আবুল হাসানের বোনের লেখা
দাদা বলতেন, ‘আমার বুকের মধ্যে দাঁড়কাক অনবরত ঠোকর দিচ্ছে, মা!’
২৬ নভেম্বর কবি আবুল হাসানের মৃত্যুদিন। মৃত্যুর আগে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন এই তরুণ কবি। কেমন ছিল তাঁর সেই সব দিন, আবুল হাসানের বোনের কলমে এবার সেই বৃত্তান্ত।
আমার দাদা কবি আবুল হাসান আমাদের সহোদর হলেও অন্য সব বাঙালি পরিবারে ভাইবোনের যে রকম বোঝাপড়া ও জানাশোনা দেখতে অভ্যস্ত সবাই, তেমনটা আমাদের কখনো হয়নি। মানসিক নৈকট্য থাকলেও অদর্শনের বাস্তবতা আমাদের পরস্পরকে কিছুটা দূরের আত্মীয়ের মতো বানিয়ে রেখেছিল। তবে পারস্পরিক অদর্শনের পরও যে অল্প সময় আমাদের দেখা–সাক্ষাৎ হয়েছে, তার মধ্যেও বোনদের ভেতর বড় হওয়ার কারণেই হয়তো দাদা আমাকে একরকম ভিন্ন চোখে দেখতেন, আমার খোঁজখবরও রাখতেন। মাত্র ২৮ বছরের জীবন দাদার। তাঁর সঙ্গে কাটানো শৈশবের কিছু ভাসা ভাসা স্মৃতি মনে পড়ে। বড়বেলার স্মৃতি এখনো জাজ্বল্যমান।
আমার আব্বা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। ১৯৬৭ সালে আব্বাকে ঢাকার অদূরের দৌলতপুর থানায় বদলি করা হয়। আব্বার এই ঘন ঘন বদলির কারণে মা খুবই বিরক্ত হতেন। ঢাকায় থাকলে অন্তত দাদাকে সপ্তাহে এক দিন হলেও কাছে পেতেন আর আমরা তিন বোনও দাদার সান্নিধ্যে আনন্দমুখর সময় কাটাতাম। তবে দৌলতপুর যেহেতু ঢাকা থেকে বেশি দূরে ছিল না, তাই মা অনেকটা আশ্বস্ত হলেন। দাদার প্রিয় খাবার রান্না করে ঢাকায় পাঠাতেন। ঘন দুধের তকতি পিঠা, দুধলাউ ছিল তাঁর পছন্দের খাবার।
ভেতরে ভেতরে যে দাদা ক্ষয়ে যাচ্ছেন, কষ্ট পাচ্ছেন, তা আমাদের তিনি কখনোই বুঝতে দেননি।
তিনি ঢাকামুখী হলেন
১৯৬৮ সালে আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। ওই সময় পাঁচ বছর চাকরি থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আব্বা। গ্রামে চলে এলেন। আমাকে ভর্তি করা হলো গ্রামের স্কুলে। পুলিশের চাকরি করলেও আমার আব্বা ছিলেন সৎ ও আদর্শবান, শান্ত ও নির্লোভ মানসিকতার মানুষ। তাঁর চারিত্রিক সারল্য ও সততার ছবি দাদার কবিতায়ও আছে। ‘চামেলি হাতে নিম্নমানের মানুষ’ কবিতায় দাদা আমাদের আব্বাকেই এঁকেছেন।
আমরা গ্রামে আসার পর ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে দাদা বাড়ি এলেন। আব্বা অবসর নিয়েছেন, আমাদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি। তাই চাচারা আমাদের আর যৌথ পরিবারে রাখতে চাইলেন না, আলাদা করে দিলেন। আমার দাদা পারিবারিক এই অমানবিক সিদ্ধান্ত একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। ফলে বুকভাঙা যন্ত্রণা নিয়ে সেই যে তিনি ঢাকামুখী হলেন, দীর্ঘ ছয় বছর আর বাড়িতে আসেননি। সবার খোঁজ নিতেন, কিন্তু অভিমানক্লিষ্ট মন দাদাকে বাড়িমুখো হতে দেয়নি।
