প্রতিদিনের প্রয়োজনে বাংলা

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তস্নাত পটভূমি পেরিয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে পেয়েছি আমরা। সেই পথরেখা বেয়ে বাংলাদেশের ভাষা–পরিস্থিতি এখন কেমন, তা নিয়ে অমর একুশে বিশেষ সংখ্যায় এবার কলম ধরেছেন এ প্রজন্মের লেখক ও গবেষকেরা।

প্রচ্ছদ: আরাফাত করিম

বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের আবেগের কমতি নেই। কিন্তু প্রতিদিনের কাজে বাংলা ভাষাকে সহজে এবং স্বচ্ছন্দে ব্যবহারের সুযোগ মেলাটাই কাজের বিষয়। কাজের দিকটি আড়ালে চলে যায় বলেই একুশে ফেব্রুয়ারির আবেগ মিইয়ে যেতেই বাংলা ভাষা নিয়ে কারও কোনো খোঁজ থাকে না। প্রশ্ন ওঠে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের মতো বড় বড় যে ঘটনা ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেগুলো আবেগের বাড়াবাড়ির মধ্যেই আটকে রইল? বাংলা কেন এত দিনেও তা ‘কাজের ভাষা’ হয়ে উঠতে পারল না।’ সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে বাংলা ভাষার সংকটগুলো কোথায়, তা খতিয়ে দেখা যাক। 

‘কাজের ভাষা’ হয়ে উঠতে গেলে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ বিশেষ করে প্রশাসন, আইন ও বিচারসংক্রান্ত সবকিছুর ভাষা—করপোরেট খাতসহ জনসম্পৃক্ত বেসরকারি দপ্তরের ভাষা হওয়া দরকার বাংলা এবং ক্ষেত্রবিশেষে ইংরেজি অনুবাদসহ বাংলা। এটা কিন্তু কোনো নতুন কথা নয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই বিদেশি পত্র যোগাযোগের ক্ষেত্রেও মূল চিঠি বাংলায় এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ইংরেজি অনুবাদ যুক্ত করার নির্দেশনা এসেছিল। তবে সেই নির্দেশনা তো পঁচাত্তর-পরবর্তী পর্যায়ে আর টেকেনি। এর পেছনে অনেক কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন না হলেও মূল সমস্যা রয়ে গেছে বাংলা ভাষাকে খুবই সংকীর্ণ একটি ঘেরাটোপে বন্দী রাখার মধ্যে। এর ভেতরে রয়েছে অস্পষ্ট ভাষানীতি, একদেশদর্শী প্রমিতকরণ, পরিভাষা ও নতুন শব্দ তৈরিতে মাত্রাতিরিক্ত সংস্কৃতনির্ভরতা, সংহিতা বদল ও মিশ্রণকে বাস্তবতার নিরিখে না-দেখা, বানান নিয়ে সংহতির অভাব, বর্ণক্রম ও বর্ণবিন্যাস নিয়ে জটিলতা তৈরি করে রাখা, বাংলা ভাষার কোনো কার্যকর ব্যাকরণ রচিত না হওয়া কিংবা বাংলা ভাষার মূল প্রবণতা অনুসারে কোনো অভিধান, থিসারাস বা সমার্থক শব্দকোষ, উচ্চারণ অভিধান প্রণীত না হওয়া প্রভৃতি। অর্থাৎ বাংলাকে কাজের ভাষা করার প্রাথমিক পূর্বশর্ত যেগুলো, তার প্রতিটিকে বিপত্তির মধ্যে রেখে দেওয়াই এর মূল লক্ষ্য।

স্বাধীনতার এত বছর পরে এসেও দেশে কোনো স্পষ্ট ভাষানীতি তৈরি হয়নি। একটি দেশের ভাষানীতির মূল বিষয়গুলো হলো: ভাষাচর্চা, ভাষিক আদর্শ, ভাষাবিশ্বাস ও ভাষা ব্যবস্থাপনা। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে চারটি জায়গাই নড়বড়ে। ভাষার চর্চা রাষ্ট্রীয় কাজে বেশ সীমিত। বাংলা ভাষার আদর্শ আবেগসর্বস্ব ও বাহ্যিক আড়ম্বরে পূর্ণ। নানা রকম অপবিশ্বাস এই ভাষায় সুলভ যেমন, বাংলা ব্যবহারের সময় অন্য ভাষার শব্দ নিয়ে আসা খুব বাজে কাজ কিংবা আঞ্চলিক উপভাষাগুলো কমেডি কিংবা কৌতুক তৈরির বেশ রসাল উপকরণ প্রভৃতি। ফলে যথাযথ ব্যবস্থাপনায় আত্তীকৃত উচ্চারণে সুশৃঙ্খল কোনো জনভাষারূপ বাংলা ভাষায় নেই। 

