'মানুষের ভালোবাসা যথেষ্ট পেয়েছি'

আনিসুজ্জামান, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
আনিসুজ্জামান, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

সাজ্জাদ শরিফ: আপনি লেখালিখি শুরু করেছেন কিশোর বয়স থেকে। সেখানে কি আপনার পরিবারের লেখালিখির আবহ কোনো প্রভাব রেখেছে?
আনিসুজ্জামান: কিছুটা। কলকাতায় আমরা হাতে লেখা পত্রিকা বের করব সংকল্প করেছিলাম। তার জন্য বড়দের কাছে লেখা চাইতে গেলাম। তাঁরা বললেন, তোমরা কী পত্রিকা সম্পাদনা করবে? আমরা পত্রিকা বের করি, তোমরা আমাদের সঙ্গে থাকো। নতুন দিন নামে একটি পত্রিকা বের হলো। আমরা লেখা জোগাড় করলাম।। আমাদের লিখতে বলা হলো। আমরাও লিখলাম। সেটাই লেখালিখির সূচনা। তারপর ১৯৪৮ সালে আমরা খুলনা চলে এলাম। সেখানে শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প অবলম্বনে একটি গল্প লিখলাম। খুলনায় হাতে লেখা কাগজে সেটা প্রকাশিত হলো। পরে ঢাকায় এসে সে গল্পটাই আবার নতুন করে লিখলাম। সেটি নওবাহার-এ ছাপা হলো ১৯৫০-এ। সেটাই আমার প্রথম মুদ্রিত রচনা। পরে ১৯৫৩-৫৪ সাল থেকে প্রবন্ধ লিখতে আরম্ভ করলাম। এরপর ক্রমশ সেদিকেই ঝুঁকে পড়লাম।
সাজ্জাদ: আপনার কিশোরবেলায় কি আপনাদের বাসায় কোনো পত্রপত্রিকা যেত? সেই বয়সে মূলত কী পড়েছেন আপনি?
আনিসুজ্জামান: ঘরে পত্রপত্রিকা কেনা হতো, যেমন সওগাত ও মোহাম্মদী। দৈনিক আজাদ-এর ‘মুকুলের মহফিল’ ছিল আমার প্রিয় পাতা। বাড়িতে বইপত্র কেনা হতো। আমার দাদার বই যাঁরা প্রকাশ করতেন, তাঁরা সব সময় টাকাপয়সা দিতে পারতেন না। তাই আব্বা তাঁদের প্রকাশনা থেকে বই নিয়ে আসতেন। আবার বড় বোন কবিতা লিখতেন বলে দুলাভাই তাঁকে নানা রকম বই কিনে দিতেন—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-নজরুল ইসলামের বই থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের লেখকদের বই পর্যন্ত। আবার জসীমউদ্দীন ছিলেন আব্বার বন্ধু। তিনি তাঁর বই উপহার দিয়ে যেতেন। বেনজীর আহমদ, আহসান হাবীবও বই উপহার দিতেন। আবার যখন ঢাকায় এলাম, তখন—পরে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ—আবদার রশীদের বাড়িতে বড় একটি লাইব্রেরি ছিল। আশেপাশে আরও অনেক বইপড়ুয়া ছিলেন, তাঁদের সাহচর্যে অনেক বই পড়া হতো।
সাজ্জাদ: আপনি বাংলা সাহিত্য পড়তে গেলেন কেন? আবার সাহিত্য পড়লেও আপনার গবেষণার ক্ষেত্র শুধু তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না।
আনিসুজ্জামান: অল্প বয়সে সিনেমা দেখে মনে হয়েছিল, আমি উকিল হব। পরে উকিল হওয়ার বাসনা হারিয়ে গেল। তখন থেকেই ভাবতাম, আমি সাহিত্য নিয়ে পড়ব, গবেষণা করব, সাহিত্যের শিক্ষক হব। সেভাবেই বাংলা সাহিত্য পড়া। বাংলা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, সাহিত্যকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে পড়া যাবে না। এই পটভূমিতেই ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। পরবর্তীকালে আমার সম্পাদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-এর বিষয়ে অনেকে বলেন, আমি নির্ধারিত ক্ষেত্রের বাইরে চলে গেছি। আমি তা মনে করি না। যে-সমাজ থেকে সাহিত্য তৈরি হচ্ছে, সেই একই সমাজে তো ধর্মান্দোলন হচ্ছে, অর্থনৈতিক জীবনও চালিত হচ্ছে। এগুলো অবিচ্ছেদ্যভাবে দেখার ঝোঁক আমার মধ্যে সবসময়ে কাজ করেছে।
সাজ্জাদ: আপনি লেখালিখি করেছেন, অধ্যাপনা করেছেন, গবেষণা করেছেন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। আপনি বিদ্যায়তনে ছিলেন। আবার আপনার জীবন সেটা ছাপিয়ে বেরিয়েও গিয়েছে। আপনার মধ্যে এ নিয়ে কোনো বিরোধ হয়নি?
