
ভাবতে ইচ্ছা করে যে এখনো পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও ‘ট্রু লাভ বা প্রকৃত ভালোবাসা’ বলে কিছু একটা আছে—যা চিরন্তন, একগামী, একনিষ্ঠ। ভাবতে ভালো লাগে যে মনের মধ্যে কোনো একটা অবিরত অবচেতন চর্চা চলতে থাকার কথা যে, ‘আমি তোমার, শুধুই তোমার।’
—ফেসবুকে জনৈক্য ব্যক্তির মন্তব্য
‘রবিন ফোন করেছিল।’ অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খুবই ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে, যেন খুব সাধারণ একটি তথ্য দিচ্ছে এমনভাবে কথাটা বলল তারেক। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল দীপার। গলাটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে সে জানতে চাইল, ‘ফোন করেছিল কেন?’
‘জানি না। বলল, অনেক দিন দেখা হয় না। তাই দেখা করতে চায়। সামনাসামনি কী যেন বলবে...’
তারেক চা শেষ করে উঠে পড়ে। এখন সে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে, হয়তো কোনো একটা হালকা মিউজিক শুনতে শুনতে মেডিটেশন করবে। তারপর উঠে টিভির খবর দেখবে। সবশেষে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমুতে যাবে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলে এই তার বাঁধাধরা রুটিন, দীপা জানে। তারেকের ফেলে যাওয়া চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে দীপার বুক ধড়ফড় করতে থাকে। রবিন কেন হঠাৎ ফোন করল ওকে? এত দিন পর? সামনাসামনি কী বলতে চায় সে? অস্বস্তির একটা সূক্ষ্ম কাঁটা খচখচ করে বিঁধতে থাকল মনের কোণায়। দাঁতের ফাঁকে অদেখা কাঁটা বিঁধে থাকলে যেমন অস্বস্তি হয়, তেমন।রবিন যদি এখন তারেককে সব বলে দেয়, তবে সে কীভাবে নেবে বিষয়টা, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে দীপার। জীবনযাপনে তারেক সব সময়ই খানিকটা পিউরিটান ধরনের—মূল্যবোধ, বিশুদ্ধতা, সততা, কমিটমেন্ট, কর্তব্যনিষ্ঠা—এসবের খুব দাম দেয় সে। নিজে সেসব পালন করে আর অন্যদের কাছেও আশা করে একই রকম দায়িত্বশীলতা। সেই তারেক কি সব জানতে পারলে প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত করবে না দীপাকে?
বিক্ষিপ্ত মনটা শান্ত করতে, নিজের সঙ্গে একা কথা বলার জন্য রান্নাঘরই দীপার একান্ত আশ্রয়। পত্রিকার রেসিপি দেখে কিছু একটা বানাতে ফ্রিজ থেকে মাংসের কিমা নামায় সে। মসলার কৌটা খোঁজে। চুলার পাশের কাচের জানালার কার্নিশে তখন সাদা-কালো রঙের বিড়ালটাকে দেখা যায়। জানালা খোলা পেলেই একলাফে ঢুকে যাবে, চোখে রাজ্যের প্রত্যাশা আর আকুতি নিয়ে স্বচ্ছ পাল্লার ওপাশ থেকে তাকিয়ে আছে। শৈলী এসে উঁকি দেয় রান্নাঘরের দরজায়।
‘কী করো? কেউ আসবে নাকি?’
‘নাহ্...এমনি...তুই?’
‘কফি খাব, মা।’
এই এক নতুন অভ্যাস হয়েছে মেয়েটার। যখন-তখন কফির তেষ্টা। দীপা একটু সরে গিয়ে চুলার পাশে জায়গা করে দিলে মগ ভর্তি করে নিজেই কফি বানায় শৈলী। তারপর মগে একটু পর পর লম্বা চুমুকের ফাঁকে ফাঁকে বলে, ‘বাজিরাও মাস্তানি ফিল্মটা দেখলাম মা...ভাল লাগল না...আচ্ছা, এটা কি সত্যি গল্প?’