কেন নেই? তাহলে যে জনমানুষের মধ্যে এক অসাম্প্রদায়িক দেশজ ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যে ভাষারূপ তাদের কাছে তুলনামূলকভাবে বেশি চেনা, সেই ভাষারই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মেলে। এরূপ ঘটলে নিয়ন্ত্রক শ্রেণির স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ধারাবাহিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে পৌঁছে এমন এক দৃঢ় অসাম্প্রদায়িক ঐক্যচেতনার জন্ম দিয়েছিল। সময়ের প্রয়োজনে এই ঐক্যশক্তি দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজে লেগেছিল বটে, কিন্তু বাংলা ভাষার উন্নয়নে তা ব্যবহৃত হয়নি। বরং শুদ্ধ-অশুদ্ধের নামে, প্রমিত-আঞ্চলিক উপভাষার দোহাই দিয়ে কিংবা ভাষার ধর্ম বিচার করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে রাখা হয়েছে। একজন অফিস কর্মকর্তা এবং একজন রিকশাচালক—দুজনেই বাংলা ভাষা ব্যবহার করলেও তাদের মধ্যে ভাষিক যোগাযোগসূত্রে কোনো বোধের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। ভাষার অন্তর্নিহিত বিভেদ দুজনের মধ্যে মানবিক দূরত্ব বাড়ায়। এর থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় বাংলার একটি আনুষ্ঠানিক জনভাষারূপ প্রতিষ্ঠা; যে ভাষারূপ মূলত দায়বদ্ধ থাকবে সাধারণ মানুষের সুশৃঙ্খল ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার-প্রবণতার কাছে। একটি প্রতিনিধিত্বহীন রূপকে আদর্শ ধরে তার ছাঁচে সব বাংলাভাষীকে আটানোর চেষ্টা না করে, বাংলাদেশের মানুষ সাধারণভাবে আনুষ্ঠানিক পরিবেশে যে ধরনের শব্দ নির্বাচন করে, বাক্যকাঠামো নির্ধারণ করে এবং সাবলীলভাবে যা উচ্চারণ করে, সেগুলোর সাদৃশ্য ও বৈচিত্র্য শনাক্ত করে অসাম্প্রদায়িক এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ একটি আদর্শ ভাষারূপ স্থির করা প্রয়োজন। যেমন ‘রক্ষা’ শব্দটিকে ‘রোক্খা’ উচ্চারণ না করলে প্রমিত বাংলার মান রক্ষা হয় না, অথচ এ দেশের অধিকাংশ ‘শুদ্ধ’ উচ্চারণের মানুষও খুব সচেতন না থাকলে ‘রক্খা’-ই উচ্চারণ করেন। তাই বাংলার জনভাষারূপে ‘রক্খা’ উচ্চারণই গৃহীত হওয়া উচিত। তবে ‘যাচ্ছি’, ‘খাচ্ছি’র মতো সহজ ও অতিপ্রচলিত রূপকে পাশ কাটিয়ে ‘যাইতেসি’, ‘খাইতেসি’র মতো বৈচিত্র্যকে এই আনুষ্ঠানিক জনভাষারূপ থেকে দূরে রাখারই প্রয়োজন হবে।

মনে রাখতে হবে যে সংস্কৃত আধিপত্য কমিয়ে ভাষা সহজীকরণের ছুতোয় একদল মানুষ অকারণে অনাবশ্যকভাবে আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের ব্যবহার প্রকট করে তুলতে চাইতে পারেন। পারিভাষিক শব্দ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো চিন্তা বা ধারণার সহজ পরিভাষা পাওয়া না গেলে অন্য ভাষার শব্দ নিজের করে নিতে বাধা কোথায়? অতিরিক্ত সংস্কৃতনির্ভরতার সূত্র ধরে গঠিত অনেক পারিভাষিক শব্দের একটি ‘ফরোয়ার্ডিং’-এর বাংলা হিসেবে ‘অগ্রায়ণ’ ব্যবহৃত হলে শুনতে ও বলতে কষ্ট হয়; এর চেয়ে ‘ফরোয়ার্ডিং’-ই সুবিধার। বাংলা ভাষার প্রবণতাও তাই; না হলে ‘সবজি’, ‘সবুজ’, ‘বালতি’, ‘আলমিরা’—এখনো খটমট সংস্কৃত বিকল্প শব্দের মুখাপেক্ষী থাকত। কথা বলার সময় ইংরেজি শব্দ ঢুকে গেলেই কেবল আমাদের আপত্তি, উৎস না জেনে কতশত অন্য ভাষার শব্দের মিশ্রণ ঘটাচ্ছি, তার হিসাব করতে গেলে বিস্মিত হতে হবে। শত শত বছর ধরে চলে আসা ভাষার মিশ্রণ যে পর্যন্ত নামশব্দ, বিশেষণ কিংবা নামশব্দযোগে গঠিত ক্রিয়ার মধ্যে সীমিত থাকছে, সে পর্যন্ত মনে হয় না আতঙ্কিত হওয়ার কিছু আছে। 