আনিসুজ্জামান: না, বিরোধ হয়নি। কারণ, মনে হয়েছিল, নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব আমাকে পালন করতেই হবে। তবে অত্যন্ত সচেতনভাবে আমি একটার সঙ্গে আরেকটাকে জড়াইনি। শিক্ষক হিসেবে যখন আমি ক্লাসে গিয়েছি, তখন আমার কোন ছাত্রের কী রাজনৈতিক মত সেটা জানতে চাইনি, সেটা আমাকে কখনো পীড়িতও করেনি। ক্লাসে কখনো রাজনীতির কথা বলিনি। তবে ক্লাসের বাইরে নানা সভা-সমিতিতে বলেছি, এখনো বলছি। কাজেই শিক্ষক হিসেবে একটা নৈর্ব্যক্তিকতা আমার ছিল। নিশ্চয় এর একটা গুরুত্ব আছে। ছাত্ররা আমাকে ভালোবেসেছে, কিছুটা শ্রদ্ধা করেছে। কারণ তারা জেনেছে, আমার রাজনৈতিক মত থাকা সত্ত্বেও সেটাকে আমি কখনো শিক্ষকতায় প্রশ্রয় দিইনি।
সাজ্জাদ: আপনার কোনো কোনো লেখা পড়লে মনে হয় আরও বহু ক্ষেত্র আপনার মনোযোগ পেলে আমাদের অ্যাকাডেমি তার সুফল পেত। আপনার কি মনে হয় না অ্যাকাডেমিকে বা লেখালিখিকে আরেকটু বেশি সময় দিলে আপনার সময় একটু বাড়তি মূল্য পেত?
আনিসুজ্জামান: সেটা আমার প্রায়ই মনে হয়েছে। বন্ধুবান্ধব বা শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকে বলেছেন, তুমি এত কিছু না করে লেখাপড়ার জগতে থাকলে পারতে। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, আপনি তো লেখাপড়া করলেন না। এটা আমার ঠিকই মনে হয়েছে। কিন্তু তখন আমার এও মনে হয়েছে যে, এক জীবনে আমার পক্ষে একটা জায়গায় স্থির থাকা সম্ভব ছিল না। কাজেই নিশ্চয় ক্ষতি অনেকটা হয়েছে। আমার জীবন যে তিনটা ভাগে বিভক্ত, তার সবগুলোরই কিছু পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে। তবে এটা অবশ্যই মানব, বেশি ক্ষতি হয়েছে লেখালিখির।
সাজ্জাদ: কিন্তু আবার এটাও তো মনে হয় সত্য যে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে আপনি অন্য কাজের চেয়ে বেশি আনন্দ পান?
আনিসুজ্জামান: আনন্দের চেয়ে বড় ব্যাপার হলো তৃপ্তি। আনন্দ তো আমি লেখালিখিতেই বেশি পাই। কিন্তু ওসব আন্দোলনে গেলে আমার মধ্যে এই তৃপ্তি কাজ করে যে, আমি আমার কর্তব্য পালন করছি। তখন আমার মনে হয়, এতে যদি আমার লেখালিখির ক্ষতিও হয়ে থাকে, তাতে দুঃখ করার কিছু নেই।
সাজ্জাদ: শিক্ষকতা, লেখালিখি, আন্দোলন—এই তিনটির মধ্যে কোনটিতে তাহলে আপনি বেশি আনন্দ পেয়েছেন?
আনিসুজ্জামান: আমার মনে হয়, শিক্ষকতাতেই বেশি আনন্দ পেয়েছি। আবার অন্যদিক থেকে ভাবলে সামাজিক কাজকর্মের জন্য তো মানুষের ভালোবাসাও যথেষ্ট পেয়েছি।