হেলফায়ার: পুষ্পের হাসিবিহীন নরক

হেলফায়ার (২০২০)। লীসা গাজী। অনুবাদ: শবনম নাদিয়া। প্রকাশক: একা, অ্যান ইমপ্রিন্ট অব ওয়েস্টল্যান্ড বুকস, চেন্নাই, ভারত। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: হারশাদ মারাঠি। পৃষ্ঠা ১৯৮। বাংলাদেশে দাম: ৪৬২ টাকা।

‘হেলফায়ার’–এর প্রচ্ছদ অবলম্বনে কোলাজ

শিমুলফুলি লাল প্রচ্ছদ বইটার, নাম ‘হেলফায়ার’ (নরকবহ্নি)। বাংলায় এই উপন্যাসের নাম ছিল ‘রৌরব’। লেখক লীসা গাজী, অনুবাদক শবনম নাদিয়া। কেন যেন আমার এই ইংরেজি নরকবহ্নির চেয়ে অনেক প্রিয় ছিল ‘রৌরব’ নামটা। বলেছিলাম বইয়ের লেখককে। কেননা, বাংলায় তো নরকের প্রকরণ আছে, পুত্রহীনের গন্তব্য ‘পুন্নাম’ (এই নামে আমি একটা গল্প লিখেছিলাম অমল কৈশোরে), ভ্রূণহন্তা-ব্রাহ্মণঘাতী-স্ত্রীঘাতীর গন্তব্য ‘রৌরব’। শরীর যখন মৃত্যুর পর সূক্ষ্ম শরীর লাভ করে, তখন সেই রৌরব নরকের রুরু দানব পাপীর সূক্ষ্ম শরীরকে অবিরাম শাস্তি দেয়। কে কাকে হত্যা করে ‘হেলফায়ার’–এর এই নরকে? ভ্রূণকে, নাকি ভ্রূণের সম্ভাবনাকে? মাকে মেয়েরা, নাকি মেয়েদের তাদের মা? নরকের বৃত্তান্ত জেনেবুঝে যদিচ আপনি উপন্যাসটি হাতে নেবেন, শেষ করে দেখবেন, ওই নাম যেন বাবুইয়ের বাসার দ্বিতীয় দরজা, হাতির চিবোনোর দাঁতের ওপরকার দেখানিয়া দাঁত...পাঠককে ধাঁধায় ফেলে দেয় ওই ‘রৌরব’ নাম, ছল করে নিয়ে যায় এমন পথে, যেখান থেকে গন্তব্য দেখা যায় না।
‘হেলফায়ার’–এর অগ্নির ইন্ধন শুরু হয় প্রথমত লাভলীর চল্লিশ বছর বয়সে, যে জন্মদিনে সে জীবনে প্রথমবারের মতো একা একা গাউছিয়া যাওয়ার অধিকার অর্জন করে। আর বাংলায় ‘রৌরব’–এর শুরু একটি পঙ্‌ক্তি দিয়ে—‘আর হবে না মানব জনম/ কুটলে মাথা পাষাণে’। হাহাকারময় একটি লাইন। লালন যে মানবজনম নিয়ে বলছেন—‘মন যা করো, ত্বরায় করো এই ভবে’, রজনীকান্ত বলছেন—বিজ্ঞানের বলে কুমড়োমাপের পান্তুয়া হবে, তালের সাইজের ছানাবড়া হবে, কিছুই অসম্ভব হবে না...কিন্তু ‘শুধু এই খেদ, কান্ত আগে মরে যাবে/ আর হবে না মানব জন্ম’। কার যেন মানবজনম বয়ে গেল নেপথ্যে, কিন্তু সে সেদিকে তাকাল কই! ডালবাটা মুখে মেখে ঝুরঝুরে করে শুকিয়ে ত্বকের যত্ন নিল, এক শ এক শ দুই শ বার করে সিঁথির দুধারের চুল আঁচড়াল...আর কোনো অভাবিত সৌভাগ্যে নিজের চল্লিশ বছর বয়স হওয়ার দিনে গাউছিয়া মার্কেটে একা একা যাওয়ার শুভ অবকাশে উদ্বেল হলো। মেয়েমানুষ থেঁতলানো ভিড়ের হট্টমেলা যে গাউছিয়া, জন্মদিন উদযাপনের সবচেয়ে অনুপযুক্ত স্থান যে গাউছিয়া। জীবনে প্রথম।