দাদা ঢাকায় চলে যাওয়ার পর ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এল। তার পরম্পরায় স্বাধীন হলো দেশ। আব্বা দাদাকে খুঁজতে ঢাকায় গেলেন। দাদা বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছেন। আব্বা তাঁর বড় ছেলেকে খুঁজতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীফ মিয়ার ক্যানটিনে গিয়েছেন, দেখা হয়নি। পত্রিকা অফিসেও পাননি দাদার দেখা। অগত্যা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন।
আর এদিকে মায়ের কথা ছিল, ‘আমার টুকুকে এনে দাও।’ ওহ, বলা হয়নি, আমার দাদা আবুল হাসানের ডাকনাম ছিল টুকু।
অবশেষে মা আমাকে এই আমাকে কঠিন দায়িত্ব দিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, যেহেতু দাদা আমাকে ভালোবাসেন, তাই আমি তাঁকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে পারব।
দাদা আমার কথা রেখেছিলেন
১৯৭৩ সাল। আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। দাদা চাকরি করেন দৈনিক জনপদ–এ। একদিন আমার ফুফাতো বোনের স্বামীর সঙ্গে সেই অফিসে গেলাম। আমি আতঙ্কিত ছিলাম এই ভেবে যে যদি দাদা এখানে না থাকেন! আবার মনে হচ্ছিল, এত দিন বাদে দাদা কি আমাকে চিনতে পারবেন? এর মধ্যে তো পার হয়ে গেছে ছয়টি বছর। কিন্তু আমাকে দেখে দাদা ঠিকই চিনলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। যখনকার কথা বলছি, সে সময় দাদার নিজের থাকার কোনো জায়গা ছিল না। তাই একবার ঔপন্যাসিক রাহাত খানের বাসায়, আবার চিত্রপরিচালক শাজাহান চৌধুরীর বাসায়—এভাবেই মাসখানেক দাদার সঙ্গে থাকলাম। আমার পণ ছিল, দাদাকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাব। তবে তাঁর অনেক কাজ থাকায় তখনই তিনি ঢাকা ছাড়তে পারেননি। কিন্তু দাদা আমাকে কথা দিয়েছিলেন, দুই মাস পরই বাড়িতে আসবেন।
কথা রেখেছিলেন দাদা। দশম শ্রেণিতে আমার নির্বাচনী পরীক্ষার ফল বের হওয়ার দুদিন আগেই তিনি বাড়িতে এলেন। মনে পড়ে, মাকে জড়িয়ে ধরে দাদা একটা গান গাইতেন, ‘মা, আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল/ সকলি ফুরায়ে যায় মা।’ আজ ভাবি, তিনি কি তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, দ্রুত ফুরিয়ে আসছে সময়!
যে কয়েক দিন দাদা বাড়িতে ছিলেন, সবার মধ্যে যেন ঈদ ঈদ ভাব বিরাজ করত। পাড়া–প্রতিবেশী, আত্মীয়—সবাই তাঁকে একনজর দেখার জন্য মুখিয়ে থাকত। দাদাও সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে আনন্দে মেতে উঠতেন। এই আসাই যে ছিল দাদার শেষ বাড়ি আসা!
