ফুটবলের কবি এদুয়ার্দো গালিয়ানো

ফুটবল খেলাটা আসলে কী? কেন এই খেলা বিশ্বজুড়ে এত জনপ্রিয়? গোলের উন্মাদনায় কেন মেতে ওঠে গোটা দুনিয়া? কীভাবে এই খেলা পৃথিবীকে বদলে দিল? ফুটবলের সার্থক কবি এদুয়ার্দো গালিয়ানো বিখ্যাত বই সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো এসব প্রশ্নে সরল উত্তর রয়েছে। ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন গালিয়ানো। তাঁর মৃত্যুদিনে সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো বাংলা অনুবাদ ফুটবল: ইতিহাসের খণ্ডচিত্র থেকে কিছু চম্বুক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে দেওয়া হলো।

এদুয়ার্দো গালিয়ানো ( ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪০– ১৩ এপ্রিল ২০১৫) এক নম্বর ছবি থেকে নিয়ে নিনি।
ছবি: সংগৃহীত

ফুটবল প্রাণের সঞ্চার করে। নিবিড় আনন্দ জাগিয়ে তোলে। ফুটবল হচ্ছে ভালোবাসা, কবিতা। এটাই ফুটবলের সবচেয়ে বড় শক্তি। ফুটবল নামের এই কবিতার এযাবত্কালের সবচেয়ে সার্থক কবির নাম এদুয়ার্দো গালিয়ানো। লেখক, সাংবাদিক, বিপ্লবী, ফুটবলপ্রেমী। উরুগুয়ের এই মানুষটার লেখায় পাওয়া যায় লাতিন সৌন্দর্য আর উষ্ণদেশীয় মানুষের তীব্র আবেগ। তিনি ফুটবলকে আত্মা দিয়ে উপভোগ করেন। আর সেই উপভোগের বিবরণ তিনি লিখে ফেলেন তাঁর সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো নামক বইটিতে। ফুটবল: ইতিহাসের খণ্ডচিত্র নামে বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন সৈয়দ ফয়েজ আহমেদ।

ফুটবল

ফুটবল খেলার ইতিহাস হচ্ছে নন্দন থেকে বন্ধনের এক বিষাদযাত্রা। যখনই খেলাটি পরিণত হলো ইন্ডাস্ট্রি তথা শ্রমশিল্পে, তখনই খেলার আনন্দ থেকে যে সৌন্দর্য ফুটে ওঠে, একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলা হয় তা। আমাদের এই আধুনিক যুগে, যা কিছু অপ্রয়োজনীয়, তাকেই খারিজ করে দেয় পেশাদার ফুটবল। আর অপ্রয়োজনীয়ের সংজ্ঞা তো আমরা জানিই—যা কিছু থেকে টাকাপয়সা কামানো যায় না।

কোনো এক পাগলাটে মুহূর্তে একজন বয়স্ক মানুষ যখন শিশুর মতো বেলুন দিয়ে খেলে, একটা বিড়াল যখন উলের বল নিয়ে কারিকুরি করে, একজন ব্যালে ড্যান্সার যখন বেলুন কিংবা তুলার বলের মতো হালকা বল নিয়ে কেবলই মম চিত্তে নৃত্য করে কিংবা যেসব খেলা কেবল মনের খোরাকের জন্য হয়, যেখানে আর কোনো লাভের চিন্তা অথবা ঘড়ি কিংবা কোনো রেফারি থাকে না, সেসব খেলা থেকে কেউ একটা ফুটা পয়সাও রোজগার করতে পারে না।

আজকের দিনে খেলা পরিণত হয়েছে প্রদর্শনীতে, যাতে থাকে কিছু কুশীলব আর দেখার জন্য অগণিত দর্শক। আর এই প্রদর্শনী দুনিয়ার অন্যতম লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, যা আয়োজন করা হয় খেলাটাকে প্রাণবন্ত নয়; বরং বাধা দেওয়ার জন্য। পেশাদার প্রযুক্তি আর আয়োজন ফুটবলকে দিয়েছে বিদ্যুতের মতো গতিশীলতা আর দানবীয় শক্তি, যে ফুটবল উপেক্ষা করে অপার আনন্দকে, কল্পনাকে খুন করে আর অপরাধ হিসেবে আখ্যা দেয় দুঃসাহসকে।

সৌভাগ্যক্রমে, এখনো মাঠে দেখা যায়, যদিও খুবই কদাচিত্, কিছু গোঁয়ার বেয়াদব চিত্রনাট্যের থোড়াই কেয়ার করে এবং বল পায়ে পুরো বিপক্ষ দলকে কাটানোর পাপ করে, যা দেখে পুরো মাঠের দর্শক, এমনকি বিস্মিত রেফারিও মুক্ত স্বাধীন হওয়ার নিষিদ্ধ আনন্দের দুর্নিবার অনুভূতিতে কেঁপে ওঠে।

খেলোয়াড়

মাঠের প্রান্তসীমা বরাবর হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে চলে সে। তার জন্য একদিকে অপেক্ষা করছে স্বর্গের মহিমা, আর অন্যদিকে—নারকীয় পতন!

