কহে বীরাঙ্গনা নাটকটির শেষে দর্শক যখন স্থির হয়ে থাকেন, জ্যোতি সিনহার অভিনয় তখন যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শততম প্রদর্শনীতে মিলনায়তনের দর্শকের কাছে পুরাণের ঘটনা বাস্তব রূপ পায়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত চার পুরাণ–নারী শকুন্তলা, দ্রৌপদী, দুঃশলা ও জনাকে মঞ্চে নির্মাণ করেছেন একা জ্যোতি সিনহা।
এই নাটকে চার নারী পত্র লিখছে তাদের প্রিয়জনদের। আর তার মধ্য দিয়ে ঘটছে চারটি মনের উন্মোচন। রাজা দুষ্মন্তের বিরহে শকুন্তলা এবং অর্জুনের বিরহে দ্রৌপদীর দর্শকদের ব্যাকুল করে। প্রেমে মিলনের আনন্দ, বিরহের বেদনা, প্রিয়জনের প্রতি মান–অভিমান জ্যোতি রূপায়ণ করেন তাঁর চার সহ–অভিনেত্রীকে সঙ্গে করে। মানবপ্রেমের চিরায়ত অনুভবের মূর্ত রূপ হয়ে ওঠে ধৃতরাষ্ট্রের কন্যা দুঃশলা।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনপুত্র অভিমন্যুকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার পর অর্জুনের লক্ষ্য হয়ে ওঠে হত্যাকারী জয়দ্রথ। দুঃশলা তাঁর স্বামী জয়দ্রথকে তখন পত্র লেখেন। দুঃশলার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের রক্তাক্ত বিভীষিকা, বর্বরতা, অমানবিকতা যতটা উন্মোচিত হয়, তার চেয়েও বেশি প্রকাশ পায় মানবিক মুক্তির আহ্বান।
শেষ পত্র নীলধ্বজের প্রতি পত্নী জনার। পুত্রহারা জনার বিক্ষুব্ধ মনের আকুতি আমাদের হৃদয়কে আর্দ্র করে। দেশে দেশে যুদ্ধে স্বজন প্রিয়জন হারিয়ে বিধ্বস্ত অমানবিক প্রান্তরে নিঃশব্দ রোদন সে-ও তো মায়েরই। জ্যোতি সিনহা সেই মায়েদের বিলাপ ও বিক্ষোভ এক সুরে গেঁথেছেন তাঁর অভিনয়ে।
কণ্ঠ, দেহবিক্ষেপ, অভিব্যক্তি ও মুদ্রায় জ্যোতি একাই নাটকটির ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তবু বলতে হবে জনার চরিত্রে তিনি বাকি তিনটি চরিত্রকে ছাপিয়ে অসামান্য হয়ে উঠেছিলেন। বস্তুত নির্দেশক শুভাশীষ সিনহা চারটি চরিত্রের মধ্যে জনা চরিত্রটিকেই আলাদা অভিনয়শৈলীতে নির্মাণ করেছেন। বাকি তিনটি চরিত্রকেও আলাদা–আলাদা অভিনয়–কাঠামোয় নির্মাণ করার সুযোগ এ নাটকে ছিল। তবু বলব, কহে বীরাঙ্গনা নাটকে মাইকেলের কবিতা নতুন মাত্রা পেয়ে পুরাণ থেকে সমকালে প্রবেশ করেছে।
এই নাট্য উপস্থাপনে মূল অভিনেত্রীর চার সহচরীর বারবার অভিনয়–আয়তন থেকে প্রবেশ ও প্রস্থানের এবং পোশাক পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি না, তা নির্দেশক ভাবতে পারেন।
কহে বীরাঙ্গনা মণিপুরী থিয়েটারের উজ্জ্বল কীর্তি হয়ে থাকবে।
সুদীপ চক্রবর্তী