যেদিন চলে গেলেন, আমাদের সারা বাড়ি অমানিশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেল। পরে ১৯৭৪ সালে তো অসুস্থ হয়ে পিজি হাসপাতালে (এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হলেন। তখন আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা চলে। পরীক্ষার পর ঢাকায় গেলাম। তত দিনে দাদা অনেকটা সুস্থ। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা তৎপরতা চালাচ্ছেন।
‘ভয় ও ভালোবাসার উৎস বুড়িকে—দাদা’
কবিস্বভাব ও আপসহীন মানসিকতার জন্য বিভিন্ন সময় দাদা চাকরি ছেড়েছেন। পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে বড় সন্তান হিসেবে দায়িত্ব–কর্তব্য পালনের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে দাদা ক্ষয়ে যাচ্ছেন, কষ্ট পাচ্ছেন, তা আমাদের তিনি কখনোই বুঝতে দেননি। সরকারের আনুকূল্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে জার্মানিতে পাঠানো হয়। তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিদায় জানিয়ে আমরা বাড়িতে ফিরে আসি। ছয় মাস চিকিৎসা শেষে বাংলাদেশে ফিরে আসেন দাদা। তাঁর হার্টের অবস্থা তখন ভালো নয়, শরীর খুবই দুর্বল। চিকিৎসক শেষ চিকিৎসা দিতে পারেননি। রাজনৈতিক অস্থিরতার দোলাচলে ছয় মাসের ওষুধ দিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। একদিকে শারীরিক অসুস্থতা, অন্যদিকে চাকরির জন্য প্রচেষ্টা তাঁকে আবারও মানসিকভাবে ন্যুব্জ করে ফেলে।
১৯৭৩ সালে যখন ঢাকায় যাই, তখন অনেক দিন রাহাত খানের বাসায় ছিলাম। নীনা ভাবি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একদিন তিনি দাদাকে বললেন, ‘হাসান ভাই, বোনকে আপনি চোখে হারান অথচ কোথাও বেড়াতে নিলেন না, কিছু কিনেও দিলেন না, এটা কেমন কথা!’ সেদিনই দাদা আমাকে রিকশা করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যান। নিউমার্কেটে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ আর ছেলেবেলা কিনে দিয়ে বলেছিলেন, ‘বুড়ি (আমার ডাকনাম), অনেক পড়তে হবে, অনেক বড় হতে হবে।’ এরপর গল্পগুচ্ছতে লিখেছিলেন, ‘ভয় ও ভালোবাসার উৎস বুড়িকে—দাদা।’ দাদা সালোয়ার–কামিজ পরা পছন্দ করতেন না। তাই নীনা ভাবিকে শাড়ি কিনতে বলেছিলেন। দাদার কিনে দেওয়া অনেক শাড়ি আমি পরেছি। ক্লাস সেভেন থেকেই শাড়ি পরতাম, দাদা পছন্দ করতেন এ জন্য।
হাপাতালে শুয়ে বলেছিলেন, ‘বুড়িকে এনে দাও’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং ৩ নভেম্বরের জেলহত্যার ঘটনা দাদাকে মর্মে মর্মে কাতর করে তোলে। তিনি মেনে নিতে পারেননি। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভর্তি হলেন পিজিতে। ১১ নভেম্বর আমরা ঢাকায় পৌঁছে হাসপাতালের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। ভিজিটিং আওয়ারে দর্শনার্থীরা রোগীর কাছে যেতে পারবেন। তাই দাদার কাছে যেতে আমাদের বাধা দিচ্ছেন গার্ড। অনেক অনুনয়-বিনয় করে রাজি করানো গেলেও গার্ড আমাদের অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে চলে গেলেন। তারপর মিনিট দশেকের বিরতি। অতঃপর এক লোক আমাদের দাদার বিছানার কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি আর কেউ নন—ক খ জোয়ার্দার। দাদা নাকি ভর্তি হওয়ার দিন থেকেই শুধু ‘বুড়িকে এনে দাও, বুড়িকে খবর দাও’ বলতেন। সেই সূত্রেই সবাই জানতেন যে বুড়ি নামে আবুল হাসানের এক বোন আছে। হাসপাতালে দাদা যে ঘরে থাকতেন, ওই ঘরে যতজন চিকিৎসা নিতে ভর্তি ছিলেন, সবাই অবাক হয়ে আমাকে দেখছিলেন।
