'জীবন জীবিত থাকে আর মৃত্যু মারা যায়'

সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে এই কথাবার্তা আজ থেকে দুই বছর আগের। তখন তাঁর স্মৃতি কাজ করে না আগের মতো। তবুও স্মৃতির কাছেই ফিরে যান বারবার। টুকরো টুকরো কথার ভেতর দিয়ে এ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে ইতিহাস, দর্শন ও তাঁর শেষ জীবনের নানা তরঙ্গ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শ্যামল চন্দ্র নাথ

সরদার ফজলুল করিম, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
সরদার ফজলুল করিম, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনি জন্মেছিলেন ১৯২৫ সালের ১ মে। পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ জীবন। যদি প্রশ্ন করি, কেমন কাটালেন এ জীবন, কী বলবেন? 
সরদার ফজলুল করিম: জীবনভর সবাই ভালোবেসেছে আমাকে। কেন এত ভালোবাসা পেলাম, তাও জানি না। কেন আমাকে এত ভালোবাসে সবাই? দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে আজ বলতে ইচ্ছে করে, সুখে-দুঃখে যেভাবে কাটল জীবন, ভালোভাবেই তো কাটালাম। 
শ্যামল: জন্মদিন নিয়ে আপনার ভাবনা কেমন? 
সরদার: দেখুন, জন্মদিন নিয়ে কখনো আমার মধ্যে তেমন কোনো ভাবনা কাজ করে না। আর আমি যখন জন্মেছিলাম, তখন এখনকার মতো জন্মদিন পালনের চল ছিল না। তবে আমি মনে করি, আমার মৃত্যুদিনই হবে আমার জন্মদিন। কারণ, সেই দিন সবাই দেখতে আসবে আমাকে। আমার সব কাজ নিয়ে আলোচনা হবে। হয়তো হবে সমালোচনাও। আসলে বিষয়টা কী জানেন, একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পরই তার পুরো অবয়বটা দেখতে পাই আমরা। ভালো-মন্দ সব মিলিয়েই দেখতে পাই। আমি কোনো বড় মানুষ নই, বড়সড় পণ্ডিত নই, নামজাদা অধ্যাপকও নই। আসলে আমি কিছুই না। কিছু জানি না—তেমনভাবে এখনো কিছুই শিখতে পারিনি। কিন্তু বরাবরই আমি জীবনের পক্ষে—জীবনকে দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দিলাম জীবন। 
শ্যামল: জীবন সম্পর্কে আপনার ধারণা কিংবা দর্শন কী? 
সরদার: জীবন বোঝার সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখো, নিজের মতো করে জীবনটা যাপন করো। জীবন ও মৃত্যু পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুটো শব্দ। সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডের আগ মুহূর্তে যখন তাঁকে বন্ধনমুক্ত করা হয়, সে সময় তিনি শিষ্যদের বলেছিলেন, বন্ধন না থাকলে আমি বন্ধন মুক্তির আনন্দ বুঝতে পারতাম না। জীবনকে বুঝতে হলে তাই মৃত্যুকেও বোঝার চেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।
শ্যামল: আপনার কি মনে হয় জীবনের কখনো মৃত্যু হয়? 
সরদার: জীবন কখনো মরে না। একটা জীবন যখন মৃত্যুর মুখ থেকে উঠে আসে, সে আনন্দ ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। আমার সে অভিজ্ঞতা আছে। জীবনের অর্থই জীবন। জীবন জীবিত থাকে আর মৃত্যু মারা যায়—এ রকম ভাবনা নিয়েই বেঁচে আছি আমি।
শ্যামল: বরিশালের আঁটিপাড়া গ্রামের এক কৃষক পরিবারে আপনার জন্ম। কৃষিকাজে বাবাকে আপনি সাহাঘ্য করতেন। সেই সময়ের কথা, শৈশবের কথা কি মনে পড়ে? 
সরদার: ব্যাপারটা তো সবাই জানে—এখন আমার স্মৃতি সেভাবে কাজ করে না, অনেক কিছুই ভুলে গেছি। মনে পড়ে না। তবে হ্যাঁ, কৃষক পরিবারের ছেলে আমি। আমাদের পরিবারকে মধ্যবিত্ত বলা চলে না। নিম্নমধ্যবিত্ত বললে ঠিক আছে। ছেলেবেলায় বাবা আমাকে প্রায়ই বলতেন, ‘তুই লাঙলটা ধর; কখনো বা বলতেন, মইয়ে একটু ওঠ, আমি একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।’ তখন বাবাকে কৃষিকাজে সাহায্য করেছি। আমার মা-বাবা ছিলেন নিরক্ষর, কিন্তু একেবারে মাটির মানুষ ছিলেন। তাঁদের মতো লোকের কথা ছিল না আমাকে স্কুলে পাঠানোর। তবে আমাকে তাঁরা স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। শিক্ষকেরা খুব যত্ন করে পড়িয়েছেন আমাদের। এই মানুষগুলোর কাছে আমি বড় ঋণী; আরেকটা কথা বলি, এ দেশের মাটির প্রতি আমার মনের মধ্যে একটা ভক্তি জেগে আছে। 