বাংলা কাজের ভাষা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা এর অসংগতিপূর্ণ বানান ব্যবস্থা। বিষয়টি দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখলেও বর্তমান পরিসরে সংক্ষেপে দুটি বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে। প্রমিত বানান নির্দেশনার সবচেয়ে পরিচিত যে নমুনা আমাদের সামনে রয়েছে, তাতে বর্ণিত শব্দের উৎসভিত্তিক বানানরীতি কতটা বাস্তবসম্মত, তা মনে হয় ভেবে দেখা দরকার। একজন সাধারণ শিক্ষিত মানুষের পক্ষে সব শব্দের উৎস জেনে বানানে হ্রস্ব-ই-কার, দীর্ঘ-ঈ-কার কিংবা ‘ন’ বা ‘ণ’ প্রভৃতির প্রয়োগ করা কি সম্ভব? বানানরীতির কোথাও গুরুত্ব পেয়েছে শব্দের উৎস, কোথাও গুরুত্ব পেয়েছে সূত্র, কোথাও আবার গুরুত্ব পেয়েছে উচ্চারণ; আর সেই সঙ্গে বিকল্প বানানের সংকট তো রয়েছেই। কোনো দ্ব্যর্থকতামুক্ত সংহত কৌশল এখনো এই বানানরীতিতে অনুপস্থিত, যা একজন শিক্ষার্থীর বানান আয়ত্ত করার ক্ষেত্রে বড় বাধা।

প্রশ্ন ওঠে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের মতো বড় বড় যে ঘটনা ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেগুলো আবেগের বাড়াবাড়ির মধ্যেই আটকে রইল? বাংলা কেন এত দিনেও তা ‘কাজের ভাষা’ হয়ে উঠতে পারল না।

বাংলা ভাষার ব্যাকরণ নিয়েও রয়েছে নানা সংকট। যাঁরা ছাত্রপাঠ্য ব্যাকরণ লিখছেন, তাঁরা কতটা দূরদর্শিতার স্বাক্ষর রাখছেন, তা ভেবে দেখা দরকার। ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব কিংবা বাক্যতত্ত্ব—বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়েছে বিপত্তি। প্রমিত বাংলা ব্যাকরণের নামে সংকলিত হয় বিভিন্ন লেখকের ব্যাকরণবিষয়ক প্রবন্ধ, যেগুলো কমবেশি দাবি করে যে বাংলা ভাষার ভিন্ন দুটি ভাষারূপের জন্য একক ব্যাকরণগ্রন্থ প্রণয়ন যথেষ্ট। এই দাবি কতটা ভাষাবিজ্ঞানসম্মত, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ রয়েছে। বহুবিধ অসংগতির একটি উল্লেখ করা হলো: বাংলাদেশের বাংলাভাষী সাধারণ মানুষের উচ্চারণে তালব্য ‘চ, ছ, জ, ঝ’ ধ্বনি যতটা স্পৃষ্ট, ততটা ঘৃষ্ট নয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের উচ্চারণকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলা তালব্য ধ্বনিগুলোকে নির্বিকল্পভাবে ঘৃষ্ট বিবেচনা করা হয়েছে। অসংগতিমুক্ত বাংলা ব্যাকরণগ্রন্থ যেমন নেই, তেমনি নেই সংস্কৃতবলয় থেকে বেরিয়ে আসা কোনো বাংলা অভিধান কিংবা থিসারাস (সমার্থক শব্দকোষ)। একই সঙ্গে নেই সুনির্দিষ্ট বর্ণক্রম, বর্ণবিন্যাস, রেফারেন্সিংয়ের আদর্শ রীতি, নির্ভুল বানানে সহজে পাঠযোগ্য বাংলা ওয়েব কনটেন্ট এবং এমন অনেক কিছু, স্পেলিং বা গ্রামার চেকার ছুঁতে ব্যর্থ হয় কাম্য-সীমা। ভাষাপ্রযুক্তির দুনিয়ায় বাংলা এখনো স্বল্প পুঁজির ভাষা।