প্রতিবেশীদের ঈর্ষার পাত্র সে; পেশাদার এই ক্রীড়াবিদকে কারখানার শ্রমিক কিংবা অফিসের কেরানির কাজ করতে হয় না; বরং সে আনন্দের জন্য পয়সা পায়। যেন লটারি জিতেছে সে।

যদিও এর জন্য বালতি বালতি ঘাম ঝরাতে হয়, সুযোগ থাকে না ব্যর্থতা বা ক্লান্তির, তবে তাকে দেখা যায় সংবাদপত্র আর টেলিভিশনে।

রেডিওতে শোনা যায় তার নাম, মেয়েরা তার কথা শুনলেই হয় উদ্বেলিত আর বাচ্চারা হতে চায় তার মতো।

খেলাটা সে শুরু করেছিল আনন্দের জন্য, বস্তির ধুলামাখা পথে, কিন্তু এখন তাকে কর্তব্যের খাতিরে স্টেডিয়ামে খেলতে হয়, যেখানে তার আর কোনো বিকল্প নেই কেবল জয়ের পর জয় ছাড়া।

ফুটবল: ইতিহাসের খণ্ডচিত্র এর প্রচ্ছদ দুই নম্বর ছবি থেকে নিয়ে নিনি

ব্যবসায়ীরা কিনে নেয় তাকে, বেচে দেয়, ধার দেয় এবং আরও খ্যাতি, আরও আরও টাকার প্রতিশ্রুতিতে এসব করতে দেয় সে। সে যত বেশি সফল হয়, যত বেশি টাকা উপার্জন করে, ততটাই হয়ে পড়ে কারাবন্দী। কঠোর সামরিক শৃঙ্খলা মেনে বেঁচে থাকার বাধ্যবাধকতায়, তাকে প্রতিদিনের পীড়াদায়ক নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলন করতে হয় এবং অগণিত ব্যথানাশক ওষুধ আর কার্টিজেন ইনজেকশন সহ্য করতে হয়, যেগুলো তার শরীরকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে রাখে ব্যথা। আর বড় বড় খেলার আগের দিন তাকে বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হয়, যেখানে সে বাধ্য হয় পরিশ্রম করতে, বিস্বাদ খাবার খেতে, কেবল পানি খেয়েই নেশাতুর হতে আর চরম একাকিত্ব নিয়ে ঘুমাতে।

অন্যান্য মানবসংক্রান্ত ব্যবসায়, বৃদ্ধ বয়সে পতন হতে থাকে, কিন্তু একজন ফুটবল খেলোয়াড় তিরিশেই বুড়িয়ে যেতে পারে। অকালে দুর্বল হয়ে যায় মাংসপেশিগুলো।

‘মাঠটা যদি কোনো ঢালে হতো, এই লোক কখনো গোল করতে পারত না।’

‘এই বেটা? গোলকিপারের হাত দুইটা বাইন্ধা রাখলেও হালার পো গোল দিতে পারত না।’

অথবা তিরিশের আগে যদি সে বলের একটা বিষম আঘাত পায় অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে মাংসপেশি ছিঁড়ে যায় কিংবা লাথি খেয়ে হাড় ভেঙে যায় এবং সেটি আর জোড়া লাগে না। এক অতি বিষাদময় দিনে খেলোয়াড়টি আবিষ্কার করে যে সে তার জীবনটা জুয়া রেখেছিল একখানামাত্র তাসের ওপর আর তার সব ধনসম্পদ উধাও হয়ে গেছে এবং সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে সব খ্যাতি।

খ্যাতি নামের সেই চনমনে নারী, ওকে নিঃস্ব, রিক্ত অবস্থায় ত্যাগ করার সময় বিদায় বলা তো দূর, একটাবার ফিরে পর্যন্ত তাকায়নি।

অনুবাদক :সৈয়দ ফয়েজ আহমেদ।