শ্যামল: আপনার স্মৃতিচারণা থেকে জেনেছি, আপনার বন্ধু মোজাম্মেল হক, যিনি আপনাকে শরৎচন্দ্রের পথের দাবী উপন্যাসটি পড়তে দিয়েছিলেন, যাঁর হাতে বামপন্থী রাজনীতিতে আপনার হাতেখড়ি; তাঁর সম্পর্কে কোনো কিছু কি মনে আছে?
সরদার: না, তেমনভাবে কোনো স্মৃতি এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে এটুকু মনে অছে, মোজাম্মেল আমাকে একটি বই দিয়ে বলেছিল, ‘এই বইটি তুমি নাও। এক রাতের মধ্যে পড়ে শেষ করতে হবে। তবে বইটি কেউ যেন না দেখে।’ সাধারণত বইয়ের ওপরের দিকে লেখা থাকে বইয়ের নাম। কিন্তু এ বইটির ওপরে নামের জায়গাটুকু কাটা ছিল। এ বইটিই কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথের দাবী। বড় সাংঘাতিক বই। এ বই সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি বলেছিলেন, ‘এটা কি একটা উপন্যাস হলো?’ শরৎচন্দ্র জবাব দিয়েছিলেন, ‘যা হয়েছে তা তো হয়েছে।’ যখন বইটি প্রথম পড়েছিলাম তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি।
শ্যামল: ’৪০ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন আপনি। বরিশাল থেকে এরপর ইন্টারমিডিয়েট পড়তে এলেন ঢাকায়। সেই সময়ের কথা মনে আছে?
সরদার: হ্যাঁ, ম্যাট্রিক পরীক্ষায় জেলাভিত্তিক স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। তখন তো ভর্তির ব্যাপারে কোনো কড়াকড়ি ছিল না। তবে কড়াকড়ি না থাকলেও আমি ছাত্র মোটামুটি ভালো ছিলাম। তো, ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলাম ঢাকায়। এ সময় আমার পেছনে একটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে যায়—জাতীয়তাবাদী গ্রুপ আর কি। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় আমি যতটা না কমিউনিস্ট, তার চেয়ে বেশি ছিলাম জাতীয়তাবাদী।
শ্যামল: ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর দর্শন বিষয়ে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৪২ সালে। যত দূর জানি, প্রথম দিকে আপনি ইংরেজি বিভাগেও পড়েছিলেন কিছুদিন। আচ্ছা, আপনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়ে ঢাকায় পড়লেন কেন?

সরদার: আমার মুরব্বি ছিলেন বড় ভাই। সে সময় তিনি ভাবলেন, তাঁর পক্ষে কলকাতায় থাকা-খাওয়াসহ আমার পড়ালেখার খরচ জোগানো কঠিন হবে, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হলাম। হ্যাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে প্রথম কিছুদিন ইংরেজি বিভাগে পড়ে ছিলাম। তখন বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের বক্তৃতা শুনতাম। দেখতাম কোন শিক্ষক কী রকম বক্তৃতা দেন। এভাবে একদিন দর্শন বিভাগের শিক্ষক হরিদাস ভট্টাচার্যে্যর বক্তৃতা শুনলাম। সেটা ছিল সাংঘাতিক বক্তৃতা। তাঁর বক্তৃতা এত ভালো লাগল—দর্শনে ভর্তি হয়ে গেলাম আমি। দর্শনের বাইরে অন্য বিভাগেও ক্লাস করতাম তখন। কবি জসীমউদ্দীন সে সময় পড়াতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেখতাম, জসীমউদ্দীন স্যারকে ছেলেরা পরিহাস করছে। তিনি ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন না। তবে এখানে একটা কথা বলি, সেকালে শিক্ষকেরা ছিলেন ছাত্র–অন্তঃপ্রাণ। ছাত্রদের কল্যাণের জন্য এমন কিছু নেই যা তাঁরা করতে পারতেন না।
শ্যামল: আপনি বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ জন্য জেল খেটেছেন। রাজনীতির জন্য বিলেতে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েও যাননি। মনে পড়ে সে সময়ের কোনো কথা?
সরদার: এসব তো সবাই জানে। কী আর বলব, অনেক কিছুই তো মনে পড়ে না এখন। বাড়ির বাইরে কোথাও বেরও হই না। যাঁরা আসেন, তাঁদের সঙ্গেই কথা হয়। তবে হ্যাঁ, বিলেত যাওয়ার সুযোগ এসেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি করার জন্য যাওয়া হলো না। আসলে বিলেত যাব, পাস করে আসব, তখন এসব নিয়ে ভাবতাম না।
শ্যামল: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে আছে?
সরদার: অনেক আগের কথা সেসব। মনে আছে আবছা আবছা। তখন আমি ঢাকায় থাকি। যুদ্ধের খবর নিয়মিত পেতাম আমরা। প্রতিদিন বিকেলের মধ্যে কলকাতা থেকে এসে পৌঁছাত খবরের কাগজ। ফলে যুদ্ধের প্রায় তাজা খবরই পেতাম। তখন এখানে দাঙ্গা হয়েছিল, কিন্তু এর বাইরে আমরাও অনেক কিছু করেছিলাম। ঢাকা কিন্তু আন্তর্জাতিক নগরে পরিণত

হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে।
শ্যামল: ১৯৪৮ সালেই তো আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান আপনি। এরপর গ্রেপ্তার হলেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর পরিবারের সঙ্গে কি যোগাযোগ ছিল আপনার?
সরদার: যখন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলাম, তখন আমি শিক্ষকতা করি। তবে নিজেকে কখনোই টিচার বা লিডার মনে করতাম না। পার্টি যখন যেভাবে বলত, সেভাবেই কাজ করতাম। এরপর পার্টির কথায় একসময় চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। সে সময় আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকাই ছিল আমার কাজ। অবস্থা এমন যে, যত দিন পুলিশের হাতে ধরা না পড়ে জীবন রক্ষা করা যায়। তবুও একসময় ধরা পড়লাম। গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমার ভাই আমাকে দেখতে আসতেন। তিনি খুব রাগ করেছিলেন। আমাকে বুঝিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেটা সম্ভব হয়নি।
শ্যামল: অনেক বছর কাটিয়েছেন জেলে। কেমন মনে হয়েছিল সে সময়?
সরদার: কেমন আর মনে হবে? আমি একটু ভাবুক টাইপের ছিলাম তো, তাই হয়তো মানিয়ে নিতে পেরেছিলাম। এ রকম না হলে জেলখানায় নিজেকে ম্যানেজ করাটা বেশ সমস্যাই হতো বলতে পারেন।
শ্যামল: মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁর কথা মনে আছে?
সরদার: মুনীর চৌধুরীকে গোঁড়া মুসলিম ছাত্ররা কমিউনিস্ট বলে মনে করত। ও ছিল খুবই সাহসী—কাউকে ভয় পেত না। মুনীর পরবর্তীকালে জেলেও গিয়েছিল। আমি একসময় মুনীর চৌধুরীর একটি নাম দিয়েছিলাম- King Of Words অর্থাৎ শব্দের রাজা।
শ্যামল: আজীবন দর্শনচর্চা করেছেন। প্লেটো, সক্রেটিস—এই গ্রিক দার্শনিকদের অনেক বিষয়-আশয় আমরা জেনেছি আপনার লেখা থেকে। এখন যদি প্লেটো-সক্রেটিস সম্পর্কে বলতে বলা হয়, তবে কী বলবেন?
সরদার: প্লেটোর মধ্যে রিয়েলিজম আছে। বাস্তবতাবোধ থেকেই নিজের মতো করে তিনি দার্শনের রাজা। দর্শন বিভাগে ভর্তি, পাঠাভ্যাস, রাজনীতি—এই সবকটিই কিন্তু আমাকে প্লেটোর মধ্যে ঢুকিয়েছে, সক্রেটিসের মধ্যে ঢুকিয়েছে।
শ্যামল: বর্তমান সময়ের বাংলাদেশ নিয়ে আপনার ভাবনা জানতে চাই।
সরদার: আমি তো এখন পুরো সময় ঘরে থাকি। কারও সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। দেশ নিয়ে কী ভাবব? মানুষ এখন মানুষকে খাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে চলছে অমানুষের রাজত্ব। তাই বলে কি আমি স্বপ্ন দেখি না? দেখি, এখনো আমি স্বপ্ন দেখি।
শ্যামল: সাম্য ও শোষণহীন সমাজের জন্য সংগ্রাম করেছেন। আজকের এই পঁুজিতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আপনার কি মনে হয় বিপ্লব আসবে?
সরদার: হ্যাঁ, বিপ্লব আসবে। আসবেই বা বলি কেন? বিপ্লব তো এসেছে। বিল্পবের মধ্যেই বাস করছি আমরা। সব মহৎ সংগ্রামের, মহৎ ঐতিহ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী হচ্ছে নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষ। তাঁরাই বিপ্লব করে এই পৃথিবীকে আমাদের বাসযোগ্য করে তুলেছে। আমি হতাশ নই।