জীবন আর কী দেবে আমাদের, ব্যাগের ভেতর ছাতা নিয়ে বের হওয়ার সাবধানতা ছাড়া

রুম্মানা জান্নাতের কবিতায় কবিতা আর গদ্য মাখামাখি। একধরনের গল্পের আবহ পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়, যা সংবেদী পাঠকের স্মৃতিকে বিপুল মাত্রায় উসকানি দিতে সক্ষম। কবিতা–গল্পের পরম্পরায় এখানে ধরা দেয় সমকালীন জীবনযাপনও। আবার এই কবির কবিতা কোথাও কোথাও কবিতা ও গল্পের ভেদ লুপ্ত হয়ে কেবল ‘কনটেন্ট’ বা রচনা হয়ে ওঠে, কিন্তু কাব্যিক সুষমা থাকে অটুট। চলুন, পড়া যাক এক তরুণ কবির তিনটি কবিতা।

রুম্মানা জান্নাত
ছবি: সংগৃহীত

ভয় পেয়ে তোমার কাছে ছুটে যাইতে না পারার বিভ্রান্তি নিয়ে একটা সকাল শুরু হলো। আকাশে মেঘ, দেখলাম বারান্দা থেকে। যতটুকু দেখা যায়। জীবন আর কী দেবে আমাদের, ব্যাগের ভেতর ছাতা নিয়ে বের হওয়ার সাবধানতা ছাড়া...যা আমরা ভালোবাসি নাই কোনো দিন...

বসন্ত—তা–ও তো নানাভাবে আসে। আমাদের মনে আসে বাড়ির রাস্তা। বাসের জানালা দিয়ে দেখা ঘরগুলোও আপন মনে হয়, ছোট মেয়েটার ফুলতোলা জামা বাতাসে দুলতেছে, আমের মুকুল ঝরতেছে উদাসী গানের মতন। আমাদের ঘুম এসে যায়...

কচুপাতায় টলতে থাকা পানির মতো জটিল করে তুলি ভাষা আর পৃথিবীতে যা কিছু কোমল, তোমার হাতের কল্পনা নিয়ে আসে।
চোখ বন্ধ করলে তুমি কী দেখো? শৈশব, মৃত্যু, এমন কোনো মুখ যে আজ পারুলী নদীর মতো ছবি হয়ে গেছে!

আমি জানি, একটা মধ্যবিত্ত সংসারে তোমার হাত ধরে বসে থাকার কী মানে। কেন যে পুরানা বাংলা গানের মধ্যে স্মৃতি আপার মুখ ভেসে যায়! আমার দরদের মানুষগুলো কবে যে টিকিট–কাটা দূরত্বে চলে গেলে আজ এই সুরভি দুপুরে সেই সব মনে পড়ে। প্রেম কিংবা বিরহ, মনে হয় বর্ষাকাল, নানির কবরের কদমগাছে ফুল ফুটতেছে।

এখন আমিও অভিজ্ঞতায় ন্যুব্জ এক মানুষ। জীবনভর্তি লোকাল বাসের স্মৃতি। আসা–যাওয়ার পথে শুধু দেখলাম মনোরম কচুরি ফুল ছাওয়া দীঘল বিল...তারও বেশি মুগ্ধতা ছিল হরেক মাল বেচা হকারের ভাষায়

চোখ বন্ধ করলে আমরা কী দেখি? শুধুই অন্ধকার?
অথচ অন্ধ বাদুড়ের ডানা ঝাপটানো থেকে আমরা বুঝতে পারি শৈশবে আশ্চর্য ঘোড়া নেমে আসা শিমুলবাগানগুলো কীভাবে শূন্যস্থান হয়ে গেছে

২.

তুমি জানো, কী আমার বিরহ?
কেন কোনো লেখাই তোমাকে ছাড়া লেখা যাচ্ছে না। জানি খুব অল্পই দূরত্ব তবু বাতাসের আগে কেন আমার আত্মা দৌড়াতে থাকে! আর সন্ধ্যাগুলো এমন কৌশলে নামে যেন কোনো অভিকর্ষ বলেই আমাদের দেখা হবে না আর বাতাসে ফাল্গুনও একটা ছল, পাতা ঝরবে বলে

একটা সকাল বন্ধুদের সাথে দেখা হলো তাই সারাটা দিন মুকুল হয়ে থাকল মন। তোমাকে বললাম, একলা খাই বলে এত ঝরঝরে দুপুরও বৈমাত্রেয় লাগে! আর সারা বেলা গুনগুন করা একটা সুর থেকে গানের কথাগুলো কোনোভাবে খেয়ালে আনতে পারলাম না।

তোমাকে বলেছি কী আমার বিরহ? কারা আজও নিজস্ব নামসহ আমাদের স্বপ্নে ফিরে আসে...

ছবি: সৈয়দ লতিফ হোসাইন

৩.

তোমার পাশে শুয়েও মাঝে মাঝে তোমাকে মনে পড়ে। মনে পড়ে, অনেক দিন নীলক্ষেত যাই না। ঘুপচিগলি আর স্যাঁতসেঁতে পথ পার হয়ে আমার নিঃসঙ্গতা সারি সারি বইয়ের নিচে চাপা দেওয়ার কথা। পুরানা বইয়ের লোভ আমাকে ছেড়ে যায়নি যেভাবে টিকিট কাটা পর্যন্তই কিছু মানুষ বন্ধুসুলভ থাকে। মনে পড়ে, তাড়াহুড়া করে নীলক্ষেত গেলে জানা যেত আজ মঙ্গলবার! আজ তুমিও আসবে না!

এখন কি পাতাঝরা মৌসুম শুরু হবে পাখি? ফিনফিনে বাতাসের মধ্যে আমাদের হন্তদন্ত হাঁটা? আমি খুব ধীরে ধীরে হাঁটতে চাই। সকালের রোদে বাসার দারোয়ানদের গোল হয়ে বসে থাকা, প্রত্যেকটা দোকানের নাম পড়তে পড়তে আগায়া যাব বাসস্ট্যান্ডের দিকে। ‘মায়ের দোয়া জেনারেল স্টোর’ ‘সুমি টিস্টল’...। দোকানের মালিক কেউ নয় আমাদের তবু নাম মিলে গেলে কোনো পরিচিত মুখ মন পড়ে।

মনে পড়ে, তোমাকে বলিনি কেমন ছিল সেদিনের আকাশ, কীভাবে কাঁপছিল কপাট, আমার সমস্ত হায়া! আর শুধু সিনেমাতেই দেখলাম পাথরে পাথরে আগুন জ্বলে। কোথাও পৌঁছাতে চাই না আমি, এই সব মনে পড়া নিয়ে আরেকটু স্থিরতা আমাকে পেয়ে বসুক। দেখি, মোড়ের গাছটায় পাতারা সবুজ হচ্ছে। পৃথিবীর সব ঘুঘু বোধ হয় এখনো ডেকে যাচ্ছে হিজলের বনে!