চল্লিশ বছর বয়স নাগাদ বৃহত্তরতে পা রাখে মানুষ, গানের ফাইনাল কোরাসে যেমন কি চেঞ্জ করে উত্তাল হয়ে ওঠে সুর। ‘হেলফায়ার’–এর মলাটেই স্মরণ করিয়ে দেওয়া আছে চল্লিশের মরতবা—আমাদের পয়গম্বরের কাছে ওহি এসেছিল চল্লিশে। কিন্তু তার আগে তো মরজগতের মানুষ কত কী করে, পৃথিবী দেখে, পৃথিবীতে আপন পরিসর জানে, ভালোবাসা খোঁজে কিংবা ভালোবাসাই তাকে খুঁজে নেয়, সে খায়-মাখে-মুঠি উঠিয়ে দাবি জানায়, জন্ম দেয়-ঘর বাঁধে-ভাঙে। তবে কি লাভলী ওই সব মরমানুষের যা যা করণীয়, তা সেরে এই বয়সে আসেনি? নইলে ঢাকা শহরে বছর চল্লিশেকের কোনো মেয়ে তার চল্লিশে পা দেওয়ার দিনেই জীবনে প্রথম একা বের হয়? এর উত্তর লেখক দেন না। হাতের তাসটি দক্ষ হাতে লুকিয়ে খেলেন তিনি। বাড়ি বাড়ি হারানো বিড়াল খুঁজতে যাওয়া একটা লোকের স্বাভাবিকতম রুটিন দিয়ে যেমন করে ‘ওয়াইন্ড আপ বার্ড ক্রনিকল’–এর শুরু, তেমন নিরীহভাবেই ‘হেলফায়ার’-এর আখ্যান শুরু, এক সকালে সিএনজিতে চেপে একটা মেয়ে গাউছিয়া চলেছে।

ঝনরা-সাবঝনরা বিচার করতে গেলে এই উপন্যাস কোন ক্যাটাগরিতে পড়বে? থ্রিলারের মতো টানটান উত্তেজক কলম লীসার, ফ্যান্টাসির দিকে টান, কিন্তু গল্পের ভেতর জীবনের চেনাজানা টুকরোগুলোর মুখোমুখি হতে গিয়ে পাঠক দেখে সে হররে প্রবেশ করেছে—শিশু–কিশোরের মনোদৈহিক ভয়াবহ নির্যাতন আছে, কাজের ছেলেটিও হররের সেই ‘ক্রিপি কিড’মার্কা, সাধারণের আবর্তে একটি অস্বাভাবিক কাহিনি চুপটি করে বসে আছে। ক্রাইমও আছে ‘মিষ্টান্ন মিতরে জনা’র মতো করে। মার্গারিট অ্যাটউড এক সভায় পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘খুনটুন দেখাতে হলে প্রথমেই একটু দেখিয়ে দিও, পাঠককে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিও না’, সে কথা লীসা শোনেননি, নিজের মতো করে বইতে দিয়েছেন ঘটনাপ্রবাহকে।