দীপা কিমা থেকে পানি ঝরিয়ে কড়াইয়ে তেল গরম করে।
‘ফালতু একটা গল্প। জানো, বাজিরাও প্রেমে পড়ে মাস্তানির, মাস্তানিও একেবারে পাগল ওর জন্য। ওর কিন্তু বউ আছে—কাশি বাঈ; প্রিয়াংকা চোপড়া রোলটা করেছে...’
দীপা গরম তেলে পেঁয়াজ ছেড়ে দেয়।
‘মা, বিল্লিটা দেখো, কী কিউট! কেমন গোল গোল চোখ করে তোমাকে দেখছে।’
‘খবরদার জানালা খুলিস না, ঢুকে পড়বে!’
শৈলী জানালার দিকে এগিয়ে গেলে সাবধান করে দীপা। কাচের এপাশ থেকে বিড়ালটার মুখের ওপর হাত বোলায় শৈলী। মুখে চুক চুক করে আদরের শব্দ করে।
‘জানো মা, কাশির অনেক কষ্ট। ও বাজিরাওকে কৃষ্ণের কাহিনি শোনায়, কৃষ্ণের বউ নাকি বলেছিল, “আমি তোমার স্ত্রী না হয়ে সখী হলে ভালো হতো। কৃষ্ণ বলে, “কেন?” বউ বলে, “সারা জগৎ তোমার নামের সঙ্গে তোমার সখীর নাম বলবে, আমি তো জগতের কাছে কেউ না।” তখন কৃষ্ণ বলে, “কেন? আমি তো তোমাদের দুজনকেই সমান ভালোবাসি।” জানো মা, বাজিরাও-ও কিন্তু কাশিকে বলে, “আমি তোমাকে আর মাস্তানিকে সমান ভালোবাসি।” আচ্ছা, দুজনকে কখনো একসঙ্গে ভালোবাসা যায়?’
গরম তেলে দীপার পেঁয়াজগুলো বাদামি হয়ে উঠেছিল। সে তেল থেকে ভাজা পেঁয়াজ তুলে রেখে মাংসের কিমার সঙ্গে কর্নফ্লাওয়ার, পেঁয়াজ কুচি, ডিম, লবণ আরও কী সব মসলা মিশিয়ে মাখতে থাকে।
‘কেউ যদি একসঙ্গে দুজনকে ভালোবাসতে পারে, তাহলে তোর অসুবিধা কী?’
মিশ্রণটা মাখতে মাখতে বলে দীপা। শৈলীর কফি শেষ। কিন্তু তার কথা শেষ হয়নি। হয়তো তার ষোলো বছরের বোধবুদ্ধি থেকে প্রেমকে বিবেচনা করছে সে।
‘নাহ, আমি ভাবছি সেটা সম্ভব কি না?’
দীপার তখন মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে তারেকের সেই সব কথা। যখন সে বলত, ‘হয় ভালোবাসব, নয়তো না, হয় পুরোটাই নয়তো একটুও না, হয় একজন আর নয়তো কেউই নয়—মাঝামাঝি কিচ্ছু নেই।’
দীপাও সে সময় সে রকমই ভাবত, ভাবতে ভালোবাসত। তখন সব ঋতুই ছিল বসন্ত ঋতু। সব বাতাসই সুশীতল, সব নদীর জল ছিল গাঢ় নীল।
‘আহা সেই দিনগুলি আর নেই!’ দীপা মাংসের গোল বল তৈরি করতে করতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। শৈলী চলে গেছে। কাচের জানালার ওপাশ থেকে কাতর চোখে তাকিয়ে থাকা সাদা-কালো বিড়ালটাও নেই।
পরদিন অফিস থেকে ফেরার পর তারেকের মুখভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করে দীপা। তারেক আজ বেশ দেরি করে ফিরেছে। চোখমুখ গম্ভীর। অন্ধকার। কপালটা কেমন কুঁচকে আছে, যেন সবকিছুর ওপর বিরক্ত। দীপার বুকের ধুকপুকানি হঠাৎ বেড়ে যায়। তাহলে কি আজ রবিন এসেছিল? বলে গেছে সব? দীপা চোখের কোনা দিয়ে নীরবে তারেকের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে।