আমি আর মা সেবার উঠেছিলাম দাদার বন্ধু, বাসসের সাংবাদিক মাহফুজুল হক খানের মালিবাগের বাসায়। ভর্তি হওয়ার আগে দাদা তাঁদের বাসায় একটা ঘর নিয়ে থাকতেন। শেষ দিকে প্রায়ই বুকে ব্যথা উঠত দাদার। ব্যথার যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতেও দাদা তাঁর দায়িত্বের কথা ভোলেননি। অনেককে বলেছেন আমার জন্য বিয়ের পাত্র দেখতে। মাকে বলতেন, ‘আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না, বোনদের দায়িত্ব নিতে পারলাম না, আমি অসহায়, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। গ্রামের বাড়িতে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে দিয়ো। ওখানে আমি শান্তিতে ঘুমাতে চাই। ফুলের বাগান থাকবে, আমি প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেব।’
ব্যথা যখন খুব বেশি হতো, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে যেতে দাদা বলতেন, ‘আমার বুকের মধ্যে দাঁড়কাক অনবরত ঠোকর দিচ্ছে, মা! আমি সহ্য করতে পারছি না।’ আমি হাতে তেল মেখে দাদার পিঠে, বুকে মালিশ করে দিতাম, মায়ের কান্নাভেজা চোখ মুছে দিয়ে নিজের কষ্ট লুকাতাম। মালিবাগের বাসা থেকে স্যুপ বানিয়ে হেঁটে হেঁটে হাসপাতালে দাদাকে খাইয়ে আমার আরেক ভাই বাদলসহ আমি বাসায় যেতাম—সে সময় এ–ই ছিল আমার প্রাত্যহিক রুটিন। মা থাকতেন দাদার সঙ্গে।
একসময় দাদাকে কেবিনে নেওয়া হলো। কেবিনে শুয়ে মাকে এক যুবককে দেখালেন দাদা। তাঁকে আমিও দেখেছি, দিনরাত এক করে অসুস্থ দাদার সেবা করতেন। জানতাম, তিনি কবিতা লেখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। দাদার কবিতার অনুরাগী। মাস্টার্সের কয়েকটি টিউটোরিয়াল পরীক্ষাও দাদাকে দেখভালের কারণে দিতে পারেননি। তো ওই যুবককে দেখিয়ে মাকে দাদা বলেছিলেন, ‘ওর নাম হাফিজুর রহমান। যদি সম্ভব হয়, ওর সঙ্গে বুড়ির বিয়ে দিয়ো। খুব ভালো ছেলে।’ আশ্চর্য লাগে, দাদা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকেও আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে গেলেন!
দাদার আর সূর্যোদয় দেখা হলো না
২৫ নভেম্বর দাদাকে অনেক সুস্থ মনে হলো। সুরাইয়া খানমের সঙ্গে অনেককে কথা বলতে শুনেছি। তিনি প্রায় প্রতিদিনই হাসপাতালে আসতেন। আরও অনেকেই আসতেন। তবে দাদার সব কবি বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষীকে আমি চিনতাম না। তাঁদের কথোপকথন শুনতাম। আমি হাসপাতালের কিচেনে পানি গরম করছি, এ সময় একজন বলে উঠলেন, ‘হাসান এ–যাত্রায়ও বেঁচে গেল!’ কী বুকভরা আনন্দ আর আশা নিয়েই না আমরা দুই ভাই–বোন মালিবাগের বাসায় ঘুমাতে গিয়েছিলাম সেদিন!
ভোরবেলা ‘বাদল, বাদল’ বলে দরজার কড়া নাড়ার শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলতেই বাদল ভাই হাফিজুর রহমানকে দেখতে পান। তিনি বলেন, ‘হাসান ভাইয়ের অবস্থা ভালো না। বুড়িকে নিয়ে হাসপাতালে চলে আসো।’ ভোরের আজানের সময় দাদা প্রতিদিন হুইলচেয়ারে বসে করিডরে যেতেন সূর্যোদয় দেখতে। ওই দিন হাফিজুর রহমান দাদাকে বলেছিলেন, ‘হাসান ভাই, সূর্যোদয় দেখবেন না?’