গোত্রবিচার করতে গিয়ে ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’-এর নাম আপনার–আমার বন্ধুদের মতো আমিও জোকার দিয়ে উঠতাম, যদি না মনে পড়ত, লাভলীর এই শহরে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত আমাদের কারও কারও আম্মা কোথাও যেতে দেয়নি একা একা, বন্ধুর বাড়িতেও কোনো এক বিচিত্র কারণে একই ঘরে বসে থাকত। যদি না মনে পড়ত, এসএসসি পরীক্ষার পরে সেজ চাচার হাতে–পায়ে ধরে একবার খুব সাহস করে রমনা পার্ক দেখতে গেছিলাম, বিশাল গেটটার সামনে অব্দি গেছিলাম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ঠিক কেমন হয় উদ্যান। বাড়ি ফিরে লেখার খাতায় রোমাঞ্চিত হরফে লিখেছিলাম—‘উদ্যান-বিহনে কার পুরে মনোরথ’ (মূল লাইন—‘উদ্যম বিহনে কার পুরে মনোরথ’, সে আমি জানতাম কিন্তু।) অতএব যা একজনের কাছে জাদুবাস্তব, তা অন্যের জন্য নেহাত বাস্তবতা। সেই চৌদ্দ বছর বয়সে চুরি করে ছাদে যাওয়ার পর থেকে ‘হেলফায়ার’-এর মেয়েদের জীবন কত পাল্টে গেল, মণিপুরিপাড়ার বাড়ি তৈরি হলো, বাড়ি তৈরি না হওয়া অব্দি ওদের দুই বোনের কঠিন অবরুদ্ধ দশা। প্রথম দিকে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বাইরে গেলে মেয়েদের বুয়াসহ তালা মেরে যেতেন, কিন্তু তবু দুজনের কেউই শান্তি পেতেন না, কখনো অর্ধেক গিয়ে ফিরে আসতেন, আবার কখনোবা গেলেও ফিরে না আসা পর্যন্ত অস্থির বোধ করতেন। ওই মনোরথ পূরিত না হওয়া কিশোরী, ওই বাপের হিন্দি গান শুনে শামসাদ-সুরাইয়া-রফি শুনে মুখস্থ হয়ে যাওয়া যুবতী তো আমার খুব চেনা। অতএব আমি কুলকুল করে হাসতে হাসতে লেখককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তন্ত্রসাধনা টাইপ জিনিস না করলে, ডাইনিবিদ্যা না জানলে তুমি এই সব কী করে জানো!’ এই জাদু-শহরে কত জাদুবাস্তব যে নির্জলা বাস্তব, মেয়েরা খুব জানে। জানে গার্হস্থ্য-দাম্পত্য-অপত্যের ভেতর যত হরর লুকিয়ে থাকে, সেই সব কটির ফরেনসিক ডিটেইল।

এ কাহিনির নিউক্লিয়াসে আছে মা, সংসারযোগী মা, আর আছে তার নিজ হাতে বিরচিত মাতৃকা, সেখানে সব রুটিন প্রাকৃতিক নিয়মের মতো অমোঘ। ক্রমাগত বাড়িবদল করে চলা মা, বাইরে গিয়ে উৎকণ্ঠায় কাঁচাবাজার সারতে না পারা মা, কাজের মেয়ে নাকি কাজের ছেলে, কী রাখা হবে এবং কোন বয়স পর্যন্ত...ক্রমাগত সেই হিসাব করা মা, স্কুলগেটে অতন্দ্র প্রহরী মা, ‘বাগাড় দিবার সময় আমারে ডাক দিবা বুয়া’ মা, সন্তানের জন্মদিনে নিখুঁত করে ইলিশ পোলাও আর হাঁসের মাংস রাঁধা মা। আপাতভাবে, ভারি প্রকাশ্য ভারি প্রেডিক্টেবল এই ‘হেলফায়ার’–এর জগৎ, একেবারে ‘মধ্যবিত্ত জীবনের সার্থক রূপকার’ লেখকেরা যেমন চিত্র আঁকতেন, তেমন করেই গড়া লাভলীর পারিবারিক পরিমণ্ডল, লাভলী আর বিউটিকে নিয়ে তাদের মা ফরিদা খানমের বুনে রাখা সংসার, সেই সংসারের পাকঘরে আবর্তন ভুলে যাওয়া ফ্যান, গুঁড়াসাবানে ভিজিয়ে রাখা কাপড়, কোণ মুড়ে রাখা জায়নামাজ।

লীসা গাজী। ছবি: সংগৃহীত

আখ্যানের বাকিদের কথা যদি বলেন, তবে চাঁদনি চকের দোকানদার ঠিক যেমনটি হয়, তেমনটিই। সিএনজিওয়ালা ঠিক যেভাবে কথা বলে আর যা বলে, একেবারে তেমন। রমনার পানিবেচুনি মেয়েটিও তাই। একই কথা প্রতিদিন বলার পরও কাজের ধরনে কোনো ফারাক না হওয়া বুয়া বড় জীবন্ত, ওই যে কাজের ছেলে পিচ্চির বিরুদ্ধে বুয়ার নালিশ, ‘পিচ্চি আইজ কুনু কাম করে নাই কইলাম। সারা দিন খালুজানের ধারে।’...যেন একটি কেন্দ্রীয় অস্বাভাবিকতাকে আবর্তন করে আর সবকিছু অত্যন্ত স্বাভাবিক, স্ত্রীর জন্য রাতে বিছানায় শ্বাসরুদ্ধ অপেক্ষায় থাকা মানুষটিও একেবারে উৎকট রকমের স্বাভাবিক।

