয়স বাড়ছে আমিও মনে হয় মিসির আলির মতো নিজেকে গুটিয়ে আনছি।’ পরে এর পুনরাবৃত্তি ঘটল হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য, মিসির আলি! আপনি কোথায়? এবং আজ হিমুর বিয়ে—এমন আরও কিছু বইয়ে।
হুমায়ূন আহমেদের লেখার প্রতি মুগ্ধতা আছে অজস্র পাঠকের। অনেকে এমনও বলেন, তিনি এক মুগ্ধকর। তবে আলাদাভাবে তাঁর বইয়ের উৎসর্গপত্রের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায়, দীর্ঘ লেখকজীবনে অসংখ্য মানুষকে বই উৎসর্গ করেছেন জনপ্রিয় এই লেখক। আর আটপৌরে ভাষায়, ছোট ছোট বাক্যের সেই উৎসর্গপত্রগুলোও কম মুগ্ধকর নয়।