‘মাথাটা খুব ধরেছে।’ তারেক কাপড় চেঞ্জ করে বলে, ‘একটা প্যারাসিটামল খেতে হবে।’
যাক, মাথাব্যথা! রবিন তাহলে আসেনি। দীপার বুক থেকে যেন একটা বিশাল ভার নেমে যায়। সে কোমল কণ্ঠে বলে, ‘তুমি একটুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি মাথাটা টিপে দিচ্ছি।’
পরদিন তারেকের মুখ আরও অন্ধকার। চেহারা শোকাচ্ছন্ন। বিধ্বস্ত। আজ তাহলে ঠিকই রবিন এসেছিল। তারেকের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করে দীপা। সহজে আবেগ সামলাতে পারে না তারেক। হয়তো মেয়ের সামনেই চিল্লাপাল্লা করে একটা সিনক্রিয়েট করে বসবে। হয়তো সংসারটাই ভেঙে যাবে। যেমন দুম করে সিগারেট ছেড়েছিল, তেমনি দুম করেই হয়তো সংসার ছেড়ে চলে যাবে তারেক। কী করবে দীপা? কী করা উচিত তার? কেমন দমবন্ধ লাগে দীপার! রান্নাঘরে এসে আনমনে জানালাটা খুলে দেয়। ‘মিঁয়াও’ শব্দে সম্ভবত আনন্দ প্রকাশ করেই লাফ দিয়ে ঘরে ঢোকে সাদা-কালো।
‘আরে বিড়ালটা...’ রান্নাঘরের দরজায় তখন তারেকের ছায়া। মুখ দিয়ে ‘হুঁশ, হুঁশ’ শব্দ করে সে। আর সাদা-কালো একলাফে জানালা দিয়ে পালায়। তারেক ক্লান্ত কণ্ঠে বলে, ‘আমাকে এক কাপ চা দিতে পারো? খুব ক্লান্ত লাগছে...’
চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় আসে দীপা। তারেকের সামনে নিজেকে দাগি আসামির মতো লাগে তার। মনে হয়, এক্ষুনি হয়তো তারেক তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। কঠিন স্বরে রবিন প্রসঙ্গে জেরা করতে শুরু করবে, বলো দীপা, বলো কী সম্পর্ক রবিনের সঙ্গে তোমার?
বন্ধুত্ব? হুহ্! হাসায়ো না আমারে!
...তোমাকে বহুবার বলছি না, নারী-পুরুষের সম্পর্ক কখনোই নিছক বন্ধুত্বের হয় না। নারী-পুরুষের বন্ধুত্বের নামে যে ফ্যান্টাসি শুরু হয় তা শেষ পর্যন্ত এক ইমোশনাল অত্যাচার তৈরি করে, ঈর্ষা আর অধিকারবোধ এসে বন্ধুত্বকে হটিয়ে অন্য কোনো সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। অস্বীকার করতে পারো সেসব? তুমি তাহলে আমাকে ভালোবাসোনি, রবিনকে ভালোবেসেছ। তাহলে কেন অভিনয় করলে আমার সঙ্গে?
তারেক চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে, ‘মনটা খুব খারাপ, দীপা।’
আহ্! তাহলে এভাবেই ঘটনার শুরু করছে তারেক। ইমোশনাল সংলাপ দিয়ে দীপাকে বিধ্বস্ত করে? তাকে অপরাধবোধের চোরাবালি ডুবিয়ে দিয়ে?
‘কেন?’ অস্ফুটে প্রশ্ন করে দীপা, ‘কিছু হয়েছে?’
মনে মনে বলে, রবিন কি তাহলে সত্যিই এসেছিল? বলে গেছে সবকিছু? বলে গেছে, তারেকের অগোচরে দীপার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা? কিন্তু সেসব তো কবেই চুকেবুকে গেছে...কবেই নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে দীপা। এত দিন পরে রবিন কেন এসব বলতে এল?