লাভলী-বিউটি-ফরিদা খানমের এই আখ্যান রূপক হয়ে উঠল কি না, তা বিচার করতে গেলে দেখা যায়, এক আশ্চর্য অ্যালিয়েনেশন ছড়িয়ে আছে উপন্যাসে। যেন এর চরিত্রেরা স্পটলাইট ফেলে পারিপার্শ্বিক থেকে আলাদা করে দেওয়া মানুষ, কোলাহলময় শহর এই আখ্যানে আছে, কিন্তু সেই অবিরাম বকবকিয়ে চলা শহর নেপথ্যে। যেন ‘আপামর বিচ্ছিন্নতা’ আমাদের শহরে ‘নিও নরম্যাল’ হয়েছে। মানুষগুলোর সঙ্গে অপরাপর মানুষের যোগাযোগ এবং আত্মীয়তার কথা শোনা যায়, জানা যায় তাদের দেখাসাক্ষাৎ হয়, কিন্তু তাতে পাদপ্রদীপের আলোর আশপাশের ঘনিয়ে ওঠা তমিস্রা কাটে কই (মনে পড়ে গেল, তমিস্রাও একটি নরকের নাম)! মা যেমন করে মেয়েদের সঙ্গে সমাজের আধারাধেয় সম্পর্ক নস্যাৎ করে দিয়েছে, ঠিক তেমনি করে ক্যারেক্টারাইজেশনের সময় লেখকও চরিত্রগুলোকে একরকম পাত্রবিহীন আধেয়ের মতো করে তুলেছেন। একরকম উৎকর্ণ মনোযোগে একেকটি চরিত্র তাদের সংলাপ বলে চলেছে, যে সংলাপগুলোর কাজ প্রধানত একটা মিটিমিটি আলোর আবহ নির্মাণ। কনরাড ওঁর ‘হার্ট অব ডার্কনেস’-এ বলেছিলেন, ‘উই লিভ ইন আ ফ্লিকার’, একেকটি ছোট ছোট ফুলকির আলোয় বদলে যেতে থাকে দেখে রাখা সমাজ, চিনে রাখা পরিবার। সংলাপহীন মনোলগ এবং ননভার্বাল কমিউনিকেশন ছড়িয়ে আছে পুরো ‘হেলফায়ার’–এ।

প্রধান চরিত্র লাভলী, পড়ার সময় তাকে ভাবতে গিয়ে আমার এমিলি ডিকিনসনের ‘মাই লাইফ হ্যাড স্টুড আ লোডেড গান’–এর শুরুটা মনে পড়ে। সন্ধ্যায় খোঁয়াড়ে ফিরে আসা হাঁসের মতন নধর আর নিয়মে বাঁধা দুই বোনের একজন, যে দুই বোন আশৈশব গৃহবন্দী, প্রাইভেটে ইন্টারমিডিয়েট দেওয়ার জন্য কাপাসিয়ার একটা কলেজে তারা নামেমাত্র ভর্তি হয়ে থাকে। সমাজে যেমন ভাঙা-গড়ার খেলা আছে, লাভলী-বিউটি দুই বোনের ভেতরেও আছে কিছু সাংকেতিক খেলা, নির্দোষ সাপলুডুর আড়ালে সেই সব ভয়ানক খেলা তারা বারবার খেলে বা খেলবে বলে সংকল্পবদ্ধ হয়। লাভলীদের পরিবার একটি নিবৃত্তিধর্মী পরিবার, যেখানে প্রায় হারেমের মতো নিশ্ছিদ্র সংরক্ষণপ্রণালিতে দুটি মেয়ে বেড়ে ওঠে, তুষ্টিহীন। এই বাড়িতে অর্থহীন বিয়ের কারাগার থেকে বের হতে না পারা মানুষ আছে, সারা জীবনের জন্য সামাজিক বিচ্যুতির কারাগারে আটক মানুষ আছে, আছে সাইকোলজিক্যাল হররের মূল মানব-দানো, যে অন্যকে আটকে রেখে নিজের বন্দিত্বকে ভুলে থাকে।