স্কুল-কলেজে বাংলা ভাষা শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত বিদেশি ভাষা যেখানে বছর দুয়েক শিখলে শ্রবণ-পঠন-কথন-লেখন সবগুলো দক্ষতা একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায় পর্যন্ত অর্জিত হয়ে যায়, সেখানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা ১২ বছর অধ্যয়ন করেও কেন দুর্বলতা রয়ে যায়? তাই প্রাথমিক শ্রেণির ভাষা শিক্ষাদান পদ্ধতির কার্যকারিতা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। 

ঢাকা িবশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র–জনতার ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুিত, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
ছবি: রফিকুল ইসলাম

এ আলোচনা শেষ করব বাংলা ভাষার প্রতি ছদ্মপ্রেমজাত কিছু প্রচলিত ডিসকোর্স উত্থাপন করে; যার অন্যতম হলো, ইংরেজি মাধ্যম কিংবা ইংরেজি ভার্সনের কারণে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষার উপযুক্ত অবস্থান তৈরি না হওয়া। ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যায়তনে বাংলা ব্যবহারের সুযোগ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেই বলা যায় যে এই মাধ্যমের বিভিন্ন শ্রেণিতে যেসব পাঠক্রমের অধীনে বাংলা বিষয়ে পাঠদান করা হয়, সেগুলোর কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও অনুপযোগী শিক্ষাদান পদ্ধতিই মূল সমস্যা। ইংরেজি ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রতিযোগিতা অসম ও অর্থহীন, জলের মাছকে গাছে ওঠার প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেওয়ার মতো। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যদি একজন শিক্ষার্থীর প্রথম ছয় বছরের শিক্ষাজীবনে তার মাতৃভাষাসহ প্রয়োজনীয়সংখ্যক ভাষার মৌলিক ও কার্যকর জ্ঞান নিশ্চিত করতে পারে, তবে সেই শিক্ষার্থী যে মাধ্যমেই তার বাকি শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করুক না কেন, ভাষাদক্ষতা সব সময় উত্তম বিনিয়োগ বলেই বিবেচিত হবে। 

আরেকটি ভুল ডিসকোর্স হলো ‘সর্বস্তরে’ বাংলা ভাষা চালু করার প্রস্তাব। ‘সর্বস্তর’ ধারণাটি অস্বচ্ছ ও অনির্দিষ্ট। প্রকৃতপক্ষে, প্রশাসন, আইন ও আদালতে সবার আগে বাংলা ভাষার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কিন্তু ‘সর্বস্তরের’ দোহাই দিয়ে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই, বাংলা ভাষায় প্রয়োজনীয় পাঠ্যবইসহ বিভিন্ন শিক্ষা-উপকরণ নিশ্চিত না করে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম বাংলা করার দাবি তুললে অবাধ জ্ঞানচর্চা হুমকির মুখে পড়ে আর সুযোগ বুঝে মানহীন বইয়ের ব্যবসা উৎসাহ পায়।

বাংলা ভাষাকে ‘কাজের’ ভাষা করে তুলতে হলে বুদ্ধিজীবীর ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ থেকে বের হতে হবে। ভাষা নিয়ে ইতিহাসের পাতায় রাজনীতি ও দুরভিসন্ধি প্রমাণ করা, বিশেষ সম্প্রদায়ের দায়িত্ব অবহেলাকে ‘ভিকটিম কার্ডে’ আড়াল করা, বাংলার বিকাশের পথে ইংরেজির কাঁটা বিছানোর গল্প বলা—এসব বয়ানে উত্তেজনাভরা বিস্ময় জাগিয়ে তোলা সহজ, কিন্তু এতে ঢাকা পড়ে বহুবিধ ব্যর্থতা, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতা। উল্লিখিত সমস্যাগুলো সমাধানের পরও যদি দেখা যায়, বাংলা ভাষা অবহেলিতই রয়ে গেছে, তখনই কেবল ষড়যন্ত্রের সন্ধান করা যেতে পারে।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।