‘হুহ্! আমার পাশের রুমের আশরাফ সাহেব...অফিসেই হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক...একদম আমার চোখের সামনে জানো...ইশ্, মানুষের জীবন...’
তারেকের কথায় অনেকক্ষণ ধরে চেপে থাকা শ্বাসটা আস্তে করে ছাড়ে দীপা।
‘আহা, তাই? খুব ভালো লোক ছিল নাগো!...এই জন্যই তোমার চোখমুখটা কেমন...’
‘মানতে পারছি না দীপা, কষ্ট লাগছে!’
তারেকের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। অন্ধকার বারান্দায় নিজের চেয়ার ছেড়ে স্বামীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। তারেক হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে দীপার কোমর, মাথাটা গুঁজে দেয় ওর বুকের মধ্যে। যেকোনো সময় শৈলী চলে আসতে পারে এখানে। আসুক, বাবা-মায়ের ভালোবাসা ছেলেমেয়ের চোখে পড়লে দোষের কিছু নেই।
প্রতিদিন তারেককে পর্যবেক্ষণ করার এক নতুন চাকরি জুটেছে দীপার। তারেকের মুখ দেখে বুঝতে চায় রবিনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে কি না। যেকোনো দিন আসতে পারে রবিন। যেকোনো দিন তছনছ করে দিতে পারে সাজানো বাগান। দীপা যেন অজান্তেই নিজের জীবনে একটা টাইমবোমা বসিয়ে রেখেছে। প্রতিদিনই নতুন আশঙ্কার ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে তার মনে। যেন এ এক খেলা—অফিসফেরতা তারেকের মুখচ্ছবিতে প্রতি সন্ধ্যায় মেঘ-বৃষ্টি-বিদ্যুৎ-বজ্র-রাগ-ক্ষোভ বা অন্য কোনো অচেনা অভিব্যক্তি খুঁজে ফেরা।
রবিন কি এসেছিল? ওই সাদা-কালোটার মতো অসতর্ক মুহূর্তে খোলা জানালার ফাঁক গলে যেমন সে ঢুকে পড়েছিল একদিন। দীপা ভয় পাওয়া গলায় বলেছিল, ‘আমরা না হয় বন্ধুই থাকি, রবিন।’
‘বন্ধু? কী বলছ? আমি তো বন্ধুত্ব বুঝি না, প্রেম বুঝি প্রেম...’
দীপার চোখে তাকিয়ে বলেছিল রবিন। সঙ্গে সঙ্গে এর কোনো জবাব দিতে পারেনি দীপা। চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে ভেবেছে কিছুক্ষণ। তারপর মাথা তুলে বলেছে, ‘পাপিয়া...তোমার বউ...যদি জানতে পারে...আর তারেক...এথিক্যালি এটা কি ঠিক হচ্ছে?’
‘ওসব রাখো তো, জাস্ট এনজয় দ্য মোমেন্ট।’ এক কথায় সব উড়িয়ে দিয়েছিল রবিন।
রেস্তোরাঁর আলো-আঁধারি কোনায় বসে টেবিলের তলে পায়ে-পায়ে ছোঁয়া লাগার খেলা করার ফাঁকে রবিন বলেছিল, ‘এগুলো হচ্ছে মনের ভ্রমণ, বুঝলে; এক জায়গায় থাকতে থাকতে বড্ড একঘেয়ে লেগে যায় না? তখন মনকে ছেড়ে দিতে হয়? যতই বলো, মন হচ্ছে বহুগামী, তুমি রশি দিয়েও এরে বেঁধে রাখতে পারবা না...’
রবিন কি তাকে ভালোবাসত? কোনো দিন? ভালোবাসত কি দীপা রবিনকে? কখনো? নাকি এটা তাদের সময় কাটানোর খেলা ছিল? ছিল অস্থির মনের সাময়িক পর্যটন-পিপাসা? শৈলীর প্রশ্নটা মনে পড়ে, একসঙ্গে কি দুজনকে ভালোবাসা যায়? মন কি কুমড়ার ফালির মতো কেটে কেটে ভাগ করে বিলানো সম্ভব?