লাভলী নিউরোটিক ও সাইকোটিক, নিউরোটিকের মতো সে অবদমন করে এবং অসুখী হতে থাকে, সাইকোটিকের মতো সে আপনার জগৎকে পুনর্নির্মাণ করতে থাকে, যেখানে সে কেন্দ্রীয় চরিত্র আর তাকে ঘিরেই তার অবসেশন আবর্তিত। সে কি আসলে সিজোফ্রেনিয়াক? তার কানে একটা অদৃশ্য লোক বারবার মন্ত্রণা দেয়—বুড়িগঙ্গার পাড়ে, রমনা পার্কে কিংবা নিউমার্কেটে হাওয়া খেয়ে আসার জন্য। ওরা এত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, যে লাভলী ফ্ল্যাশব্যাকে কিছু হড়বড়িয়ে দেখতে গেলে তার মাথার ভেতরের লোকটার মোশন-সিকনেস শুরু হয়। কেমন করে যেন লাভলী নিজের শরীরে হাত দিয়ে সেই লোকটার আওয়াজ খোঁজে! কিন্তু লেখক যেন রাজমিস্ত্রির পাশের রাজমজুরটির মতো শুধু মালমসলা এগিয়ে দেন, ইনটেনশনালি কিছু বলেন না, এ আদৌ রোগ কি না, নাকি আরও বৃহত্তর কোনো রোগের লক্ষণ। লাভলী যে চাওয়া–পাওয়ায় বিভাজ্য হয়ে দুই ভাগ হয়ে বাইপোলার হয়ে কিংবা সিজোফ্রেনিয়াক হয়ে বেঁচে থাকছে, সেটার অনেক রকম নিশানা আছে কিন্তু ব্যাখ্যা নেই। লক্ষ করে দেখলে লাভলীর মাথার ভেতর কথা বলতে থাকা লোকটা পুরুষ। কেন? সহচরের তৃষ্ণা (নিউমার্কেটে ক্রোকারিজের দোকানে দাঁড়িয়ে লাভলী কল্পিত স্বামীর সঙ্গে সাংসারিক আলাপ করে, সেই একই টোনে লাভলী মাথার ভেতরের লোকটাকে তুমি তুমি করে বলে)? অবদমিত কাম (বয়সে ছোট খালাতো ভাইয়ের জন্য সেই যে অসম্ভব তৃষ্ণা)? নাকি যে পুরুষতন্ত্র রক্তে রক্তে মিশে যায়, তার সাইকোটিক স্বর লাভলীর মগজে সেঁধিয়ে গেছে আর বের হয়নি?

লেখক লীসা গাজী চলচ্চিত্রকার লীসা গাজী অনেক জায়গায় একাকার। ওই যে পার্কের লোকটার রুমাল নরম আলোয় সাদা হয়ে জ্বলে ওঠাটা। কিংবা লাভলী শেষবার খাবার টেবিলে বসছে, ওর চারপাশ দিয়ে শাঁই শাঁই করে দৃশ্য আবর্তিত হচ্ছে, যেন এমন বোধ করছে, দুপুরে রমনা পার্ক জয় করতে থাকা লাভলীকে অভিবাদন জানিয়েছিল দুপাশের বিশাল বিশাল আকাশ-কাতুরে গাছগুলোর ছায়া, এখন সবকিছু ছায়ার আকার নিয়ে সরে সরে যাচ্ছে। উপমাগুলো যেন সিম্বলিক শট, ‘ঢাকনা দেওয়া ফুটন্ত পানির মতো সারা শরীরে হাসির দমক নিয়ে ওরা ছাদে উঠে গেল, শব্দহীন’, কিংবা ‘আলো–ঝলমল দোকানগুলোর সামনে দিয়ে কবুতরের মতো’ ঘুরে বেড়ানো লাভলী। তার চেয়ে বয়সে ছোট আর পরিপাটি বোন বিউটির জন্ম লাভলীর চোখে কেমন ছিল? ‘সকালবেলা পর্দা টানা অন্ধকার ঘরে হঠাৎ রোদের আলো যেমন বেআরাম, তেমন’ ফরসা। নববিবাহিতা-সালংকারা ফরিদা ঘরে ঢুকছেন যেন ‘অর্কেস্ট্রা সাথে নিয়ে’, নানান গয়নার শব্দ হচ্ছে। কিংবা ফরিদা খানমের রাগটা যেন গন্ডারের শিঙের মতন কপালের মাঝখান ফুঁড়ে বের হয়ে আসছে। ফরিদার সঙ্গে ছাদের সেই কাকের দৃশ্যটিও গভীরভাবে প্রতীকী, কাকটা যেন ভিনসেন্টের সেই গমখেত থেকে উড়ে এসেছে। বাংলায় টনটনে উত্তেজক গদ্য লিখতে গেলে হুমায়ূন আহমেদকে অগ্রাহ্য করা মুশকিল, যদিও ওঁর নাটকের স্টাইলে আমরা বাস্তবে কথা বলি না, তবু লীসার আখ্যানের সত্যঘনিষ্ঠ চিত্রণগুলোতে ওঁর ছায়া কোথাও কোথাও প্রবলভাবে উপস্থিত। তবে লীসা আপন মহিমায় ভাস্বর তাঁর ডিটেইলে, মায়া–মমতার গদের আঠাহীন নির্বিকার ভঙ্গিতে তিনি লিখে যান, এঁকে যান কিউবিস্টের মতো করে একই মুখে দুই রকম মুখ, তাঁর কলমের চাপে এমনকি পাপবোধও এক কাঁধ থেকে আরেক কাঁধে স্থানান্তরিত হয়।