আমার দাদার আর সূর্যোদয় দেখা হলো না! হাফিজুর রহমানের কোলেই তিনি ঢলে পড়েন।
আমরা যখন হাসপাতালে পৌঁছালাম, তখন মা নির্বাক। মুখে কোনো কথা নেই। দাদাকে কোথায় দাফন করা হবে, এটা নিয়ে বিতর্ক চলছে। শেষ পর্যন্ত ঢাকায় বনানী কবরস্থানে তাঁর দাফনের সিদ্ধান্ত হলো। ট্রাকে চেপে বনানী কবরস্থানে গেলাম আমরা।
আমার দাদা শান্তিতে একটু ঘুমাতে চেয়েছিলেন। চিরদিনের জন্য চলে গেলেন ঘুমের দেশে।
যে বইয়ে আছে আবুল হাসানের জার্মানবাসের অজানা কাহিনি
আবুল হাসান রাইনহার্ট হেভিকে—বাঙালি কবি জার্মান শিল্পী: এক অবিশ্বাস্য বন্ধু
সম্পাদক: ওয়াকিলুর রহমান
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশনী, ঢাকা
দাম: ৪০০ টাকা।
‘উদিত দুঃখের দেশ, হে কবিতা, হে দুধভাত তুমি ফিরে এসো’—কবিতাকে এভাবে আহ্বান করেছিলেন যে কবি, তিনি আবুল হাসান। হৃদ্যন্ত্রের চিকিৎসার জন্য ১৯৭৪ সালে তৎকালীন পূর্ব জার্মানির বার্লিনে গিয়েছিলেন তিনি। শীতে কাঁপতে কাঁপতে উঠেছিলেন তুষারাচ্ছন্ন বার্লিনের শারিটে হাসপাতালে। স্বজনহীন সেই হাসপাতালে তাঁর গায়ে তখন ছিল না কোনো গরমকাপড়। জার্মান ভাষাও অজানা। অসহায় সেই মুহূর্তে আবুল হাসানের পাশে দেবদূতের মতো হাজির হয়েছিলেন তরুণ জার্মান শিল্পী রাইনহার্ট হেভিকে। সেই যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বন্ধুত্বের, গুটিয়ে নেননি আর কখনোই।
বার্লিন থেকে হাসান ফিরে এলেন দেশে। ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যু হলো, পার হয়ে গেল দশকের পর দশক। কিন্তু রাইনহার্টের বুকের মধ্যে জীবিত থেকে গেলেন হাসান। দূরদেশে আমৃত্যু কবি-বন্ধুর স্মৃতি আগলে রইলেন এই শিল্পী। তাঁর কাছে অমূল্য হয়ে থেকে গেল তাঁদের বার্লিনজীবনের স্মৃতি, ছবি, তাঁর আঁকা আবুল হাসানের প্রতিকৃতি, তাঁকে লেখা হাসানের চিঠি। আবুল হাসান–রাইনহার্ট হেভিকে—বাঙালি কবি জার্মান শিল্পী: এক অবিশ্বাস্য বন্ধুত্ব শিরোনামে এ বইয়ে আছে ভিনদেশি দুই কবি আর শিল্পীর অবিশ্বাস্য এক বন্ধুত্বের গল্প।
বইটিতে রাইনহার্ট হেভিকে লিখেছেন আবুল হাসানের জার্মানবাসের অজানা কাহিনি। সুদূর বার্লিনে বসে জার্মান শিল্পী রাইনহার্ট লিখেছেন তাঁদের নিবিড় স্মৃতিকথা। আমৃত্যু আগলে রেখেছেন হাসানের দুষ্প্রাপ্য ছবি, চিঠি ও প্রতিকৃতি। আর এর মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয়েছে কবির এমন এক অবয়ব, যিনি মানবিক ও সমাজতন্ত্রী; বুকের ব্যথায় কাতর, তবু ভাবছেন মানুষের কথা। পকেটের শেষ কড়িটিও দিয়ে দিচ্ছেন দরিদ্র মানুষকে।
প্রায় অর্ধশতাব্দী পর উন্মোচিত হলো অমর এই বন্ধুত্বের ঘটনা। রাইনহার্ট হেভিকের সঙ্গে লেগে থেকে তাঁর কাছ থেকে এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করিয়েছেন শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান। বইয়ের সম্পাদকও তিনি। জার্মান ভাষা থেকে রাইনহার্ট হেভিকের লেখা বাংলায় ভাষান্তর করেছেন আব্দুল্লাহ আল-ফারুক। আর ইংরেজিতে লেখা চিঠিগুলো অনুবাদ করেছেন রেজাউল করিম সুমন। যাঁরা কবিতা ভালোবাসেন এবং যাঁরা আবুল হাসানপ্রেমী—সবার জন্যই বইটি অন্তরের খোরাক হতে পারে। প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরোনো বইটির দাম ৪০০ টাকা। বইটি সংগ্রহ করতে ভিজিট করুন: prothoma.com
গ্রন্থনা: অন্য আলো প্রতিবেদক