শৈলী বলে, ‘মা, ফিল্মটা দেখবা?...বাবাকে নিয়ে দেখো।’
‘নাহ্ তোর বাবা হিন্দি বোঝে না, আমিও বুঝি না, খামোখা...’
‘মা, প্রেমে পড়লে মানুষের নাকি জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পায়, ঠিক? বাজিরাও মরে গেল শুনে মাস্তানিও বিষ খেয়ে মরল...এটা হইল?’
‘তোর মাথা থেকে এসব বের কর তো...কী এক ফিল্ম দেখছে...সারাক্ষণ ওর মধ্যেই আছে।’
মেয়েকে মৃদু শাসনের সুরে বলে দীপা। শৈলী তবু থামে না, সে মার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আচ্ছা মা, তোমাদের জেনারেশনে ছেলেমেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব হতো না, তাই না? তোমার কি কোনো ছেলে বন্ধু আছে, মা?’
‘কী যে সব প্রশ্ন করিস না, বন্ধুত্ব মানে জানিস? তোদের তো সব বিএফ আর জিএফ...’
দীপা ঠোঁট উল্টে বলে। শৈলীর মুড তখন একদম বদলে যায়, সে খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, ‘আমার কি মনে হয় জানো মা, বন্ধু হবে এ রকম, যে আসলে পাশে দাঁড়াবে, যাকে বিশ্বাস করা যাবে, ভরসা করা যাবে, যে বন্ধুর অন্য সম্পর্কে জেলাস হবে না, খবরদারি করবে না, শিকল
পরাতে চাইবে না, ধরো, আমি দড়ির ওপর হাঁটছি, যদি কখনো পা ফসকে পড়ে যাই তখন সে হবে নিচের নেট, টুপ করে ধরে ফেলবে...’
‘সে রকম বন্ধু পেয়েছিস?’ দীপা জানতে চায়।
শৈলী মুচকি হাসে। বলে, ‘খুঁজছি। তোমার সে রকম কেউ আছে, মা?’
‘কেন তোর বাবাই তো আছে...সে রকম...বন্ধু...’
‘দূর! বাবা তো তোমার হাজব্যান্ড...’
‘হুঁ, হাজব্যান্ড প্লাস বন্ধু...’
শৈলী বলে, ‘উঁহু সে রকম না, হাজব্যান্ড, প্রেমিক, ভাই—এসবের বাইরে...শুধু বন্ধু—যে এমনকি কিছুই চাইবে না, শুধু চাইবে বন্ধুর মন ভালো থাকুক...’
‘প্রথম কথা, তুমি যা বলছ, তা হলো সোনার পাথরবাটি, মানে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। চ্যালেঞ্জ! দ্বিতীয়ত, সে রকম যদি মেয়ে বন্ধু হয়, ঠিক আছে; ছেলে বন্ধু হলে তোমার হাজব্যান্ড, প্রেমিক, ভাই—কেউই তা মানবে না।’
শৈলী মাটিতে পা ঠোকে, ‘সেটাই তো সমস্যা! তবে তোমাদের যুগের...আমাদের না।’
অবাক হয়ে শৈলীকে দেখে দীপা। মনে হয়, এই কিছুদিন আগেও মেয়েটা ছিল একটা ছোট্ট তুলতুলে গোলাপি পুতুল, আধো আধো কথা বলত, অভিমানে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত, আর এখন কী পাকা পাকা কথা বলছে, কী কনফিডেন্ট! কী গোছানো কথাবার্তা!
‘...অ্যান্ড মা, সিনেমাগুলোতে যে সব শেষে বলে—দে লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার। সেটা কি ঠিক?’