উপন্যাসটি অত্যন্ত ডার্ক, সবচেয়ে ডার্ক তার শেষাংশ। কিন্তু এরপরও প্রশ্ন থেকে যায়। এমন একটি পরিণতির দিকে কি লাভলী যাচ্ছিলই? নিজের মুক্তির জন্য যাচ্ছিল, নাকি প্রবল পরাক্রান্ত মায়ের বিরুদ্ধাচরণ (বিউটির ও লাভলীর নিজের) তার পৃথিবীকে ধসিয়ে দিচ্ছিল বলে সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নিল? মা কি তার জগতে তার অবচেতনে নরম্যান বেটসের (‘সাইকো’) সেই মা, যাকে মেরে ফেলার স্বপ্ন দেখলেও অস্বীকার করা যায় না? কখন যেন এই আখ্যান ব্যক্তির ট্র্যাজেডি থেকে উত্তীর্ণ হয়ে সামষ্টিক ট্র্যাজেডির দিকে ইঙ্গিত করে, দেখিয়ে দেয় সমাজের হাতে বিবাহবন্দী-শাসনবন্দী-ধর্মীয় অনুশাসনবন্দী মানুষের নিগ্রহকে, দেখিয়ে দেয় সামাজিক অচলায়তন আর মানুষের লোহার জুতো পরানো বিকৃত মনকে, দেখায় কুৎসিত সেলিব্রেশন, আর দেখায় পরাস্ত না হওয়া মানুষের হৃদয়ে ঘৃণার প্রজ্বলিত কুশপুত্তলিকা। কিন্তু যখন দেখায়, তখন আঙুল দিয়ে দেখায় না, চকখড়ি দিয়ে চক্রপ্রবাহ এঁকে দেখায় না, দেখায় একটা স্ফটিকের ভেতর দিয়ে—সেখানে অনেক রং আর রশ্মি প্রতিসরিত হয়, অনেক সবিশেষ রূপ দর্শকের অন্তরই পরিগ্রহ করে আবার অনেক কিছু অবচেতন অস্বীকার করে।

‘হেলফায়ার’ অনূদিত উপন্যাস, অনুবাদে শবনম নাদিয়া পরিশ্রমী এবং আন্তরিক, এক ভাষা থেকে অপর ভাষায় স্থানান্তরের সময় তিনি অত্যন্ত প্রয়াসসাধ্য একটি কাজ করেন, ভাষাটিকে ভাস্বর রাখেন, বাংলাতে অন্য ভাষার জন্য প্রায় অগম্য যেসব ল্যাবিরিন্থ রয়েছে, সেখানেও আলো হাতে করে চলে যান। বাংলা ভাষার ‘রৌরব’ ইংরেজি ‘হেলফায়ার’ হয়ে পৃথিবীর অসংখ্য পাঠককে স্পর্শ করুক। অগ্নিস্নানে ধরা শুচি হওয়ার আশাটা যদিও বড় বেশি গত শতাব্দীর, তবু তো ‘ওরে, আগুন আমার ভাই, আমি তোমারি জয় গাই।’

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]