‘তুই তো দেখি ফিল্মের পোকা হয়েছিস একটা।’ দীপা হাসে আর ভাবে সত্যিই যদি সিনেমার মতো ‘এবং তারা পরম সুখে, পরম ভালোবাসায় বাকি জীবন কাটাল’ হতো! তার মনে করতে ইচ্ছা হয়, এই কথা সত্য হোক। পরম সুখে পরম ভালোবাসায় সবার জীবন কাটুক। অন্তত শৈলীর জীবনটা, তার নরম মনটা যেন বন্ধু, স্বামী আর প্রেমিকের দ্বন্দ্বে রক্তাক্ত না হয়। যেন ঘরফেরতা স্বামীর মন-মেজাজের ওঠানামা তাকে পর্যবেক্ষণ করতে না হয়, যেমন দীপার এখন করতে হচ্ছে। তবে এর দায় তো তারেকের না, এই দায় হয়তো দীপা নিজেই সৃষ্টি করেছে, হয়তো নিজেই নিজেকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে সে; আর অপেক্ষা করছে কখন সেটা কার্যকর হবে, কখন আসবে রবিন? কখন তারেক জানবে সব? আর জেনে গেলে কী করবে তারেক? ত্যাগ করবে দীপাকে? ভেঙে দেবে সংসার? আচ্ছা, দিলে দেবে। কিন্তু এই যন্ত্রণাদায়ক অপেক্ষার শেষ হওয়া প্রয়োজন। যা-ই হোক কিছু একটা ঘটুক! কী ঘটবে জানে না দীপা, তবে সবকিছুর শেষ দেখতে চায় সে। বুঝতে চায়, রবিন তারেককে ঠিক কতটুকু বলেছে তাদের সম্পর্কের কথা। যে সম্পর্ক অনেক দিন ধরে মৃত, অথচ যা একসময় জীবন্ত ছিল স্পর্শে, গন্ধে আর উন্মত্ততায়।
‘রবিন কি এসেছিল?’
তারেকের হাতে চায়ের কাপটা তুলে দিয়ে খুব নিরীহ ভঙ্গিতে, যেন উত্তর না দিলেও ক্ষতি নেই—এভাবে প্রশ্ন করে দীপা। তার ভেতরে তখন প্রবল ঝড়ের তাণ্ডব; যদিও বাইরে প্রাণপণে শান্ত থাকার চেষ্টা। তারেক অন্যমনস্ক ছিল। দীপার প্রশ্ন প্রথমে শুনতে পায়নি সে। আবার জিজ্ঞেস করে, ‘কী?’
‘না, মানে, রবিন না বলেছিল আসবে...’
‘হ্যাঁ, এসেছিল তো, তোমাকে বলিনি?’ তারেক চায়ের কাপে চুমুক দেয়, ‘আজকাল কী হয়েছে বলো তো, সব ভুলে যাই।’
ভেতরের প্রচণ্ড আলোড়ন চেপে রেখে তারেকের দিকে তাকিয়ে থাকে দীপা। তারেক বলে, ‘রবিন এসে হুড়মুড় করে ঢুকল, বলল, ও কানাডার ইমিগ্রেশন পেয়েছে। পাপিয়া আর বাচ্চাদের নিয়ে চলে যাচ্ছে টরন্টো। আজকে কী বার? বুধবার না? হ্যাঁ, আজকে সকালেই তো চলে যাওয়ার কথা। এত তাড়াহুড়া করল এসে। বলল, অনেক কিছু গোছাতে হবে। আমাকে খবরটা দিয়েই চলে গেল। কেন যে বিদেশে যাচ্ছে, ঢাকায় তো ভালোই ছিল...’
তারেক আরও কী কী বলছিল তার কিছুই আর দীপা শুনতে পেল না। তার জীবনানন্দের লাইন মনে পড়ল, ‘অনেকেরই ঊর্ধ্বশ্বাসে যেতে হয়...বাকিসব মানুষেরা অন্ধকারে হেমন্তের অবিরল পাতার মতন, কোথাও নদীর পানে উড়ে যেতে চায়, অথবা মাটির দিকে—পৃথিবীর কোনো পুনঃপ্রবাহের বীজের ভেতর মিশে গিয়ে...’